Alapon

ডান-বামের রঙ্গালয় (০১)



"... পাকিস্তানের বিদেশ নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ দক্ষিণ ও বাম ঘেঁষা ধারায় বিভক্ত হয়ে দু’দিকে চলে গেলাে, দক্ষিণ ধারাটি আওয়ামী লীগ থাকলাে, বাম ধারাটি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, সংক্ষেপে ন্যাপ হলাে, মওলানা ভাসানী বাম ধারার দিকে চলে গেলেন। এ বিভক্তির নির্ভেজাল দক্ষিণ ধারাটি আওয়ামী লীগ নামে থাকলাে, আওয়ামী লীগ দক্ষিণ ফরম্যাটে পুনর্গঠিত হলাে এবং এর লক্ষ্য নিবদ্ধ থাকলাে ওয়াশিংটনের সাদা ভবনের দিকে। প্রাথমিক পর্যায়ে সাদা ভবনের শুভেচ্ছা সংকেত নিয়ে একাত্মবােধক পাকিস্তানে, বিশেষত পূর্বাঞ্চলে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হলাে, এর বিকাশটি শুভেচ্ছা গ্রহণের উপর নির্ভরশীল হলাে। পুরােপুরি বুর্জোয়া বিকাশের পথ অনুসরণ করে এ পার্টির জন্ম ও যাত্রা ছিলাে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার উৎস সন্ধানে। ফলে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বুর্জোয়া প্রতিযােগিতা, কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা যত প্রত্যক্ষ হলাে ততই এ পার্টি পূর্বাঞ্চলের নতুন প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান মনােযােগ আকর্ষণ করলাে, নতুনতর প্রজন্মগুলাে এ পার্টির সামনের সারিতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকলাে।

আন্তর্জাতিক অক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মার্কিনের প্রতি এ পার্টির প্রশ্নহীন সমর্থন ছিলাে, এদিক দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গেও এটা অভিন্নলক্ষ্য ছিলাে। ষাটের দশকে আওয়ামী লীগকে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগের পরই মার্কিনের দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ব্যুহ মনে করা হলাে, এ প্রতিরক্ষা ছিলাে আন্তর্জাতিক সমাজবাদ বিকাশের বিরুদ্ধে। পূর্বাঞ্চলে প্রতিপক্ষ ধারণা সৃষ্টি হতে থাকলাে বাম কিংবা বাম ঘেঁষা রাজনীতির মধ্যে, মওলানা ভাসানী যাকে উত্তরীয় দিয়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন। পাকিস্তান একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাে; কিন্তু পশ্চিমাংশের মত বড়াে সামন্ত সমর্থন পূর্বাঞ্চলে ছিলাে না। দুই অঞ্চলের সমাজ কাঠামােতে মিশ্ররূপের কারণে আন্তর্জাতিক পশ্চিমা স্বার্থে এখানে জাতীয় পুঁজির বিকাশের জন্য অবকাশ সৃষ্টি করা হলাে, লক্ষ্য ছিলাে নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এ জাতীয় পুঁজি কিংবা ধনতান্ত্রিক বিকাশের মধ্যে আপন আশ্রয় নীড় অনুসন্ধান করে নিতে পারবে। ধারণা করা হলাে, ধনতান্ত্রিক বিকাশের সঙ্গে তাদের স্বার্থ এমনভাবে জড়িত হয়ে উঠবে যাতে তারা পুঁজিবাদী কিংবা ধনতান্ত্রিক পাকিস্তানের সবচেয়ে বড়াে নির্ভর হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এ তত্ত্বের মােড়ক পরে মুসলিম লীগের মধ্য থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। ফলে মুসলিম পরিভাষা বিচ্ছিন্ন হলেও মুসলিম লীগদের ঘরের নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগের শরীরে, এর ধমণীতে নতুন শক্তি, নতুন প্রেরণা সঞ্চার করলাে। সেদিক দিয়ে আওয়ামী লীগ এ পর্যায়ে মুসলিম লীগেরই সম্প্রসারণ ছিলাে, আশা করা হলাে, আকাঙ্ক্ষা হলাে মুসলিম লীগ যেখানে পৌঁছাতে পারেনি আওয়ামী লীগ সেখানে গিয়ে উপনীত হতে পারবে, যে সীমাবদ্ধতা মুসলিম লীগের ছিলাে তা আওয়ামী লীগের থাকবে না।

তত্ত্বের গাণিতিক নির্ভুলতা ছিলাে তা নয়, তবে শুভঙ্কর হিসাব করে যেখানে যা মিলিয়ে দেয় সেখানে অনেক বড়াে ফাঁকিও চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে মার্কিনী স্বার্থের, মার্কিনী তত্ত্বের সবচেয়ে বড়াে নির্ভর ছিলাে আওয়ামী লীগ, বুর্জোয়া রাষ্ট্র কৌশলটি তাদের জানা ছিলাে, আয়ত্তে ছিলাে, মার্কিনী সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী লীগ বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন ছিলাে, কেবল তাই নয়, এ রাজনীতির তারাই সবচেয়ে বড়াে প্রতিপক্ষ ছিলাে, এমন কি মুসলিম লীগ যেখানে বাম রাজনীতির প্রতি উদাসীন ছিলাে সেখানে আওয়ামী লীগের কোনাে ঔদাসীন্য ছিলাে না। বুর্জোয়া প্রাতিষ্ঠানিকতাগুলাে তাদের এমনভাবে আয়ত্তে ছিলাে, একে অধিকারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলাে যাতে কোনাে প্রকারে তার মধ্যে বাম রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে। একই সঙ্গে তারা জনপ্রিয় প্রাতিষ্ঠানিকতাগুলাে সামনে রেখে বাম বিপ্লবকে ঠেকিয়ে রাখার প্রয়াসে নিবেদিত হলাে॥"

— বদিউজ্জামান / মুসলিম মধ্যবিত্তের রাজনীতি ॥ [ ইউপিএল - ১৯৯৭ । পৃ: ৫২-৫৩ ]

পঠিত : ৮৬২ বার

মন্তব্য: ০