Alapon

ইসলামী রাজনীতি নাকি গণ-রাজনীতি? : একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা



এক বিতর্কে দেখলাম, দাওয়াতে দ্বীন ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা চলছে। দুই পক্ষেই আছেন শিবিরের সাবেক দুই সদস্য। একজন সদস্য গণ-রাজনীতির আলাপ তুলেছেন। তিনি সেবা বা মানুষকে সার্ভিস দেয়ার মাধ্যমে ইসলামী দলকে ক্ষমতায় দেখতে চান।
আরেকজন বলছেন, এমন দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে পড়লে আখেরে আদর্শেরেই ক্ষতি। কারণ, এতে করে যিনি তুলনামূলক বেশি সেবা দিতে পারবেন, মানুষ শুধু তাকেই ভোট দেবে। এটা না করে মানুষকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহবান করুন। এর মাধ্যমে মানুষকে কনভিন্স করুন। এতে করে তারা আদর্শের ছায়াতলে আসবে। পরবর্তীতে মানুষ আদর্শ দেখে যেকোনো ব্যক্তিকে নির্বাচিত করবে।

পালটা উত্তরে প্রথমজন বা প্রথম গ্রুপ এটা প্রায় সময়ই বলেন যে, আমাদের দাওয়াত অব্যাহত আছে। আমরা মানুষকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহবান করছি। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা এই স্ট্যান্ড গ্রহণ করছি। তার ভাষায় এটি নিউ ব্রান্ড ইসলামী রাজনীতি।
আপাতত তাদের উভয়পক্ষের কারও মতামত গ্রহণ বা বর্জন কোনোটাই না করে বলছি— ‘দাওয়াতে দ্বীন’ নিয়ে এখনও নিউ ব্রান্ড পলিটিশিয়ানরা প্রাইমারি শিক্ষাও গ্রহণ করতে পারেননি। যদি অন্তত ‘হাকীকত সিরিজ’ই তারা মনোযোগের সাথে পড়তেন, তাহলে ‘ইসলামী রাজনীতি’, ‘ক্ষমতা’ ও ‘দাওয়াতে দ্বীন’কে আলাদা করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ত না।

বস্তুত দাওয়াতে দ্বীন কী— ইসলামী পার্সপেক্টিভ থেকে এই আলোচনা পরে করব; তার আগে কিছু কথা বলে নিই। রাজনীতি, ক্ষমতা ও দাওয়াত তিনটিই توحيد‎‎, رسالات ও دعوة‎ এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রিসালাতের আহবান কী? সকল নবী-রাসূলগণ তাঁর উম্মতকে কী আহ্বান করেছেন?

আল-কুরআনের সূরা আরাফ কেউ অধ্যয়ন করলে বুঝতে পারবেন যে, আল্লাহ তায়ালা একনাগাড়ে নুহ, হুদ, সালেহ., লুত, শোয়াইব ও মুসা আলাইহিমুস সালাম একই দাওয়াত দেয়ার তাগিদ দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যকেই যে মৌলিক দাওয়াত দিয়েছেন তা হলো— یٰقَوْمِ اعْبُدُوا اللّٰهَ مَا لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَیْرُهٗ١ؕ অর্থাৎ, “হে আমার জাতি! তোমরা এক আল্লাহর বন্দেগী করো এবং তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।”

নবীদের প্রাথমিক আহবানের পর এ পর্যায়ে আমাদের মৌলিক সাহিত্য থেকে কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করি। আমি ইসলামী জ্ঞানের বিশেষ পারদর্শী কেউ নই; বরং আমি তাই বলছি, যা আমাকে ছাত্রশিবির ও জামায়াতে ইসলামী শিখিয়েছে। এই যে আমাদের ভাইয়েরা বলছেন, ‘দাওয়াতে দ্বীনের কাজ তো আমরা করছিই। রাজনীতিটা শুধু রাজনীতির ভাষায় এবং নির্বাচনটা শুধু নির্বাচনের ভাষায় করতে চাই। দাওয়াত তো ঠিকই এক আল্লাহর দিকেই দেবো।’ আগে বলে নিই, রাজনীতির ভাষায় রাজনীতি এবং সেবা দিয়ে রাজনীতি ও নির্বাচনের ভাষায় নির্বাচন অন্য সকল সেক্যুলার ও বস্তুবাদী দল করতে পারে এবং করে বটে; কিন্তু নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শিক কোনো দল করতে পারে না। এটা মওদূদী রহ. , গোলাম আযম রহ. এবং বর্তমান জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও লেখনী থেকে প্রমাণিত সত্য।

দাওয়াতে দ্বীন ও রাজনীতি কি বিভক্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে কাজ চলবে নাকি একই নেতৃত্বের সাথে কেন্দ্রীভূত থাকবে? বস্তুত আমাদের দাওয়াতই রাজনীতি, দাওয়াতই ক্ষমতা দখলের পথ, দাওয়াতই হলো জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। সকল নবী-রাসূলগণ যখনি এসে এই দাওয়াত দিয়েছেন যে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই’ তখনি গদী/চেয়ার/ক্ষমতা ও সরকার থেকে হুমকি এসেছে। ফেরাউন ও মুসা আ. এর দুটি বাক্য বিনিময় থেকে তা একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
মুসা আ. ফেরাউনকে বললেন, “হে ফেরাউন! আমি বিশ্বজাহানের প্রভুর নিকট থেকে প্রেরিত।’’ এটা সূরা আরাফের ১০৪ নাম্বার আয়াতের কথা। ঠিক ছয় আয়াত পরেই ১১০ নাম্বাত আয়াতে এর উত্তরেই ফেরাউন তার নেতৃবৃন্দকে বলছে, “(মুসা) তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বে-দখল করতে চায়।”

দাওয়াত যদি শুধু মধুমাখা, নিরামিষ দাওয়াত হতো, তাহলে দাওয়াতের আহ্বান দেয়ার সাথে দেশ বেদখল হওয়ার আশঙ্কা এলো কোথা থেকে? তার মানে দাওয়াতই জিহাদ, দাওয়াতই রাজনীতি, দাওয়াতই পাওয়ার পলিটিক্স ও ক্ষমতা দখলের মূলপাঠ। যদি কোনো দাওয়াত নবীদের অনুরূপ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত না হয়, তাহলে সেটা তো দাওয়াতই নয়। আমাদের সাহিত্যে থাকা মৌলিক দাওয়াত তো এটাই।

এবার আসুন ‘দাওয়াতে দ্বীন’ এর একটু ব্যাখ্যা জেনে নিই আমাদের উলিল আমরদের কলম থেকে। আমাদের সাহিত্য ‘কুরআন কি চাত বুনিয়াদি ইসতেলেয়্যা’, ‘দ্বীনে হক' ‘নেযামে হাকীকত’ ইত্যাদি আমাদেরকে শিক্ষা দেয় দ্বীন শব্দের। আরবীতে دين শব্দটির কয়েকটি অর্থ আছে। যার এক অর্থ হলো— প্রভুত্ব ও প্রাধান্য, শক্তি ও আধিপত্য। দুই. আনুগত্য ও দাসত্ব। তিন. প্রতিফল ও কর্মফল এবং চার. পথ, পন্থা, ব্যবস্থা ও আইন।
সূরা আলে ইমরানে যেভাবে এসেছে- ইন্নাদ্দিনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম। অর্থ— ইসলাম আল্লাহ‌র নিকট একমাত্র দ্বীন বা জীবনবিধান।

এখানে যদি ভালোভাবে খেয়াল করি, তাহলে দেখব যে, আল্লাহ বলেছেন الدِّیْنَ অর্থাৎ, একমাত্র দ্বীন। শুধু দ্বীন বলেননি। যদিও শুধু দ্বীন বললেও হয় তবুও আল্লাহ আদ-দ্বীন বলেছেন। আমরা যদি আরও সহজ করে বুঝতে চাই, তাহলে ব্যাপারটি এভাবে দাঁড়ায়।
আরবীতে যখন আমরা বলি, 'বাইতুন' (بيت) তখন এর অর্থ দ্বারায় 'একটি ঘর'। কিন্তু সেই 'বাইতুন' (بيت)-কে যদি আমরা 'আল বাইত' (البيت) বলি, তাহলে অর্থ হবে— 'ঘরটি'। অর্থাৎ প্রথমটির অর্থ— একটি ঘর আর দ্বিতীয়টির অর্থ— ঘরটি মানে এটিই একমাত্র ঘর।
ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালা এখানে বলেছেন, আদ-দ্বীন(الدِّیْنَ) মানে হলো— একমাত্র পথ। দ্বীন (دين) অর্থ পথ। যেকোনো পথ হতে পারে। আর আদ-দ্বীন অর্থ একমাত্র পথ। এখন কথা হলো— ইসলাম আমাদের জন্য 'একমাত্র পথ' কি-না? অবশ্যই একমাত্র পথ। আল্লাহ আদ-দ্বীন বলে আর কোনো পথের সুযোগ রাখেননি।

প্রশ্ন হলো, যদি ইসলাম একমাত্র পথ হয়ে থাকে, তাহলে তো সেইপথে সবকিছুই বিদ্যমান থাকবে। হ্যাঁ, ইসলামের সবকিছুই আছে। ইসলামে আনুষ্ঠানিক ইবাদাত ছাড়াও আছে রাজনীতি, আইন, বিচারনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, জীবনব্যবস্থা, দর্শন-ধ্যাণ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, যুদ্ধ ও সন্ধি, আন্তর্জাতিক নীতি সহ সবকিছুই ইসলামে আছে।
তাহলে দেখা গেল— ‘দাওয়াতে দ্বীন’ শুধু কথিত নিরামিষ চর্চা নয়। আমাদের দাওয়াত মানেই হলো আদর্শের দিকে আহ্বান করে অসৎ ও ফাসিক নেতৃত্ব খতম করে সৎ নেতৃত্ব কায়েম করা। মূলত নবীদের কাজই হলো এটি।

এখন আসুন বর্তমান নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর বড়ো মাপের একটি মূলনীতি হলো— কেউ নিজে প্রার্থী হতে চাইলে সে প্রত্যাখ্যাত। আদর্শ ও সৎ নেতৃত্ব দেখে মানুষ স্বয়ং স্বতঃফূর্তভাবেভাবে যখন তাদের নেতা নির্বাচন করতে চাইবে, কেবল তখনি সেই ব্যক্তিকে সংগঠন শর্তসাপেক্ষে প্রার্থীতা দেবে। বরং এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর পরিভাষা হচ্ছে ‘নমিনি’, অর্থাৎ, যাকে মনোনীত করা হয়েছে, সে প্রার্থী নিজে নিজে হয়নি।
আর যারা বলেন, দাওয়াত তো দিচ্ছিই। রাজনীতি শুধু অন্যভাবে করছি; কারণ, আদর্শ দিয়ে ক্ষমতা হবে না, পাওয়ার পলিটিক্স হবে না। এরা হলেন Poland, sweden এর Welfare state এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী Pro-people বা People oriented politician, যার সাথে ইসলাম ও সংগঠনের থিওরির ন্যূনতম সম্পর্ক নেই।

আর আমরা যখন বলি— আদর্শের দাওয়াত দিন, আল্লাহর দাসত্ব শেখান, রাজনীতিকে দ্বীনের (যে ব্যাখা উল্লেখ করলাম, সে ব্যাখ্যার) অনুবর্তী করুন। তখনি তারা বলেন, দাওয়াহর বিপক্ষে আমাদের দাঁড় করাবেন না। আমরা দাওয়াহর পক্ষে। মানে বোঝাতে চান, আমরা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে। কারণ, জামায়াত কর্মীদের মনও তো রাখতে হবে। মূলত, তারা এভাবে আগারটাও খেতে চান এবং তলারটাও কুড়াতে চান।

আসলে আপনারা দেখলেন, ইসলাম ও আমাদের সাহিত্য অনুযায়ী ঐ গ্রুপের না আছে নৈতিক অবস্থান, না আছে ইসলামী রাজনীতির শিক্ষা। আর যারা ইসলামী রাজনীতিকে বুনিয়াদি ভিত্তি থেকে ঘুরিয়ে অন্যদিকে ডাইভার্ট করবেন, তারা সীমালঙ্ঘনকারী। কেউ সীমালঙ্ঘনকারীর সাহায্যকারী হবেন না। সীমালঙ্ঘন করা মাত্রই তার হাত টেনে ধরতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা, ইসলামের দাওয়াত ও ক্ষমতার জ্ঞান সঠিকভাবে দান করুন। আমীন।

পঠিত : ৯৮৭ বার

মন্তব্য: ০