Alapon

কারবালা প্রান্তরে...



কারবালা প্রান্তরে...
- হাসান বিন হাশেমী।

♦ঘটনার সূত্রপাত:
হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর শাসনামলের শেষ দিকে তার কিছু খাস লোক তার মৃত্যুর পরে যাতে খলিফা নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা না হয় তাই তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে ইয়াযিদের হাতে অগ্রীম বাইয়াত গ্রহণ করার পরামর্শ দিল। কুফা থেকে ৪০ জন বিশিষ্ট লোক এসে একই পরামর্শ দিল। তখন পর্যন্ত ইয়াযিদকে সবাই ভাল মানুষ হিসেবেই জানতেন। তাই আমীরে মুয়াবিয়া তাদের পরামর্শ নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করলেন। এবং তাদের পরামর্শ মোতাবেক বাইয়াত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। ফলে কুফা, বসরা, সিরিয়া ও ইরাকের অনেকেই তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

♦মদীনায় মুয়াবিয়া রাঃ:
আমীরে মুয়াবিয়ার আদেশানুসারে মদীনার গভর্নর মারওয়ান মদীনাবাসীদেরকে ইয়াযিদের বাইয়াত গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু তারা তারা তা অস্বীকার করে। ফলে হিজরি ৫১ সনে মুয়াবিয়া রাঃ নিজেই মদীনা চলে আসেন। এবং আম্মাজান আয়েশা রাঃ, হোসাইন রাঃ, আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রাঃ সহ আকাবেরে সাহাবার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু ফল পরিবর্তন হয়না। সবাই একবাক্যে অস্বীকারই করেন। মুয়াবিয়া রাঃ এর চাপাচাপির কারণে আকাবেরে সাহাবা মক্কায় হজ্জ করতে চলে আসেন।

♦মক্কার পথে:
এখানেও মুয়াবিয়া রাঃ আসেন। এবং হযরত হোসাইন রাঃ, আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন আবু বকর রাঃ প্রমূখের সাথে আবারো কথা বলেন। তখন তারা আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ কে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের তিনটি পদ্ধতি বাতলে দেন।

♦তিনটি পরামর্শ:
ক, নবী সাঃ এর পদ্ধতি। তথা এখন কাউকে খলিফা না বানানো। বরং মুয়াবিয়া রাঃ এর মৃত্যুর পর উপস্থিত জনতাই তাদের খলিফা নির্বাচন করবে।
খ, আবু বকর রাঃ এর পদ্ধতি। তথা অনাত্মীয় ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য কাউকে আমীর বানানো।
গ, ওমর রাঃ এর পদ্ধতি। তথা এই নির্বাচনের জন্য ৬ জনের প্রতিনিধি দল গঠন।
এ পরামর্শ দিয়ে তারা বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করেন।

♦মুয়াবিয়া রাঃ এর মৃত্যু:
ইত্যবসরে আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ মৃত্যু বরণ করেন। তবে তিনি মৃত্যুর আগে ইয়াযিদকে হোসাইন রাঃ সহ আহলে বাইতের সাথে সদাচরণ করতে বিশেষ অসিয়ত করে যান।


♦ইয়াযিদি শাসনামলে মদীনা:
ইয়াযিদের সময় মদীনার গভর্নর ছিলেন ওয়ালীদ ইবনে ওকবা। তিনি হোসাইন রাঃ এর প্রতি মুগ্ধ ছিলেন। ইয়াযিদ তাকে বাইয়াত নেওয়ার জন্য আহলে বায়তের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে নির্দেশ দেন। ওয়ালীদ আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ও হোসাইন রাঃ কে ডেকে পাঠান। কিন্তু তারা "গভর্নর হাউসে নয় বরং জনসম্মুখে বাইয়াত নিয়ে যা বলার বলবেন" বলে কৌশলে বের হয়ে মক্কায় চলে আসেন। বাইয়াত গ্রহণ করতে না পারায় ইয়াযিদ ওয়ালীদকে সরিয়ে আমর বিন সায়ীদকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন।


♦হোসাইনের কাছে কুফাবাসীর চিঠি:
কুফা বাসী হোসাইন রাঃ কে কুফা আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র লিখতে থাকেন। এবং তারা এও জানান যে, তারা হোসাইনের হাতে বাইয়াত নেবেন। এমনকি তারা এ বিষয়ে হোসাইনকে রাজি করাতে প্রতিনিধি দলও পাঠায়। তখন হোসাইন রাঃ তার চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে একটি পত্র লিখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পাঠান।


♦মুসলিম বিন আকীলের আবির্ভাব:
সে সময়ে কুফার গভর্নর ছিলেন নোমান বিন বাশীর। মুসলিম কুফায় গিয়ে দেখলেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনুকুল। অধিকাংশ মানুষ ইয়াযিদের বিপক্ষে এবং হোসাইনের পক্ষে। তিনি নিজেই হোসাইনের পক্ষে ১৮০০০ মানুষের বাইয়াত নিয়েছেন। এবং চিঠি লিখে হোসাইনকে কুফা আসতে বলেন।

♦অবস্থার পরিবর্তন:
ইত্যবসরে কিছু দুষ্ট লোক মুসলিম বিন আকীলের বিষয়ে ইয়াযিদকে অবহিত করলে ইয়াযিদ কুফার গভর্নর নোমান বিন বাশীরকে হটিয়ে তদস্থলে আব্দুল্লাহ বিন যিয়াদকে দায়িত্ব দেন। বিন যিয়াদ কুফায় এসে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলিমকে শহীদ করেন। তখন অবস্থার এতোটা পরিবর্তন হয়েছিল যে, মুসলিম বিন আকীলের সাথে তার নিজ হাতে গঠিত ৪০০০ সৈন্যের কেউ ছিলনা। আর আঠারো হাজার বাইয়াত গ্রহণকারীতো আগেই ভয়ে চুপসে গিয়েছিল।

♦হোসাইনের কুফা আগমন:
মুসলিম বিন আকীল দ্বিতীয় বার পত্র পাঠিয়ে হোসাইনকে কুফা আসতে নিষেধ করেন। তাছাড়া ইবনে আব্বাস রাঃ সহ অনেকেই তখন তাকে বারণ করেন। কিন্তু হোসাইন অনড়। তিনি আসবেনই। ৬০ হিজরির ৩/৮ জিলহজ্জ তিনি কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। পথিমধ্যে বিখ্যাত আরব কবি ফারাযদাকের সাথে তার দেখা হয়। তিনি পরিস্থিতি জানতে চাইলে কবি বলেন, কুফা বাসীর অন্তর আপনার সাথে কিন্তু তাদের তলোয়ার বনু উমাইয়ার সাথে।
তখন আব্দুল্লাহ বিন জাফর মক্কা ও মদীনার গভর্নর আমর বিন সায়ীদের কাছ থেকে নিরাপত্তা সনদ নিয়ে হোসাইনকে ফিরে আসতে বলেন। কিন্তু নবী সাঃ কে স্বপ্নে দেখার কথা বলে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

♦এগিয়ে চলছে কাফেলা:
'হাজর' নামক স্থানে পৌঁছে তিনি চিঠি লিখে কুফাবাসীদের তাদের কৃত ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং সমর্থন প্র‍ত্যাশা করেন।
'সায়ালাবিয়া' নামক স্থানে পৌঁছে তিনি মুসলিমের শাহাদাতের খবর পান। তখন তিনি প্রথমবারের মত পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করেন। কিন্তু ততক্ষণে মুসলিমের গোত্র বনু আকীল মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ নিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
এ সময় হোসাইন রাঃ তার সাথীদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু সবাই তার সাথে থেকে যায়। পথিমধ্যে তারা 'যিয়ালা' ও 'ওকবা' নামক স্থান অতিক্রম করেন।

♦হুর বিন যিয়াদের আগমন:
ইবনে যিয়াদের আদেশে হুর বিন যিয়াদ ১০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে হোসাইন রাঃ কে মোকাবেলা করতে আসেন। যখন তাদের সাক্ষাৎ হয় তখন জোহরের নামাজের সময় হয়ে যায়। তখন তারা সবাই হযরত হোসাইনের পেছনে (যুদ্ধের নামাজ) জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন। হোসাইন রাঃ তখন ফিরে যেতে চাইলে হুর তাকে বিন যিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন৷ তবে হুরের মনে আহলে বায়তের প্রতি ভালবাসা ছিল। তাই সে হোসাইন রাঃ কে রাষ্ট্রীয় আদেশের কারণে ফিরে যেতে না দিলেও তার সাথে সদ্ব্যবহার করতে থাকে।

♦কাদেসিয়ার পথে:
কাদেসিয়া'র পথ ধরে এগিয়ে চলে হোসাইনি কাফেলা। 'নাযরে বনী মোকাতিল' নামক স্থানে পৌঁছে তিনি তাদের শাহাদাতের স্বপ্ন দেখেন। এ স্বপ্নে তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গেলে তার সাহেবজাদা আলী আকবর তাকে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে বলেন।
এ সময় ইবনে যিয়াদের এক দূত এসে হুর বিন যিয়াদকে একটি চিঠি দেন। যাতে লেখা ছিল, 'পত্র পাওয়া মাত্রই তুমি হোসাইনের পৃথিবী সংকীর্ণ করে দেবে।" এর অব্যবহিত পরেই বিন যিয়াদ ওমর বিন সাদের নের্তৃত্বে ৪০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। তবে ওমরও হোসাইন রাঃ কে সম্মান করতেন।
হোসাইন রাঃ ওমরের কাছে মদীনায় ফিরে যেতে চাইলে ওমর আব্দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের কাছে অনুমতি চান। ইবনে যিয়াদ সাফ জানিয়ে দেন, হোসাইনের একটাই পথ- ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ।

♦পানির কষ্ট:
এ সময় ইবনে যিয়াদের আদেশে হোসাইনদের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন হোসাইনের ভাই আব্বাস বিন আলী ওমর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বহু কষ্টে ২০ মশক পানি আনতে সক্ষম হন।

♦তিনটি প্রস্তাব:
এহেন পরিস্থিতিতে হোসাইন রাঃ পূণরায় ওমর বিন সাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তিনটি প্রস্তাব দেন।
ক, মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি।
খ, সরাসরি ইয়াযিদের কাছে যাওয়ার সুযোগ ও
গ, কোন মুসলিম দেশের সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া।
( কিছু ঐতিহাসিক অবশ্য শেষের দুটি প্রস্তাবের কথা অস্বীকার করেছেন।)
ওমর বিন সাদ ইবনে যিয়াদের কাছে এ বিষয়ে জানালে ইবনে যিয়াদ প্রথমবারের মত নরম হন এবং রাজিও জন। কিন্তু তার সভা সদস্য শমর / শীমারের পরামর্শে তাঁকে সোজা তার কাছে নিয়ে যেতে বলেন।

♦স্বপ্নে নবী সাঃ :
শমর ৯ই জিলহজ্জ ইবনে যিয়াদের এই আদেশ নিয়ে হোসাইনের কাছে আসেন। এ সময় হোসাইন নবী সাঃ কে স্বপ্নে দেখেন। নবী সাঃ তাকে বলছিল, " তুমি শীঘ্রই আমার কাছে আসছ।" এ স্বপ্নের কথা শুনে তাঁর বোন যয়নব কেঁদে ওঠেন।
ইতোমধ্যে শমর ও ওমর যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলে। হোসাইন রাঃ ইবাদতের জন্য এক রাত চেয়ে নেন।

১০ জিলহজ্জ। ইয়াওমুল আশুরা। শুক্রবার / শনিবার।
হোসাইনী কাফেলায় ছিল ২২ জন অশ্বারোহী ও ৪০ জন পদাতিকসহ মোট ৭২ জন। ঠিক এমন সময় হুর বিন যিয়াদ হোসাইনের পক্ষাবলম্বন করেন।

♦পাষণ্ড শীমার:
১০ তারিখ সকালে হোসাইন রাঃ শত্রু শিবিরকে লক্ষ্য করে একটি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এমন সময় শমর তাঁর বুকে তীর নিক্ষেপ করে।

♦যুদ্ধ শুরু:
ব্যস শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড যুদ্ধ। অনেকেই শহীদ হলেন। কিছু মানুষ নিহত হল। কিন্তু সরাসরি হোসাইন হত্যার দায় নিতে চাইছিলনা বলে কেউ তাঁকে আঘাত করার সাহস পায়নি।

♦হোসাইনের শাহাদাত:
এ সময় হোসাইন তৃষ্ণাতুর হয়ে পরলে ফোরাত নদীর তীরে যান। তখন শমর ১০ জন সৈন্য নিয়ে হোসাইনের ওপর সম্মিলিত আক্রমণ চালায়। ফলে হোসাইন রাঃ শাহাদাত বরণ করেন। হোসাইনের শরীরে তখন ৩৩ টি তীরের আঘাত ও ৩৪টি তরবারির আঘাত ছিল। এবং তাঁর মৃতদেহ ঘোড়ার খুড় দিয়ে পিষ্ট করা হয়। নাউজুবিল্লাহ।
হোসাইনী কাফেলার ৩৩ জন আহলে বায়তসহ ৭২ জনই শাহাদাত বরণ করেন।

♦কর্তিত শির মোবারক:
শমরের আদেশে সিনান বিন আনাস হোসাইনের মাথা দ্বিখণ্ডিত করে। কর্তিত শির নিয়ে যাওয়া হয় ইবনে যিয়াদের কাছে। সে তাঁর শির মোবারক ও আহলে বায়তের মহিলা ও শিশুদের ইয়াযিদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

♦ভিন্ন রকম ইয়াযিদ:
কিন্তু ইয়াযিদ ও তার স্ত্রী হিন্দা এ দৃশ্য দেখে এবং সামগ্রিক ঘটনা শুনে খুবই মর্মাহত হলেন। এবং কেঁদে দিলেন। তিনি বললেন, "আমিতো শুধু গ্রেফতার করতে বলেছিলাম, হত্যা করতে নয়।"

অবশ্য ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেন, পথের কাঁটা চিরতরে সরে যাওয়ায় ইয়াযিদ সামগ্রিক ভাবে আনন্দিতই হয়েছিল। তবে আহলে বায়তের সাথে ইয়াযিদ যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার করেন। আলী আকবর বিন হোসাইন, আমর বিন হোসাইন, ফাতিমা ও সাকিনা বিনতে হোসাইন, যয়নব বিনতে আলী প্রমূখকে সসম্মানে মদীনায় পৌঁছে দেন।

♦হোসাইন রাঃ এর স্ত্রী:
হোসাইন রাঃ এর স্ত্রী রিবাব বিনতে ইমরুল কায়েস স্বামী শোকে এই ঘটনার এক বছরের মাথায় ইন্তেকাল করেন।
হোসাইনের শাহাদাতের পর এই এক বছরে রিবাবকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি বলতেন, "আমি নবী সাঃ এর পর অন্য কাউকে শ্বশুর হিসেবে গ্রহণ করতে রাজী নই।"

♦শেষ পরিণতি:
হোসাইনের শাহাদাতের পর ইয়াযিদ মাত্র দুই বছর আট মাস মতান্তরে তিন বছর আট মাস ক্ষমতায় ছিল। এরপর আজ অবধি ইয়াযিদের বংশে আর কেউ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি।

--- হাসান বিন হাশেমী।
( মুফতী শফী রঃ এর 'শহীদে কারবালা' অবলম্বনে। )

পঠিত : ৯১৪ বার

মন্তব্য: ০