Alapon

সাইয়িদ কুতুব শহীদের রাজনীতি ও সমাজ দর্শন...



সাইয়িদের রাজনৈতিক দর্শন

সাইয়িদ কুতুব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ক্ষণিকের প্রয়োজন পুরণ মনে করতেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি ভাবতেন অবোধ্য এবং মেনে চলার অনুপযোগী। পুঁজিবাদকে আখ্যায়িত করতেন ভোগবাদিতার নিগড়ে জন্ম নেওয়া মানবমনের এক দুর্বলতর দর্শন। সমাজতন্ত্রকে তিনি কখনও মানুষ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর ও মানবপ্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ মনে করেননি। তিনি তাই ইখওয়ানের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে ব্রত হিসেবে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলামি শাসন ছাড়া মানবতা আর কোনোভাবেই মুক্তি পেতে পারে না।

সাইয়িদের সমাজ দর্শন

সাইয়িদ কুতুব মানবসমাজকে দুটো স্বতন্ত্র ও বিভাজিত রূপে দেখতেন। সাইয়িদ মনে করেন, ইসলামের দৃষ্টিতে মাত্র দুই ধরনের সমাজই হতে পারে। একটা হলো ইসলামি সমাজ— যেখানে ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও ইবাদত পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে, যেখানে জীবনযাপন ও নিয়মকানুন তথা আইন ও শরিয়ত ইসলামের দ্বারাই অনুশাসিত হবে, যেখানে আখলাক-চরিত্র ও মানুষে মানুষে মুআমালাত হবে পরিপূর্ণভাবে ইসলামের আলোকেই।

আর দ্বিতীয়টি হলো জাহিলি সমাজ— যেখানে ইসলাম দ্বারা জীবন পরিচালিত হয় না, এখানে জীবনপদ্ধতিতে ইসলামের দৃষ্টিদর্শন নেই, ইসলামের মূল্যবোধ অনুপস্থিত, ইসলামের আইন-কানুন ও শরিয়ত মেনে চলা হয় না, ইসলামি চরিত্র ও আখলাকের যেখানে স্থান নেই।

সাইয়িদ মনে করেন, মুসলিম অধ্যুষিত হলেই যে তাকে ইসলামি সমাজ বলা হবে, তা হতে পারে না; যদি না সে সমাজে ইসলামি আইন চলে। যদিও সে সমাজে নামাজ থাকে, সিয়াম পালিত হয়, হজ আদায়ের জন্য দলে দলে মানুষ মক্কা শরিফে যায়...। শরিয়ত বাস্তবায়িত না হলে গোটা সমাজ যদি আল্লাহর অস্তিত্বও মেনে নেয়, তবুও তা জাহিলি সমাজ বলে গণ্য হবে; যদি সেখানে থাকা মুসলিমরা আল্লাহর শরিয়তকে বাস্তবায়িত না করে।

তিনি এই দর্শনের আলোকেই ‘মাআলিম ফিত তারিক’ লিখেন এবং এরই ভূমিকাতে তিনি দ্ব্যর্থকণ্ঠে বলেন—
إن العالم يعيش اليوم كله في جاهلية
“আজকের সমগ্র বিশ্বই নিশ্চিতভাবে জাহিলিয়াতের মধ্যে বাস করছে।”
সাইয়িদের এই দর্শনের ব্যাপারে অনেক কথা হয়েছে, অনেক পিএইচডিও হয়েছে। ড. ইউসুফ আল কারযাভী তার এই দর্শনের একজন খুবই বন্ধুসুলভ সমালোচক। তিনি বলেছেন—

“সাইয়িদ কুতুবের এই চিন্তায় প্রান্তিকতা আছে। কারণ, এই দর্শন প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রান্তিকতায় প্রবেশ করেছেন; যার দরকার ছিল না। যেমন— তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, আমরা এখন মাক্কি স্তরে আছি। আমাদের সমাজ আর ইসলামি নেই। তাই এখন জিহাদি জযবার যেমন দরকার, দ্বীন প্রতিষ্ঠা যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার ফিকহি ইস্যুতে ইজতিহাদ বা জ্ঞান-গবেষণা ইত্যাদির পেছনে সময় না দেওয়া। তিনি এটা করতে গিয়ে আয়াতুস সাইফ বা যুদ্ধের ময়দানে ইসলামের শত্রুদের মারার আয়াতগুলোকে মৌলিক ধরে বাকি যেসব আয়াতে শত্রু নয়—এমন সাধারণ কাফিরদের সাথে সদাচরণ, মুনাফিকদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ নিয়ে কথা বলে, সে আয়াতগুলোকে মানসুখ বা রহিত মনে করেছেন— যা প্রান্তিকতাই।”

অবশ্য তার ‘নাহও মুজতামায়ি ইসলামি’ বইয়ের মধ্যে তিনি ইসলামি সমাজ বিনির্মাণের যেসব মূলনীতি দিয়েছেন, তা খুবই নান্দনিক ও ভারসাম্যপূর্ণ। তা হলো— কুরআনভিত্তিক সমাজ হতে হবে, যেখানে ইসলামি নীতিমালার প্রতি থাকবে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। সমস্ত কাজকর্মে থাকবে তাওহিদের প্রকাশ, ঐক্যের প্রতিচ্ছবি। সেখানে ঈমান হবে মানুষ চেনার মূল ভিত্তি; বংশ, ভাষা, জাত বা আর কিছুই নয়। এই সমাজের কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা থাকে না; এটা হয় বৈশ্বিক। মানুষ তার মানবিক মূল্যবোধ ও স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করে। এখানে থাকে না মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, থাকে না সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার ক্ষেত্রে কোনো বংশীয় বা গোত্রীয় টান। এই সমাজে কখনও বেকারত্ব আশা করা যায় না, ফলে কাজে লাগানো হয় প্রতিটি মানবসম্পদ।

পঠিত : ১০৬৪ বার

মন্তব্য: ০