Alapon

একজন আদর্শ বাবা এবং কিছু কথা...



বাবু শুধু একজন মানুষ নন, স্রেফ একটি সম্পর্কের নাম নয়! বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবী প্রকাশ!

বাবাকে নিয়ে লিখতে বসলে কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে কিন্তু কথা শেষ হবেনা। প্রতিটি সন্তানের কাছেই বাবা একটি বৃক্ষের মতো! বাবার ছায়া,শেষ বিকেলের বট বৃক্ষের ছায়ার চাইতেও বড়। যিনি তার সন্তানকে জীবনের সব উত্তাপ থেকে সামলে রাখেন।

পৃথিবীর সব বাবা ই শ্রেষ্ঠ বাবা। তাদের গল্পগুলো ও হয় অন্যরকম। আর আমার বাবার গল্পটাও একটু ভিন্নরকম। ভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের বেড়ে উঠা। পাশের রুমে আম্মু গুনগুনিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। আমরা চার ভাই বোন যে যার রুমে ঘুমানোর জন্য লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছি; এমন সময় আব্বু এলেন বাহির থেকে।
এসে আম্মুর পাশে বসলেন।

___আচ্ছা তুমি যে গুনগুন করে তিলাওয়াত করছো এগুলোর অর্থ বলতে পারবে? তুমি যে আয়াতটা এখন পড়তেছো সেটারই অনুবাদ আমাকে বলো!

আম্মুঃ সারাদিন কোনো খোঁজ খবর নাই এখন আসছে আমার পড়ার সময় ডিস্টার্ব করতে!
আমি এখন কিছুতেই বলবো না!
আব্বু ঃ তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত বলবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এখান থেকে উঠবোনা!
আমরা কেউই হাসি দমিয়ে রাখতে পারলাম না। সবাই হি হি করে হেসে দিলাম।
আম্মু এবার হার মানলেন ; আচ্ছা আমি কি মাদ্রাসায় পড়েছি? আমি কি সব জানি? যা পড়ি তা অর্থসহ পড়ার চেষ্টা করি কিন্তু এখন আমার তিলাওয়াতের সময়, অর্থসহ পড়ার সময় না।
আব্বু ঃ আচ্ছা বুঝলাম ; এখন যেখানে আছো সেখান থেকে শুরু করো।
আম্মু পড়ছেন আর আব্বু অর্থ সহ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে কখন যে রাত দুপুর হয়ে গেল কেউই খেয়াল করিনি। অবশেষে আব্বু আম্মু পড়া শেষ করে ঘুমুতে গেলেন।

আর মনে হচ্ছিল জান্নাতি ফল্গুধারা আমাদের ভাঙা ঘরটায় নেমে এলো! রহমতের বারিধারায় আমাদের প্রতিটি প্রাণ যেন সিক্ত হয়ে এলো!
আলহামদুলিল্লাহ।

দাম্পত্য জীবনের প্রায় ৩০ বছর! প্রতিটি সম্পর্কেই ঝগড়াঝাটি হয়, মনোমালিন্য হয়।কিন্তু আমার আব্বু আম্মুকে কখনোই ঝগড়া করতে দেখিনি। কোনো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হতে দেখিনি। তাদের সম্পর্কে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই। আব্বু যা বলবেন আম্মু তাই মেনে নিবেন। আব্বুর পরামর্শগুলো হয় সব আম্মুর সাথে।

দুজনেই তাহাজ্জুদের সময় উঠে নামাজে দাঁড়ান। আব্বু ইমাম আর আম্মু মুক্তাদী।
নামাজ শেষ করে শুরু হয় দুজনের কথার ফুলঝুরি।
আমাদের ঘুম ভেঙে যায়।

আব্বু ডেকে বলেন...
সবাই উঠে যাও আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম
আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম...
ঘুম থেকে নামাজ উত্তম সবাই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো।

আমরাও আর বিছানায় গড়াগড়ি করবো এমন সাধ্য নেই। তড়িঘড়ি করে সবাই উঠে পড়ি একজন আরেকজনকে জাগিয়ে দেই। আব্বু মসজিদের পথ ধরেন আম্মু ও জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন।

ছোট বেলা থেকে আজ অবধি এই নিয়মের কোনো হেরফের হতে দেখিনি।
আম্মু নানুর ছোট মেয়ে। নানু মারা যাওয়ার পর আম্মু খুব কাঁদতেন। মন খারাপ থাকতো বেশির ভাগ আম্মুকে কাঁদতে দেখলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারতামনা। আম্মু যেমন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন আমরাও আম্মুকে না দেখিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম।
এই সময়ে আব্বু আম্মুকে খুব বেশি স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তাহাজ্জুদের পর চাঁদের আলোয় দুজনে নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতেন আর আম্মুকে কবিতা শোনাতেন। রাসুলের বাণী শুনিয়ে স্বান্তনা দিতেন।

আম্মু পরে এগুলো আবার আমাদের কাছে বলতেন। কারণ বাবা মায়ের প্রতিটি কর্মই আমাদের জন্য অনুকরণীয়। তাঁদের জীবনধারায় আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা।
একদিন আব্বু আম্মু থাকবেননা কিন্তু তাদের জীবনাচার আমাদের স্মৃতিপটে রয়ে যাবে। খেজুর পাতার ছাউনি দেয়া ঘরে কীভাবে সাহাবারা জীবন পার করে গেছেন, কিভাবে নরম তুলতুলে বিছানার বদলে খেজুর পাতার চাটাই বিছিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে গেছেন আমাদেরকে সেই গল্প শোনান।

আমাদেরকে প্র্যাক্টিক্যালি শিক্ষা দেওয়ার জন্য আজো বিলাসবহুল কোনো বাড়ি করেননি।
সবাই অনেক বলা সত্বেও এখনো ভাঙা ঘরখানা মেরামত করার চিন্তা ভাবনা করেননি।
ছোট্ট একটা মাটির ঘর আর টিনের ঘরেই আমাদের জীবনপাত। টিনের চালে ফুটো হয়, বৃষ্টি এলে পানি পড়ে আমরা ভাইবোনেরা দৌড়াদৌড়ি করি কেউ বালতি নিয়ে কেউ বা পাতিল নিয়ে!

আব্বু আমার তো বিছানা ভিজে গেল! আচ্ছা এক কাজ করো আপাতত তোষকটা গুটিয়ে ফেলো। বৃষ্টি থামলে তখন বিছানো যাবে। মুষলধারে বৃষ্টি এলে সেই বৃষ্টি তো সহজে থামেনা। কি করবো?

ঘুম চোখে নিজেকে কতক্ষণ বসিয়ে রাখবো? তোষকের একটা পাশ খুলে সেখানেই কোনোমতে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়ি। ঝুমঝুম বৃষ্টি আমাদের ছোট্ট ঘরখানা ভিজিয়ে দিয়ে যায় অথচ আমরা আফসোস করিনা, রাগ করিনা, বরং আমরা উপভোগ করতে শিখে গেছি!
যাদের কিছুই নেই তাদের কষ্টকে উপলব্ধি করতে শিখেছি আমরা। যেকোনো পরিবেশে যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে টিকে থাকতে পারবো সেই শিক্ষা আমাদের দিয়ে যাচ্ছেন আজ অবধি।

আব্বু আম্মুর কথা যতই লিখি কম হয়ে যাবে। শব্দ ফুরাবে কিন্তু কথা ফুরাবে না।
নিজের ভাঙা ঘরখানা আরো ভেঙে যায়। বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখেন। আম্মু বলেন আর কত! অনেক বছর তো হলো এবার মনে হয় এটা ঠিক করা দরকার।

মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে-শাদি দিবে,নতুন জামাই কিভাবে এই ভাঙা ঘরে থাকবে?
বাবা কিছু বলেননা চুপ করে থাকেন। আমাদের চোখে পানি এসে যায় ; আচ্ছা আম্মু এই ঘরটা না ভাঙ্গলে হয়না? এখানে আমাদের কত স্মৃতি! আমাদের ছেলেবেলা, শৈশব সব তো এই ঘরেই।

আমাদের দালান কোঠার দরকার কী? জীবনের অর্ধেক এই ঘরে থেকে কাটিয়ে দিলাম বাকি জীবন কেন পারবোনা? নতুন জামাই আসলে যদি না থাকতে পারে তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। তার জীবনসঙ্গীনি যেভাবে পেরেছে সে যদি না ই বা পারে তাহলে এমন জীবনসঙ্গীর দরকার কী?

কত মানুষকে দেখেছি ব্রীজের নিচে, ফুটপাতে যারা রাত কাটায় তাদের তুলনায় তো আমরা অনেক ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।
আমাদের ঘরখানাই আমাদের কাছে এক টুকরো জান্নাত সমতূল্য!

আব্বু সাধ্য মতো গরীব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ান। অন্ন, বস্র, বাসস্থান সংক্রান্ত সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। সেই ছোটো বেলা থেকেই দেখে এসেছি আজ অবধি করেই যাচ্ছেন। বিভিন্ন ফান্ড গঠন করেছেন। খলিফা ওমরের আদর্শ অনুসরণ করে গভীর রাতে ছুটে যান অনাহারীর দুয়ারে চাল,ডাল, মাছ, তরকারি যা যা প্রয়োজন সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করেন। কখনো আম্মুকে সাথে নিয়ে যান, কখনো আমাদেরকে প্রস্তাব দেন।
যারা সাহায্যের জন্য বাড়ি অবধি চলে আসেন তারা ভুল করেন। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস ই করাতে পারেননা এই মানুষটা পরিবার পরিজন নিয়ে এমন একটা ঘরে থাকতে পারে! তারা নিজেরাই লজ্জিত হয়ে পড়ে। অথচ আমরা বলি আলহামদুলিল্লাহ!
দুপুর বেলায় আব্বু মাদ্রাসা থেকে এসেছেন। এমন সময় সবার মন মেজাজ ই একটু চড়া থাকে। কিন্তু আব্বু সব সময় স্বাভাবিক। আম্মু আব্বুকে খাবার দিলেন। খাবার মুখে দিতেই আব্বুর বমি চলে আসে!

আম্মু হতভম্ব হয়ে যান। আব্বু কিছু না বলেই মুচকি হেসে চুপচাপ উঠে যান। ঘটনা কী জানার জন্য তরকারির ঝোলটা এবার একটু ছেখে দেখেন। তরকারিতে লবণ হয়নি।
এবার আম্মুও হেসে ফেলেন।

___আমাকে বললে কী হতো? একটু লবণ দিয়ে দিতাম হি হি হি!
আল্লাহ আমাদের ঈমানের পরীক্ষায় ফেললেন।
জালিমের কালো থাবা হানা দেয়।

ভাইয়াকে জালিমেরা জঙ্গীর অপবাদ দিয়ে কারাগারে নিয়ে যায়।
আমি তখন দেখেছি আমার বাবা মায়ের ছটফটানি। রিমান্ডে নেওয়ার কথাশুনে কত রাত ঘুমাতে পারেননি। শুধু জায়নামাজে কেঁদেছেন।

কেউ একজন বলেছিলো সেল খুব খারাপ জায়গা, বেড়ি পরিয়ে রাখে এটা শোনার পর কিভাবে কেঁদেছেন আমি দেখেছি।ঘর থেকে কোথাও বের হতেননা, সারাদিন কাঁদতেন। আব্বু আম্মুর চোখের পানি সহ্য করা কত কঠিন তা বোঝানো দায়।
কলিজা ফেটে যেতো।ভেতরটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেতো তবুও কিন্তু আমি কাঁদতাম না।কঠিন পরিস্থিতিতে ও আমার মুখে হাসি থাকে সব সময়।
স্বাভাবিক থেকে স্বান্তনা দিতে চেষ্টা করতাম।
তবুও বাবা মায়ের মন যে মানেনা!
আচ্ছা তুই কি বুঝবি?
কারণ বাবা মায়ের চোখ দেখতে পায় কল্পনার অতীত কোন দূরত্ত।
তাই তাঁরা সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন, শঙ্কিত থাকেন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
আব্বু যখন ঘুমাতেন দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম। আহা! এই মানুষটাও তো একদিন ছোট্ট একটা শিশু ছিলো। দাদুর কোল আলোকিত করে দুনিয়ায় এসেছিলেন। আজ সেই ছোট্ট শিশুটা কত বড় হয়েছে। তার নিজেরও এখন বাচ্চা আছে। তারাও আবার বড় হয়ে যাচ্ছে...

কী মায়াময় সেই ঘুমন্ত মুখখানা।
নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে। ডুকরে কেঁদে ফেলি। কিভাবে মানুষ উনাকে কষ্ট দিতে পারে? অন্তর থেকে দোয়া বের হয়

পঠিত : ৫৬৫ বার

মন্তব্য: ০