Alapon

"নারীদের কণ্ঠস্বর কি সতরের অন্তর্ভুক্ত?"



"নারীদের কণ্ঠস্বর কি সতরের অন্তর্ভুক্ত?"

"তোমরা লোকদের সাথে মিষ্টি সুরে কথা বলো না। এতে দুষ্ট মনের কোন লোক লালসায় পড়তে পারে বরং সোজা ও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলো।"
- সূরা ৩৩ আহযাব: ৩২

নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী হানাফিদের মতে, মহিলাদের কণ্ঠস্বর আওরত বা গোপন রাখার জিনিস নয়। প্রয়োজন হলে কোনো পুরুষের সাথে কথা বলতে বাধা নেই। সে কারণেই নবী করিম সা.-এর পবিত্র স্ত্রীগণ সাহাবায়ে কিরামের সাথে কথাবার্তা বলতেন। মুসলিমরা তাদের কাছ থেকে কখনো প্রয়োজন হলে ইসলামের বিধান শিখে নিতেন। অবশ্য ফিতনা সৃষ্টি হবার আশংকা থাকলে নারী কন্ঠ শোনা বৈধ নয়, তা কুরআন তিলাওয়াত এর আওয়াজ হলেও।

কোনো কোনো শাফেয়ি আলিমের মতে, সর্ব অবস্থায় নারী কণ্ঠস্বর পর পুরুষের সামনে সতরযোগ্য। ফিতনার ভয় থাকুক বা না থাকুক, তাতে কিছু যায় আসে না।
বেশিরভাগ স্কলারগণ মনে করেন, পর পুরুষের সামনে মহিলাদের কণ্ঠস্বর সতরযোগ্য নয়। তবে শর্ত হলো, কথাবার্তা সাধারন এবং প্রচলিত ধরনের হতে হবে। ফিতনা সৃষ্টি হবার ভয় থাকবে না এবং কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলা যাবে না। এ মতের পক্ষে তাঁরা যেসব দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো হলো :

১. রাসূলুল্লাহ সা.-এর পবিত্র স্ত্রীগণ রা. সাহাবায়ে কিরামের সাথে কথাবার্তা বলতেন। সাহাবীগণ তাঁদের কাছ থেকে প্রয়োজন হলে দ্বীনের বিধিবিধান জিজ্ঞেস করতেন, জেনে নিতেন।

আবু মূসা আশয়ারী রা. বলেন: "আমাদের মাঝে যখনই কোন হাদীসের বিষয় নিয়ে সমস্যা দেখা দিতো, আমরা তখন আয়েশা রা. এর কাছে তা জিজ্ঞেস করলে তার সমাধান পেয়ে যেতাম।"

২. উমর রা. যখন মোহরের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধার্য করতে চাইলেন, তখন মসজিদের শেষপ্রান্ত থেকে এক মহিলা তাঁর বিরোধিতা করেন এবং মসজিদে সবার সামনেই নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন।
وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ وَآَتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا -
অর্থ: 'তোমরা যদি একজন স্ত্রীর জায়গায় আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও, তাহলে তোমরা তাকে বিপুল অর্থ-সম্পদ দিয়ে থাকলেও তা থেকে কিছুই ফিরিয়ে নিয়ো না।' ( সূরা নিসা:২০)

৩. আবু বকর রা. এবং ফাতিমার রা. মধ্যে যখন ফিদকের বাগান নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলো, তখন ফাতিমা রা. খলিফার কাছে গেলেন। বলা হয়, ফাতিমা রা. তাঁর মত ব্যক্ত করা এবং নিজের অধিকার প্রমাণ করার জন্য সেখানে দম্ভর মতো একটি বক্তৃতাই প্রদান করেন।
এসব ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়, নারীদের কণ্ঠস্বর 'আওরত' বা লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো, সাধারণ এবং প্রচলিত কথাবার্তাই বলবে। কোমল বা মিষ্টি কণ্ঠে নয়। শুধু প্রয়োজনীয়টা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে দিবে।
.
এ তো গেল, নন মাহরামদের সাথে নারীদের কথাবার্তার স্টাইল কেমন হবে সে সম্পর্কে। এবার আসি নন মাহরামদের সামনে গান গাওয়া সম্পর্কে। পরপুরুষের সামনে গান গাওয়ার ব্যাপারে মতামত হলো-

ইমাম ইবনে হাজর আসকালানি তাঁর 'কাফফুর রিয়ায়ি আন মুহাররমাতিল লাহবি ওয়াস সিমায়ে' গ্রন্থে লিখেছেন পরনারীর গান শুনা সর্বাবস্থায় হারাম। কেননা আমাদের মযহাবে (শাফেয়ী মাযহাবে) মহিলাদের কণ্ঠস্বর আওরাত (গোপনীয়)। চাই তার ফলে ফিতনা সৃষ্টি হোক কিংবা না হোক।

ইমাম মালিক সাধারণভাবে গান গাইতে নিষেধ করেছেন। ইমাম আবু হানিফার মতে গান গর্হিত কাজ। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল সম্পর্কে তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ বলেছেন, আমি আব্বাকে গান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেন : গান অন্তরে মুনাফেকি সৃষ্টি করে। আমার কাছে গান খুবই গর্হিত কাজ।

জমহুর ফকিহগনের মতে মহিলাদের কণ্ঠস্বর আওরত (গোপনীয়) নয়। তাদের মতে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করেন তখন বনি নাজ্জার গোত্রের মহিলারা তাকে কবিতা আবৃত্তি করে সম্ভাষণ জানিয়েছিল এবং তিনি এর প্রতিবাদ করেননি।
আরেকটি ঘটনায়, এক ঈদের দিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপস্থিতিতে আয়েশার (রা.) ঘরে দু'জন বালিকা গান গেয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। এমন সময়ে আবুবকর রা. আসেন। তিনি কন্যার ঘরে ওদের গান শুনে সাংঘাতিক অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন রাসূলুল্লাহর ঘরে এসব শয়তানের কাজ করা হচ্ছে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ওদের কিছু বলো না। কারণ আজ ঈদের দিন। তবে এ দুটো দলিলের পেছনে স্কলারদের যুক্তি হলো-

বনি নাজ্জারের মহিলারা 'তালায়াল বাদরু আলাইনা'- যে গান গেয়েছিলেন, তা হিজরতের সূচনাকালের কথা। তখন পর্যন্ত হিজাবের আয়াত নাযিল হয়নি। হিজাব করার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত নাযিল হয় পঞ্চম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধের পর।
আর ঈদের দিনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঘরে দুটি মেয়ের গান গাওয়ার যে কথা বর্ণিত হয়েছে, তাদের প্রসঙ্গে হাদিসে 'জারিয়াতুন' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। 'জারিয়াতুন' বলতে এমন বালিকাদের বলা হয় যারা এখনও বালিগ হয়নি এবং যাদের উপর হিজাবের বিধান প্রযোজ্য নয়।

একটু খেয়াল করুন, যেসব স্কলার বলেছেন, নারী কণ্ঠস্বর আওরত নয়, তারাও তাদের এ মতের সাথে কিছু শর্ত যোগ করে দিয়েছেন। তা হলো, যখন ফিতনা সৃষ্টি হবার আশঙ্কা থাকবে না, এবং যেসব কথাবার্তা বলা হবে সেগুলো দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কথাবার্তা হতে হবে। কিন্তু গান দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কথাবার্তা নয়। বরঞ্চ এটা একটা শিল্পকলা। এতে ফিতনা সৃষ্টি হবার একটা আশঙ্কা থেকে যায়। এবং কন্ঠকে এখানে আকর্ষণীয়ভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
---------------------------
তথ্যসূত্র: আল্লামা মুহাম্মদ আতাইয়া খোমায়েস রচিত 'ফিকহুন নিসা' (মহিলা ফিকহ) বইয়ের 'কণ্ঠস্বরের পর্দা' অধ্যায় থেকে।

- লিখেছেন : ড. হুমায়রা

পঠিত : ৩৭৬ বার

মন্তব্য: ০