Alapon

ইবলিশ মানুষের দুইটা বৈশিষ্ট্যের কথা ইচ্ছা করেই উল্লেখ করেনি...



মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে তিনটি জিনিসের সমন্বয়ে।
১। তাকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছে,
২। তাকে ভারসাম্যসহ তৈরি করা হয়েছে
৩। এবং তাকে রুহ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

তিনটি উপাদান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন এই আয়াতে। আর তিনি ফেরেশতাদের এগুলো জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই তিনটি অংশ মানুষকে বিস্ময়কর করে তুলবে।

সাধারণভাবে সবাই জানে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আদম (আ) কে সৃষ্টি করেন। সৃষ্টি করার পর তিনি আদমকে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাদের আদেশ করেন। সবাই এটা মেনে নিয়েছিল কিন্তু ইবলিশ অমান্য করেছিল। এটাই ঘটনার সহজ একটি বিবরণ। অধিকাংশ মানুষ এর সাথে পরিচিত।

আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল সর্বপ্রথম সকল ফেরেশতাদের প্রতি ঘোষণা জারি করেন, আর আমরা বুঝতে পারি সেসময় তাদের মাঝে ইবলিশও এ ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত ছিল। اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ طِیۡنٍ (ইন্নি খা-লিকুন বাশারাম মিন তীন)- "আমি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি মাটি থেকে বা কাদা থেকে। " [৩৮:৭১]

আল্লাহ যখন এই ঘোষণা দিচ্ছেন তখনো তিনি আদমকে সৃষ্টি করেননি। আদম (আ) কে এখনো সৃষ্টি করা হয়নি কিন্তু ঘোষণা জারি করা হয়েছে যে, আল্লাহ এটা করতে যাচ্ছেন। এটা হলো খালিকুন বাশারাম মিন তীন। এরপর 'ফা ইজা'। আরবিতে 'ইজা' ব্যবহৃত হয় ভবিষ্যতে ঘটতে যাচ্ছে এমন কিছু বুঝাতে। فَاِذَا سَوَّیۡتُهٗ وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ - (ফা ইজা ছাওওয়াইতুহু ওয়া নাফাখতু ফিইহি মির রুউহি) "তাকে যখন আমি ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলবো এবং তার ভিতরে আমার রূহ ফুঁকে দেব..."

এগুলোর কোনো কিছুই এখনো ঘটেনি। সামনে ঘটতে যাচ্ছে। এরপর তিনি বললেন- فَقَعُوۡا لَهٗ سٰجِدِیۡنَ- (ফাকা'য়ু লাহু ছা-জিদিইন) "তখন তোমরা তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে যাও"।
আল্লাহ বর্ণনা করছেন তিনি আমাদের পিতাকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন এবং আমাদের সৃষ্টি করার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে যাচ্ছেন তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সবার আগে আমি তাকে 'তীন' থেকে তৈরি করবো।

চলুন, এখানে একটু থামি। এই পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র সৃষ্টি নই যাদের 'তীন' থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। বস্তুত, সকল প্রাণিকুল তথা যত ধরণের প্রজাতি এই পৃথিবীতে বর্তমান আছে তার সবই 'তীন' থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের এবং এই গ্রহে অবশিষ্ট অন্য সকল জীবের মাঝে এটা একটা কমন উপাদান। সমগ্র প্রাণী জগত, সকল পোকামাকড় সবাই 'তীন' থেকে এসেছে। আচ্ছা, বুঝলাম।

কিন্তু, আল্লাহ এখন যাকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তার মাঝে অতিরিক্ত কিছু ব্যাপারও রয়েছে। আমাদের পিতার মাঝে এবং এর সাথে আমাদের মাঝেও। এই সৃষ্টিটি 'তীন' ছাড়াও আরও কিছু। তার মাঝে পাশবিক দিকের অস্তিত্ব ছাড়াও আরও কিছু আছে।

এরপর আল্লাহ আরও যোগ করলেন- কেন কাদা থেকে নির্মিত এই সৃষ্টি পৃথিবীতে বর্তমান থাকা অন্য সকল সৃষ্টি থেকে আলাদা? فَاِذَا سَوَّیۡتُهٗ (ফা ইজা ছাওওয়াইতুহু)- যখন আমি তাকে সুষম করে তৈরি করবো বা ভারসাম্যপূর্ণ করবো। "تسويات" মানে কোনো কারূশিল্পকে নিখুঁত করা, ভারসাম্যপূর্ণ করা। উদাহরণস্বরূপ- কেউ যদি লোহা বা কোনো ধাতু গলিয়ে জোড়া লাগায়, সে তখন নিশ্চিত করতে চায় যেন উভয় অংশ একেবারে সমানভাবে জোড়া লাগে। তার কাছে জোড়াটাকে নিখুঁতভাবে সমান করার বিভিন্ন যন্ত্র থাকে। একে বলে تسويات
তো, আল্লাহ বলছেন- এক ধরণের ভারসাম্য এবং পারফেকশন এই সৃষ্টির মাঝে যোগ করা হবে যা অন্য সৃষ্টির মাঝে নেই।

আল্লাহ এখানে বলছেন মানবজাতির পরস্পর সাংঘর্ষিক বিষয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করার সামর্থ্য থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যক্তিগত প্রয়োজন এবং পারিবারিক প্রয়োজনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করার সামর্থ্য থাকবে তাদের। তারা ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব এবং সামাজিক দায়-দায়িত্বের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে। তারা তাদের অধিকার এবং দায়িত্বের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করবে। আমাদের সমগ্র জীবনটাই হবে আসলে ভারসাম্যের সমষ্টি।
ভারসাম্য হলো আমাদের আবেগ-অনুভূতি এবং চিন্তাশক্তির মাঝে। এর মানে কী? চলুন, একটু ব্যাখ্যা করি। ক্ষুধার্ত কুকুর সামনে কোনো খাবার দেখলে এর প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কামড় দিয়ে বসে। সে ফলাফল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে না। এখানে আছে শুধু অন্তরের ইচ্ছা এবং কর্ম। আর কিছু না।

কিন্তু মানুষ লোভনীয় কিছু একটার দিকে তাকিয়ে বলতে পারে:
না, এটা অবৈধ। না, ঐটা হারাম। না, এটা করা যাবে না।

তার বিবেক-বুদ্ধি কর্মতৎপর হয়ে উঠে। সে ফলাফলের কথা ভেবে থেমে যেতে পারে। গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন, ইতোমধ্যে দেরি করে ফেলেছেন। এখন আবার রাস্তায় লাল বাতি। এমন সময়েও ভারসাম্য রক্ষা করার সামর্থ্য আপনার আছে। তাড়াতাড়ি অফিসে যাওয়ার আগ্রহ যেমন আছে, ঠিক তেমনি আইন মেনে চলার বুঝও আপনার আছে। আমরা আমাদের চিন্তা এবং আবেগের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারি। অন্য সৃষ্টির মত নয়, যারা কোনো একটা আবেগ জাগ্রত হলেই তা পূর্ণ করার জন্য ঝাঁপিয় পড়ে। তারা প্রতিক্রিয়া দেখায়।

কিন্তু, আমরা ফলাফল নিয়ে ভাবতে পারি, দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে পারি। আমরা নিজেদের থামিয়ে দিতে পারি। কুরআনে আমাদের বুদ্ধির নামও ঠিক এভাবে এসেছে। 'আল-হিজর', 'আন-নুহা'। আমাদের বুদ্ধির বর্ণনা দিতে এ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। 'হিজর' মানে শিলা, পাথর। কারণ, পাথর সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। আর 'নুহা' মানে প্রতিনিষেধ। কারণ, আমাদের বুদ্ধি আমাদেরকে বোকার মত কিছু করতে বাধা দান করে। এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

এরপর তিনি বলেন- وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ - “আর তার ভিতরে আমার রূহ ফুঁকে দেব…” (38:72)

অর্থাৎ রুহ, যা আল্লাহ বিশেষভাবে ডিজাইন করেছেন এই মানুষের জন্য, বিশেষ আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, বিশেষ জিনিস যা মানুষকে অনন্য উপায়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করবে। অসাধারণ শক্তিশালী উপায়ে। আর এ জিনিসটাই মানুষের ভেতর থাকবে। তো, এই রুহ মানুষের ভেতর থাকবে, অন্যান্য প্রজাতি বা প্রাণীদের মত নয়। বিশেষ ধরণের এক আধ্যাত্মিক আলো মানুষের ভেতর থাকবে।

সুতরাং, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে তিনটি জিনিসের সমন্বয়ে।
তাকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছে,
তাকে ভারসাম্যসহ তৈরি করা হয়েছে
এবং তাকে রুহ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

তিনটি উপাদান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন এই আয়াতে। আর তিনি ফেরেশতাদের এগুলো জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই তিনটি অংশ মানুষকে বিস্ময়কর করে তুলবে।

যখন এই তিনটি জিনিসের সমন্বয় ঘটবে فَقَعُوۡا لَهٗ سٰجِدِیۡنَ - "তখন তোমরা তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে যাও।" (৩৮ঃ ৭২)

ইবলিশ যখন আদম (আ) কে সেজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন তুমি আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করলে? সে আল্লাহর দিকে ফিরে এভাবে বলেনি-" খালাক তানি মিন নারিন, ও খালাক তাহু মিন তিইনিন, ও সাওআইতাহু, ও নাফাখতা ফিইহি মিন রুহিকা।" অর্থাৎ, আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে কাদা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন ও তার মধ্যে আপনার রুহ ফুঁকে দিয়েছেন।

সে এটা বলেনি। সে শুধু বলেছিল- আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে কাদা থেকে সৃষ্টি করেছেন। এটা শুধু তিনটা বিষয়ের একটা মাত্র। তাই না? আরও দুইটা জিনিস তো বাকি আছে। সে বাকি দুইটা সম্পর্কেও জানতো। সে 'তাসবিয়াহ' তথা মানুষের ভারসাম্য সম্পর্কে জানতো। সে মানুষের ভেতর ফুঁকে দেওয়া রুহ সম্পর্কেও জানতো।
কিন্তু ইবলিশ আল্লাহর নিকট অভিযোগ করার সময় এমনভাবে অভিযোগ করলো যেন বাকি দুইটা সম্পর্কে সে অজ্ঞ। কিন্তু সে জানে। তার পূর্ণ জ্ঞান ছিল।

বাকি দুইটা বিষয় অস্বীকার করার কারণ হলো- সে যদি অবশিষ্ট দুইটি বিষয় স্বীকার করে নেয়, তাহলে তাকে স্বীকার করতে হবে মানুষ আসলে আল্লাহর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। কিন্তু সে যদি শুধু কাদার কথা স্বীকার করে তাহলে আদম এবং একটি ঘোড়ার মাঝে আর কি পার্থক্য আছে? আদম এবং একটি গরু বা বানরের মাঝে কি আর এমন পার্থক্য আছে? তারা আহার করে, সেও আহার করে। তারা আশ্রয় খোঁজে, সেও আশ্রয় খোঁজে। তাদের বাচ্চাকাচ্চা আছে, তারও বাচ্চাকাচ্চা আছে। সে শুধু একজন বিবর্তিত প্রাণী। এটাই সব। সে দুই পায়ে দাঁড়াতে পারে। তো কি হয়েছে! এটা তো আর বড় কিছু নয়! সে শুধু একজন বিবর্তিত প্রজাতি। আর মাঝে অতিরিক্ত আর কিছু নেই।

অতএব, ইবলিশ ইচ্ছা করেই আমাদের অস্তিত্বের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে অস্বীকার করে। তিনটার মধ্যে দুইটাকে সে জেনেশুনে অস্বীকার করে। সে যদি এ দুইটা স্বীকার করে নেয় তাহলে আল্লাহর এই বিস্ময়কর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব তাকে স্বীকার করে নিতে হবে।

এই প্যাসেজ থেকে যে একটি জিনিস আমরা শিখতে পারি, কুরআনের এই আয়াতগুলো থেকে তা হলো- ইবলিশ চায়নি মানুষ কোনোদিন মূল্যবান কিছু হিসেবে স্বীকৃতি পাক। তার সবচে বড় সফলতা, তার সবচে মহান সফলতাগুলোর একটি হলো- সে যদি আমাদের বুঝাতে সক্ষম হয় যে, আসলেই আমাদের কোনো দাম নেই। স্ব-মূল্য তথা নিজেকে দাম দেয়া, মানুষ হিসেবে নিজেকে সম্মান দেয়া আজকের দুনিয়ার অন্যতম একটি বড় সংকট।
আমি আর আপনি এই পৃথিবীতে আসার আগেই আমাদের পিতাকে যা দেয়া হয়েছিল, তার সন্তান হিসেবে আমাদেরকেও সেগুলো দেয়া হয়েছে। তিনটি জিনিস- মাটি থেকে আমাদের শরীর, তাসবিয়া তথা ভারসাম্য এবং আমাদের রূহ। [ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ طِیۡنٍ - স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করব।’ فَاِذَا سَوَّیۡتُهٗ وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ فَقَعُوۡا لَهٗ سٰجِدِیۡنَ - যখন আমি তাকে ভারসাম্যপূর্ণ করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিবো, তখন তোমরা তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে যাও’। ]

আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টির উপর আমাদের সম্মানিত করেছেন। সকল সৃষ্টি আমাদেরকে আল্লাহর একটি মিরাকল হিসেবে দেখে। ফেরেশতাদের সেজদা পাওয়ার যোগ্য আল্লাহর এক সম্মানজনক সৃষ্টি! আল্লাহর বিস্ময়কর এক সৃষ্টি!

এখন মহাকাশের ফেরেশতারা আপনাকে দেখে মুগ্ধ! চমৎকৃত! কিন্তু আপনি নিজের মাঝে মুগ্ধ কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পান না। নিজেকে আপনার মূল্যহীন মনে হয়।

- নোমান আলী খানের আলোচনা থেকে

পঠিত : ৩১৭ বার

মন্তব্য: ০