Alapon

কবি মল্লিক; একজন সাধক-একজন মুজাহিদ



কবি মল্লিক তাঁর জীবনের ক্ষুদ্র গল্প একটি গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন। সেই গানে তিনি বর্ণনা করেন তাঁর মা তাঁর কার্যক্রমে একবার বাঁধা প্রদান করেন। অভিযোগের স্বরে তিনি বলেন “ঘর ছেড়ে আর যাসনি তুই আর, কোথায় থাকিস কি করিছ কিছুই জানিনা, নিজের জন্য কিছুই তো করলিনা।” কবি মল্লিক উত্তর দিলেন ❝খোদার রাহেই হোক না জীবন পাড়।❞ মমতাময়ী মা কান্নায় ভেঙে পরে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, যেন আল্লাহ তায়ালা তাঁর সন্তানের সকল দায়িত্ব নিয়ে নেন।
কবি মল্লিক আসলে নিজের জন্য কিছুই করেননি। তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভার পুরষ্কার হিসেবে দুনিয়ায় কিছুই পাননি বলা যায়। যা বুঝা যায়— তাঁর মুখে বর্ণিত হওয়া তাঁর বিয়ের গল্প থেকে।
কবি মল্লিক যখন তাঁর বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যান তখন পাত্রীকে বলেন “আমার তো পছন্দের পালা শেষ। এখন তোমার পছন্দের পালা। আমি যা তাতো দেখছই। অর্থ বিত্ত বলতে উল্লেখ করার মত কিছু নেই। আমি যা বেতন পাই তা বাসা ভাড়া দিয়ে, সকালে একটা বা দুইটা রুটি আরেকটু ভাজি, দুপুরে সর্বোচ্চ আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে কিছু ভাত, আর রাতে এক প্লেট ভাতের সাথে এক রকম ব্যাঞ্জন আর খুব পাতলা ডাল দিয়ে খাবার সংস্থান করার পর মাস শেষে দেখি আল্লাহর কাছে হিসাব দেবার মত তেমন কোন অর্থ আমার কাছে অবশিষ্ট থাকেনা। এখন তুমি আমার জীবনে এলে, আমি যেখানে থাকি, আর আমি যা খাই, সেই গুলোতে আমি একদম সমান শেয়ার করব। যদি ভাল মনে করে আমাকে পছন্দ হয়, মুরুব্বিদের জানায়ে দিও।আর না হলে আমার কোন দুঃখ নেই”। সেদিন সেই মহিয়সী মুরব্বিদের জানাতে একটুও কালক্ষেপণ করেননি৷ বিনা ভাবনায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বিয়েতে৷
..
পায়ে হেঁটে দাওয়াতি কাজের এক পর্যায়ে অনেক ক্লান্তিতা অনুভূত হলো কবি মল্লিক ও তাঁর সফরসঙ্গীর। স্বভাবতই তাঁর সফরসঙ্গী হালকা বিশ্রামের জন্য মাটিতে বসে পরলেন। দীপ্ত ঈমানে বলিয়ান কবি মল্লিকের মন সায় দিলোনা। লিখে ফেললেন বিখ্যাত গান “একজন মুজাহিদ কখনও বসে থাকেনা, বসে থাকেনা। যতই আসুক বাধা যতই আসুক বিপদ ভেঙে পড়ে না...”
মতিউর রহমান মল্লিক ইসলামি চেতনা লালনের কারণেই জন্য তাঁর প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি। তিনি ইসলামবিরোধীদের কাছে ছিলেন তুচ্ছ। হীন ছিলেন সেই কর্দমাক্ত চরিত্রের মানুষদের কাছে যারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে অশ্লীলতা প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলো। কখনও বা নীতিকথা লিখলেও— কাগযে কালো কালিতে ফুটে উঠা তাদের শব্দমালার সাথে বিন্দুমাত্র মিল ছিলোনা তাদের কর্মে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আয়োজিত একটি লিডারশীপ প্রোগ্রামে কবি মল্লিককে প্রশ্ন করা হয় ‘এত বেদনার পাহাড় নিয়ে কিভাবে এই পথে ঠিকে আছেন৷’ প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বললেন তা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তিনি বললেন ❝ ‘রাব্বানা হাব লানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্বুররাতা আ’উনিন, অজ’আলনা লিল মুত্তাক্বীনা ইমামা’ কুরআনের এই দুয়া টা আমাকে এই জান্নাতি পথে টিকিয়ে রেখেছে। যার অর্থ “আল্লাহ তুমি আমার স্ত্রী আর সন্তান দেরকে আমার চোখের মনি বানায়ে দাও, আর আমাদের কে বানায়ে দাও মুত্তাক্বীদের ইমাম”। বিশ্বাস কর! আমি ‘সারা বাংলার গ্রামে গঞ্জে, শহরে নগরে উপকণ্ঠে’ যেখানেই গেছি, দেখেছি আমাকে যারা ইমাম মানে তারা মুত্তাকি কিনা। যখন দেখলাম আমি শয়তানদের জন্য এক জ্বলন্ত দাবানল। বুঝলাম আমি মুসলিম সাহিত্যিক হওয়ার কারনে ইসলাম বিরোধীদের কাছে খুবই হীন আর তুচ্ছ। দেখলাম আমাকে যারা মনে প্রানে দ্বায়িত্বশীল হিসাবে মানে তারা আসল অর্থেই মুত্তাকি, তখন বুঝলাম আল্লাহ আমার দুয়া কবুল করেছেন। বুঝে নিই এই আন্দোলনে আমাকে টিকে থাকতে হবেই।
.
মূলধারার গীতিকবিতা তথা আমাদের বিশ্বাসের গান অনেকেই লিখে গিয়েছেন। বিশেষত কবি নজরুল, গোলাম মোস্তফা, কবি ফররুখ আহমেদ, কবি গোলাম মুহাম্মদ, তালিম হোসেন, সাবির আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ তাঁদের অনবদ্য সৃজনকর্মের দ্বারা মানুষের মুসলিম মানুষের অন্তরের সর্বোচ্চ সম্মানের জায়গায় স্থান করে আছেন। প্রখ্যাত এই সকল কবি, গীতিকারদের সৃষ্টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ যিনি প্রদান করেছেন, সেই অমোঘ ব্যক্তির নাম ‘মতিউর রহমান মল্লিক’।
১৯৫০ ইংরেজিতে জন্ম নেওয়া মল্লিক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সুলেখক, প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিশিল্পী, কন্ঠশিল্পী, সাংবাদিক ও উপস্থাপক। বর্তমান ইসলামী গানের যে জোয়ার বহমান তার অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব কবি মল্লিকের। তার অনবদ্য কর্ম হচ্ছে ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যখনও ইসলামী গানের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেনি ঠিক সেই সময়টাতেও প্রেরণার বাক্যাদিকে সুরের মোহনায় সাজিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার যে কঠিন কাজ তিনি হাতে নিয়েছিলেন মল্লিক তারই বাস্তব রুপ হচ্ছে বর্তমান নাশিদ শিল্পী, নাশিদ সংগঠন কিংবা নাশিদ ব্যক্তিত্বের অধিক ছড়াছড়ি। আলহামদুলিল্লাহ।
১৯৭৮ সালে সাইমুম প্রতিষ্ঠার পরই ইসলামী গানের প্রতি মানুষের আগ্রহের জোঁক বাড়তে থাকে। তাদের সুসজ্জিত মৌলিক উপস্থাপনায় মুগ্ধ হতে হয়েছিলো সবাইকেই। সাইমুমের অনুসরণেই আজ শহর, নগর, গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে উঠেছে একইধারার অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। যা এখনও মুসলিম মানসে সুস্থ-সংস্কৃতির ছোয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে।
.
অনন্য প্রতিভাবান এই সাহিত্যকর্মীর সাহিত্যধারা ছিলো সত্যিই অতুলনীয়। তাঁর লেখা গানগুলোর মধ্যে বিদ্যমান উপমাসব একেবারেই ইউনিক। অসংখ্য ইসলামী গানের জনক তিনি। যা লোকমুখে এখনও নিয়মিত বহমান। মল্লিক তাঁর সৃষ্টকর্মের জন্য আজীবন মানুষের অন্তরের মণিকোঠায় স্থান করে থাকবেন। সুস্থ সংস্কৃতির মরুঝড়ের জন্ম হয়েছে যার ফুঁৎকারে তিনিই তো থাকবেন সংস্কৃতিমনাদের হৃদয়ে। আজ এই মহান ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী। আল্লাহ তাঁর কাজগুলোকে কবুল করুক, তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ আমাদের দ্বারা সম্পন্ন করার তাওফিক দান করুক, আমিন।
____________________________________________
|| কবি মল্লিক; একজন সাধক-একজন মুজাদ্দিদ ||
শেখ মুযযাম্মিল হুসাইন শুভ।

পঠিত : ৩৩৯ বার

মন্তব্য: ০