Alapon

পাকিস্তান : ২০০ বছরের সংগ্রাম



১৯৪৭ সালে নেহেরু, গান্ধীসহ কংগ্রেস নেতৃত্ব বলতে লাগলেন বা দাবি করতে লাগলেন যে, ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান মিলে একজাতি। এবং এই জাতি ভারতীয় জাতি। আর তাদের সবার দেশ একটাই; সেটা হলো হিন্দুস্তান। তাদের সাথে অবশ্য কিছু মুসলিম নেতৃত্ব (আলিমগণও) যুক্ত ছিলেন।

তবে তাদের এই দাবির শক্ত বিরোধিতা করেছেন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি দিয়েছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্ব। জিন্নাহ তখন বলেছিলেন, "হিন্দু মুসলিমদের একই জাতি হিসেবে পরিচিত করা একটা স্বপ্নমাত্র। কারণ, হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় দর্শন আলাদা, তাদের সামাজিক আচার-আচরণ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভিন্ন। এই দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে হয় না, তারা একত্রে খায় না। তারা আলাদা সভ্যতার অংশ, যে সভ্যতার মতাদর্শ ও ধ্যানধারণা ভিন্ন।"

এর পূর্বেও ১৯৪০ সালে লাহোরে এক বক্তৃতায় ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য আলাদা ভূখণ্ড বা আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন জিন্নাহ। তবে জিন্নাহ কিংবা মুসলিম লীগের এই দাবিকে ধর্ম তাত্ত্বিকভাবে শক্তিশালী করেছিলেন ইমাম সাঈয়েদ মওদূদী রহিমাহুল্লাহ। তাঁর লিখিত বইগুলোকে তাঁরা ব্যাপকভাবে প্রচার করতো। বিশেষ করে, মাসল’আয়ে কওমিয়াত তথা ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ বইটা। এই বইটাতে তিনি মুহতারাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রহিমাহুল্লাহর একজাতি তত্ত্বকে মজবুতভাবে খণ্ডন করেন।

যাহোক, কথা সেটা না। কথা হলো বিশ্বে তখন জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেতে লাগলো। আর সেই জাতীয়তাবাদের কারণে দিকে দিকে ঔপনিবেশিকদের সাম্রাজ্যবাদও গুঁড়িয়ে যেতে লাগলো। ভাষা-বর্ণ ও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশের পর পর দেশ গড়ে ওঠতে লাগলো। এর হাওয়া মুসলিম বিশ্বের গায়েও লাগে। ব্যতিক্রম ছিলো ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষে ভাষা-বর্ণ-ভূখণ্ড ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে না ওঠে, আন্দোলন গড়ে ওঠেছে ইসলামকে কেন্দ্র। আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ছিলো জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।

বিষয়টা হচ্ছে, মুসলমানদের সর্বশেষ রক্ষাকবচ উসমানী খেলাফতও জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণে খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সেখানে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী উপাদানের তুলনায় দ্বীনি অনুভূতির প্রাবল্যই ছিলো বেশ লক্ষণীয় বিষয়।

মূলত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কাফিররা ব্যবসায়ীরূপে আগমন করে ভারতবর্ষে। একপর্যায়ে ভারতবর্ষের রাজনীতি-অর্থনীতি, তাহজিব-তামাদ্দুনকে পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ করে নেয় তারা। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা বঞ্চিত হতে শুরু করি। চেপে বসে আমাদের ললাটে প্রায় দুশো বছরের বঞ্চনা ও পরাধীনতার জোয়াল।


মুসলমান এবং তাদের আলিমগণ বৃটিশ কাফির আর ভারতবর্ষের মুশরিকদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের আজাদির জন্য অব্যাহতভাবে জিহাদ করতে থাকেন। সেসব জিহাদে অনেক ওলামাকে গুম-খুনের শিকার হতে হয়। শতো শতো আলিমকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। কাউকে কাউকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নানাবিধ জুলুম বরণ করে নিতে হয়। তাই একপর্যায়ে কোনো কোনো ওলামায়ে কেরাম জিহাদের নীতি ছেড়ে দাওয়াতের নীতি অবলম্বন করেন।


মুসলমানরা যেভাবে বৃটিশদের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলো, তেমনিভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের দ্বারাও জুলুমের শিকার হচ্ছিলো। যার কারণে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসস্থান, পৃথক ভূখণ্ডের চিন্তা দানা বাধতে থাকে। সেই চিন্তা এক সময় দাবিতে রূপান্তরিত হয়। যার প্রেক্ষিতে শক্তপোক্তভাবে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্য থেকে মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসস্থানের দাবি আসতে থাকে। একপর্যায়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ভারতবর্ষকে দুটো ভাগে ভাগ করে দিয়ে যায়। মুশরিকদের অধ্যুষিত অংশকে ইন্ডিয়া নামে এবং মুসলিমদের অধ্যুষিত অংশকে পাকিস্তান নামে ভাগ করে দেয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।

খেয়াল করুন, শুরুতেই বলছিলাম যে, বিশ্বে তখন ভাষা ভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রবল জয়জয়কার অবস্থা চলমান ছিলো। এমন জাহিলিয়াতের জয়জয়কার থাকার পরেও কিন্তু পাকিস্তান কোনো নির্দিষ্ট ভাষা, নির্দিষ্ট কোনো বর্ণকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নির্দিষ্ট কোনো আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে উপজীব্য করেও গঠিত হয়নি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা-ই হয়ে ছিলো ইসলামকে ঘিরে। ইসলামকে সামনে রেখে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শ্লোগানই ছিলো " লড়াই করে পাকিস্তান অর্জন করবো, আর সেখানে আল-কুরআন কায়েম করবো! "

দেখুন, বিশ্ব যখন জাতীয়তাবাদী ভাইরাসে আক্রান্ত, অন্যান্য মুসলিম ভূখণ্ডগুলো যখন ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের ঔপনিবেশিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিলো একে একে।  তখন ইসলামকে ভিত্তি করে একটা মাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে বিশ্বে। ১৪-আগস্ট সেই ২০০ বছরের সংগ্রামে অর্জিত পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস গেলো। অথচ মুসলিম হিসেবে সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবার উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে দুয়েকটা কথা লেখার জন্য কলম ধরতে সাহস পাইনা আমরা কেউ। না জানি কেউ আবার দেশদ্রোহী কিংবা রাজাকার বলে ফেলে নাকি আমাকে .....!

এই যে ২০০ বছরের সংগ্রামের ফলে বা সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা মুসলিম অধ্যুষিত একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে কেউ ছিলো পাঞ্জাব, ছিলো বাঙালি, ছিলো পশতু ও বেলুচ। তাদের সবার ভাষা ও রীতি-নীতি, চাল-চলন, ও শখ-সংস্কৃতিতে ব্যাপক ভিন্নতা ছিলো। তবুও স্রেফ ইসলামকে কেন্দ্র করে এতো ব্যবধান থাকার পরেও সবাই এক ছাতার নিচে এসেছেন। গঠন হয়েছে বা গঠন করেছে একটা দেশ ! একটা রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রকে অনেকেই বলতেন একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের নমুনা। সাঈয়েদ কুতুব রহিমাহুল্লাহ বলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এটাও প্রমাণ করে যে সারাবিশ্বকে কেন্দ্র করে একটা রাষ্ট্র হতে পারে। এমনকী ইসলামি আন্দোলনের এই মহান প্রাণপুরুষ, এই যুগেও যে ইসলাম কায়েম সম্ভব, সেটার উদাহরণ দিতে গিয়ে পাকিস্তানকে টেনে আনতেন কিংবা টেনে এনেছেন। কারণ, এখানে ভৌগলিক ব্যবধান, ভাষার ভিন্নতা, চাল-চলনের প্রার্থক্যকে উপেক্ষা করে একটা আদর্শকে কেন্দ্র করে ও ধারণ করে একটা দেশ গঠিত হয়েছিলো। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী রহিমাহুল্লাহ কোনো একটি ভিডিও বক্তব্যে বলেন, এই রাষ্ট্রটি টিকেনি, এটা মুসলিম উম্মাহর জন্য দুর্ভাগ্য !

আদর্শকে উপজীব্য করে গঠিত হওয়া পাকিস্তান নামক এই দেশ গঠনের জন্য কিন্তু পেশ করতে হয়েছে অনেক ত্যাগের নজরানা। দিতে হয়েছে অনেক খুন। ঝরাতে হয়েছিলো অনেক প্রাণ। সংগ্রাম করতে হয়েছে প্রায় দুশো বছরের কাছাকাছি ! সেই দেশটা ভেঙে যাওয়াটা আসলে সৌভাগ্য কী দুর্ভাগ্য —এটা  নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু এটা বলতে চাই যে, মুসলমানদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের মধ্যে খোদার হুকমত কায়েম আজো হয়নি। যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিলো, সেই আদর্শের সামান্যতম অংশ দিয়েও তা পরিচালনা করা হয়নি। বরঞ্চ স্রেফ সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের জন্য কুরআন প্রতিষ্ঠার কথা বলে পাকিস্তান কায়েম করে কুরআন তো কায়েম করা যায়-ই নি, তথাপি পাকিস্তান নামক (নামকাওয়াস্তের হলেও) ইসলামি প্রজাতন্ত্রটাও টিকিয়ে রাখতে পারেনি এর শাসকবৃন্দ।

তবে এখানে এটাও ঠিক যে, পাকিস্তান ভাঙার পেছনে একচেটিয়াভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকদের অদূরদর্শিতাকেই কেবল দায়ী করা যায় না। কারণ, পাকিস্তান তো আধুনিক জাতিরাষ্ট্র সমূহের উত্থানের পর বিশ্বের প্রথম ইসলামি প্রজাতন্ত্র। আর এই রাষ্ট্রের ব্যাপারে ইসলামের স্বীকৃত দুশমনদের দুশমনি থাকবে না, তা তো হতে পারে না। তাই তাদের ষড়যন্ত্র, তাদের কুটচাল অব্যাহতভাবে চলতে লাগলো। অবশেষে হয়তো তাদের ষড়যন্ত্র, তাদের কূটকৌশল, তাদের উস্কানি সফলও হয়। ভেঙে পড়ে সেই ইসলামি আদর্শকে উপজীব্য করে গঠিত রাষ্ট্রটি। এবং এমন একজনের নেতৃত্বেই ভেঙে পড়ে, যিনি কিনা স্বয়ং নিজেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।


শেষে একটা কথা বলতে চাই, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তানের ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধের জন্যে, যুদ্ধে ঘটে যাওয়া অমানবিকতাগুলোর জন্যে যদি কাউকে ঘৃণা করতেই হয়, তবে সেটা কোনো ইসলামি ব্যক্তিত্বকে নয়, ইসলামি সংগঠনগুলোকে নয়, এরজন্য স্বয়ং সেকুলারদেরকেই ঘৃণা করতে হবে। কারণ এই ভাঙার পেছনে রাজনীতিবিদ হিসেবে সবচেয়ে বেশি দায়ী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার দল। সে নিজে এবং তার দলও সেকুলার।

গত ১৪-১৫ তারিখ ভারত ও পাকিস্তানের আজাদি দিবস গেছে। আমরাও এক সময় পাকিস্তানের অংশ ছিলাম।আমাদের এই ভূখণ্ডের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, গোলাম আজম, শের-এ বাংলারাও এই পাকিস্তানের আজাদির জন্যে আন্দোলন করেছিলো।

পাকিস্তান থেকে যে কারণে বা যে উদ্দেশ্যে মুক্ত হইছি বলে আমরা শুনতেছি, সেই কারণও কি অর্জন হয়েছে? সেই উদ্দেশ্য কি হাসিল হয়েছে? দুর্নীতিকে কি আমরা এখনও বিদায় করতে পারছি? জুলুমের জুজু কিংবা দুঃশাসনের কবল থেকেও কি মুক্তি মিলেছে আমাদের? জবাব সকলের বিবেকের কাছে.........


পাকিস্তান : ২০০ বছরের সংগ্রাম
~ রেদওয়ান রাওয়াহা
১৬-০৮-২২ ইং

পঠিত : ৩৮৩ বার

মন্তব্য: ০