Alapon

উস্তাজ মওদুদীর রাজনৈতিক চিন্তাকাঠামো ও তার বিরোধী পক্ষের মতামত বিশ্লেষণ : (পর্ব-০২)



দীর্ঘকাল ধরে দেওবন্দ ঘরানার ওলামাগণ কর্তৃক মওদুদীর চিন্তা ও রাজনৈতিক কার্যকরণের মধ্যে তাসাউফের সংকট কিংবা প্রচলিত তাসাউফ থেকে বিচ্ছিন্নতার ব্যপারে অপবাদ দিয়ে আসছেন। বিশেষত,এক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্যস্থির বানানো হয়েছে মওদুদীর লেখনী ও তার কার্যকরণমূলক চিন্তাকে। দেওবন্দের পক্ষ থেকে মোটাদাগে ২ টি অভিযোগ পেশ করা হয় :
এক. পীর বা অন্য সাধারণ মুসলমানগণ তাসাউফী চর্চার ভিতর দিয়ে যে ইহসানের পর্যায়ে পৌঁছার প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন, মওদুদী ও তার রাজনৈতিক দল সেই কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদেরকে তাসাউফী তরিকার শায়েখ কিংবা মুরব্বিদের পক্ষ থেকে ক্রোধের স্বীকার হওয়ার উপক্রম হয়েছেন।

দুই. মওদুদী ও তার চিন্তা অনুসারীরা প্রকাশ্যতঃ দ্বীনের অংশ হিসেবে সলুক ও ইহসানের অস্বীকার না করলেও এরা তাসাউফ চর্চাকারীদের যোগী, সন্নাসী, মুশরিক, জাহেলিয়াত প্রভৃতি নামের পাশে অভিহিত করার পাশাপাশি ইহসান ও সলুক হাসিল করার যে পরিচিত তরিকা সূফীয়ায়ে কেরাম দেখিয়েছেন তাকে কঠোর ভাবে তারা খন্ডন করেন। যা প্রতিষ্ঠিত সুফিদের প্রকাশ্য বিরোধিতা হিসেবেই ধর্তব্য।

অথচ, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মওদুদী তাসাউফকে কখনো পূর্ণভাবে খারিজ করে দেন নি। এমনভাবে বলেন নি যে, তাসাউফ মানেই গোমরাহি কিংবা যারা তাসাউফের চর্চা করে ও তার সাথে জড়িত সবাই গোমরাহির পথে আছেন। আমরা এক্ষেত্রে মওদুদীর চিন্তালাপকে হাজির করে পরখ করে দেখতে পারি। মওদুদী তরজমানুল কোরআনের (১৯৫৩) ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় লিখেছেন, "তাসাওউফ কোন একটি বস্তুর নাম নয়। বরঞ্চ বহু কিছু এ নামে অভিহিত হয়েছে। যে তাসাউফের সত্যতা আমরা স্বীকার করি তা আর এক জিনিস, যে তাসাউফ আমরা খন্ডন করি তা এক দ্বিতীয় জিনিস। যে তাসাউফের আমরা সংস্কার সংশোধন চাই তা এক তৃতীয় জিনিস। এক ধরনের তাসাওউফ এমন যা ইসলামের প্রাথমিক যুগের সূফীদের মধ্যে পাওয়া যেতো। যেমন ফুযাইল বিন্ ইয়ায, ইবরাহীম আদহম, মা'রূপ কর্খী প্রমুখ সূফীগণ। তাঁদের কোন পৃথক দর্শন ছিল না। তাঁদের পৃথক কোন তরিকা ছিল না। সে সব চিন্তাধারা ও কাজকর্ম তাঁদের ছিল যা ছিল কিতাব ও সুন্নাত থেকে গৃহীত, আর তাঁদের সকলের সেটাই কাম্য ছিল যা ইসলামের কাম্য। অর্থাৎ আল্লাহর জন্যে একনিষ্ঠা ও একমুখীনতা। وما أمروا االا ليعبد الله مخلصين له الدين حنفاء
এ তাসাওউফ আমরা সত্য বলে স্বীকার করি। শুধু এর সত্যতাই স্বীকার করিনা। বরঞ্চ একে জীবন্ত করতে এর প্রচারও প্রসার চাই।

দ্বিতীয় প্রকারের তাসাওউফ এমন যার মধ্যে প্লাটোর দর্শন, গ্রীক দর্শন, যরথ্রুষ্ট ও বেদান্ত দর্শনের সংমিশ্রণ হয়েছে যার মধ্যে ঈসায়ী সন্নাসী ও হিন্দু যোগীদের কর্মপদ্ধতি শামিল হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে মুশরিকী চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি মিশ্রিত হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে শরিয়ত, তরিকত ও মা'রেফাত পৃথক পৃথক বস্তু হয়ে পড়েছে। একটি অপরটি থেকে সম্পর্কহীন বরঞ্চ অনেক সময়ে পরস্পর বিপরীত মুখী হয়ে পড়েছে। এতে মানুষকে আল্লাহর খলিফার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে তার দ্বারা বিভিন্ন অন্য কাজের জন্য তৈরী করা হচ্ছে। এ তাসাউফের আমরা খন্ডন করি। আমাদের নিকটে খোদার দ্বীন কায়েমের জন্যে তার উচ্ছেদ ততোটা জরুরী, যেমন নতুন জাহেলিয়াত উচ্ছেদ করা।

এ দুটি তাসাউফ ব্যতীত আর একটি তাসাউফও আছে যার মধ্যে প্রথম ধরনের তাসাউফ এর কিছু এবং দ্বিতীয় ধরনের তাসাউফ এর কিছু বৈশিষ্ট্য সংমিশ্রিত পাওয়া যায়। এ তাসাউফের তরিকাসমূহ এমন সব বিভিন্ন বুজুর্গানে দ্বীন রচনা করেন যারা ইলমের অধিকারী ছিলেন। নেক নিয়ত পোষণ করতেন। কিন্তু আপন যুগের বৈশিষ্ট্য ও পূর্ববর্তীযুগের প্রতিক্রিয়া থেকে একেবারে নিরাপদ বা সংরক্ষিত ছিলেন না। তাঁরা ইসলামের প্রকৃত তাসাউফ উপলব্ধি করার এবং তার কর্মপদ্ধতি জাহেলী তাসাউফের মলিনতা থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের দৃষ্টিভংগীতে কিছু না কিছু প্রভাব জাহেলী তাসাউফ দর্শনের এবং তাদের আমলে কিছু না কিছু প্রভাব বাইর থেকে গৃহীত আমল কর্মপদ্ধতির অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। এ সবের ব্যাপারে তাঁদের মনে এ খট্‌কা ছিল যে, হয়তো এসব কিতাব ও সুন্নাতের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক নয় অথবা অন্তত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দ্বারা ত অসাংঘর্ষিক মনে করা যায়। উপরন্ত এ তাসাউফের উদ্দেশ্য ও ফলাফলও ইসলামের উদ্দেশ্য ও তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল থেকে কম বেশী ভিন্নতর। না তার উদ্দেশ্য সুস্পষ্টরূপে মানুষকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে তৈরী করা এবং এমন বানানো যা কুরআন "লি তাকুনু শুহাদা আ আ'লান্নাস" শব্দাবলীর দ্বারা বলে দিয়েছে। আর না তার ফলাফল এ হয়েছে যে তার মাধ্যমে এমন লোক তৈরী হতে পারতো যারা দ্বীনের পূর্ণ ধারণা হৃদয়ংগম করতে পারতো এবং তা প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা তাদের মনে জাগতো এবং কাজ করার যোগ্যতাও রাখতো। এ তৃতীয় প্রকারের তাসাওউফের না আমরা পুরোপুরি সত্যায়ন করি আর না পুরোপুরি খন্ডন করি বরঞ্চ তার অনুসারী অনুগামীদের কাছে আমাদের আবেদন এই যে, মেহেরবানী করে মহান ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা যথাস্থানে রেখে এ তাসাউফের প্রতি কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে সমালোচনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন এবং তা সংশোধন করার চেষ্টা করুন। যদি কেউ এ কারণে এ তাসাউফের সাথে দ্বিমত পোষণ করে যে সে তা কিতাব ও সুন্নাতের পরিপন্থী পেয়েছে, তাহলে তার সাথে একমত হন বা না হন তার সমালোচনার অধিকার অস্বীকার করবেননা এবং তাকে অযথা লাঞ্ছনার শিকারে পরিণত করবেননা।"
আলোচ্য বক্তব্যের আলোকে স্পষ্ট হয় যে, মওদুদী তাসাউফের কার্যকরণ ও দর্শনকে কোরআন ও সুন্নাহর পাটাতনে রেখে পরখ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি তাকে তার টেক্সট বেইজড গবেষণার আলোকে তাসাউফকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমভাগে হাজির করেছেন প্রথমযুগের মানুষদেরকে। যারা তার চোখে সত্যিকার তাসাউফের ধারকবাহক ছিলেন। কারণ তাদের চিন্তা ও আমলের জায়গা ছিল সম্পূর্ণ কোরআন ও রসুলের সাঃ এর সুন্নাহর পথসূচি অধীনে। তারা তাসাউফের নামে ইবাদতের আলাদা কোন নির্দিষ্ট পথ-পদ্ধতি বের করেন নি। বরং রাসুলের সাঃ সাহাবাদের মধ্য দিয়ে তারা যে ইবাদতের পথপদ্ধতির সাথে পরিচিতি লাভ করেছেন তারই অনুকরণে নিজেদের আ'মল, আখলাক, মুয়া'মেলাত সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন।

দ্বিতীয় প্রকার তাসাউফের ব্যাপারে মওদুদী জোর আপত্তি জানিয়েছেন। এবং এধরনের তাসাউফী ধারাকে তিনি তার বোঝাপড়ার মাধ্যমে খণ্ডন করেছেন। বিশেষ করে, এমন তাসাউফী ধারার সাথে যুগে যুগে প্লাটোর দর্শন, গ্রীক দর্শন, যরথ্রুস্ট ও বেদান্ত দর্শনের সংমিশ্রণ হওয়ার পাশাপাশি মওদুদীর উল্লেখ মতে ঈসায়ী সন্নাসী ও হিন্দু যোগীদের কর্মপদ্ধতিও এসে একটা সময় আলোচ্য ধারায় শামিল হয়েছে। ফলে, কালের পরিক্রমায় এমন ধরনের বিজাতীয় দার্শনিক মিশ্রণকে কেন্দ্র করে মুসলিম চিন্তাক্ষেত্র ও জনসমষ্টি অসংখ্য ফিরকায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে মুশরিকী চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি মিশ্রিত হওয়ার পাশাপাশি শরিয়ত, তরিকত ও মা'রেফাতও পৃথক পৃথক বস্তু হয়ে পড়ে। এদের একটি অপরটি থেকে সম্পর্কহীন বরঞ্চ অনেক সময়ে পরস্পর বিপরীত মুখী হয়ে পড়ে বলা যায়। ফলে মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসেবে তার কার্যসম্পাদনের জায়গায় ঐক্যের ভিত্তিতে যে পরিমাণ প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন ছিল সেক্ষেত্রে ব্যহত হয়। দেওবন্দের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা দ্বিতীয় অভিযোগের যেখানে বলা হয়েছে, মওদুদী তাসাউফের ধারাকে যোগী ও সন্নাসীদের সাথে তুলনা করে তাসাউফের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন তা উপরিউক্ত বক্তব্যের ধারা ভুল প্রমানিত হয়। এবং ইদানীং কালের মওদুদী সমালোচক মনোয়ার শামসীর লেখায়ও এমন ধারণারই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখি।

মওদুদীর মতে (দ্বিতীয় প্রকার তাসাউফ) "এ দর্শনের সঙ্গে এমন একটি নৈতিক ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে যা খুব কম ইতিবাচক এবং খুব বেশী বরং পুরোপুরি নেতিবাচক হয়। এ দুটি বস্তু সম্মিলিতভাবে সাহিত্য, আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও কর্ম জীবনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। যেখানে তাদের প্রভাব পৌছায় সেখানে আফিম ও কোকেনের মত কাজ করে।" উল্লেখ্য, দ্বিতীয় প্রকার দর্শন যুক্ত তাসাউফের শিকড় আব্বাসীয় শাসনামলেই স্পষ্ট হয়। আব্বাসী শাসকগণ গ্রীক, রোম ও অনারব দেশ সমূহের জাহেলি দর্শনসমূহ হুবহু কোনপ্রকার সীমানা নির্দেশ ও মুসলিম টেক্সটের পাটাতনে ফেলে মূল্যায়ন না করেই মুসলিম বিশ্বে আমদানি করার জোর ব্যবস্থা হাতে নেয়। এর পাশাপাশি, নিজেদের অর্থ ও শক্তি বলে জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প সংস্কৃতি ও সামাজিকতার মধ্যে ইসলাম পূর্ব যুগের জাহেলিয়াতের যাবতীয় বিকৃত ব্যবস্থা ব্যপক প্রচলন করেন। মওদুদী লিখেছেন, "গ্রীক দর্শনের প্রচারের ফলে মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাসের বুনিয়াদ নড়ে ওঠে। মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ ন্যায়শাস্ত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। তাই তারা দীনকে যুগের চাহিদা অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে বুঝাতে পারতেন না এবং ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আকিদা-বিশ্বাসের গোমরাহীতে দাবিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। ন্যায়শাস্ত্রে যারা বিপুল জ্ঞানের অধিকারী বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা কেবল ইসলামী শাস্ত্রে পারদর্শী তো ছিলেনই না বরং ন্যায়শাস্ত্রেও ইজতিহাদ করার মতো যোগ্যতা তাদের ছিল না। তারা গ্রীক দার্শনিকদের দাস ছিলেন। সমালোচনার দৃষ্টিতে এ গ্রীক সাহিত্য পর্যালোচনা করার মতো গভীর দৃষ্টি সম্পন্ন কোনো লোকও তাদের মধ্যে ছিল না । গ্রীক ‘ওহীকে’ অপরিবর্তনীয় মনে করে তারা হুবহু তাকে স্বীকার করে নেন এবং আসমানী ওহীকে গ্রীক ‘ওহী’ অনুযায়ী ঢালাই করার জন্যে তাকে বিকৃত করতে উদ্যোগী হন। এ পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মুসলমান ইসলামকে যুক্তি বিরোধী মনে করতে থাকে । তার প্রত্যেকটি বিষয় তাদের চোখে সন্দেহপূর্ণ হিসাবে প্রতিভাত হয়। তারা মনে বুদ্ধির করতে থাকে যে, আমাদের দীন লজ্জাবতী লতার ন্যায় স্পর্শকাতর,পরীক্ষার সামান্য স্পর্শেই তা ঝিমিয়ে পড়ে। ইমাম আবুল হাসান আশয়ারী ও তাঁর অনুসারীরা এ ধারার পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন। এ দলটি ইলমে কালাম সম্পর্কে অবগত ছিলেন কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রের দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে তাঁরা মোটেই ওয়াকেফহাল ছিলেন না। তাই তাঁরা এ ব্যাপক ও সর্ব পর্যায়ের আকিদা বিকৃতির গতি পরিবর্তন করতে পুরোপুরি সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। বরং মোতাজিলাদের প্রতি জিদের বশে তাঁরা এমন অনেক কথা গ্রহণ করেন, যা আসলে দীনী আকিদার অন্তর্ভুক্ত ছিল না।"(রেনেসাঁ/৪৮) ফলে, দীর্ঘকাল পর্যন্ত গ্রিক ও অন্যান্য বিজাতীয় দর্শন মুসলিম বিশ্বে জায়গা করে নেয়। এবং সুফিদের বিশাল একটা অংশ সেইসব দর্শনের ভিতর দিয়ে নিজেদের চিন্তার পথরেখা টানা চেষ্টা করেন। এই সময় মুসলমানদের মধ্য থেকেও অনেকেই নিজস্ব চিন্তা ও আমদানিকৃত দর্শনের আলোকে নতুন চিন্তাকাঠামো দাড় করানের চেষ্টা করেন। যাকে মুসলিম দর্শন বললেও ইসলামি দর্শন বলা চলে না। আবুল হাসান আশয়ারীরাও সেই গ্রিক ও অন্যান্য দর্শন প্রভাবিত জাহেলিয়াতী জ্ঞান দর্শনের গতিরোধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন যতক্ষণ পর্যন্ত না মুসলিম বিশ্ব ইমাম গাজ্জালীর সাথে পরিচিত লাভ করে।

মওদুদী লিখেছেন, "গ্রীক দর্শন গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পর তিনি তার সমালোচনা করেন এবং এমন জবরদস্ত সমালোচনা করেন যে, তার যে শ্রেষ্ঠত্ব ও শক্তিমত্তা মুসলমানদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো, তা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং লোকেরা যে সমস্ত মতবাদকে চরম সত্য বলে মেনে নিয়েছিল, কুরআন ও হাদীসের শিক্ষাসমূহকে যার ফলে ছাঁচে ঢালাই করা ছাড়া দীনের উদ্ধারের আর কোনো উপায় পরিদৃষ্ট হচ্ছিল না, তার আসল চেহারা অনেকাংশে জনগণের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়ে যায় । ইমামের এই সমালোচনার প্রভাব শুধু মুসলমান দেশসমূহেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং ইউরোপে উপনীত হয় এবং সেখানে গ্রীক দর্শনের কর্তৃত্ব খতম করার এবং আধুনিক সমালোচনা ও গবেষণা যুগের দ্বারোদ্ঘাটন করার ব্যাপারে অংশগ্রহণ করে। ন্যায় শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান না রাখার কারণে ইসলামের সমর্থকগণ দার্শনিক ও মুতাকাল্লিমদের মোকাবিলায় যেসব ভুল করছিল তিনি সেগুলো সংশোধন করেন । পরবর্তীকালে ইউরোপের পাদ্রীরা যে ভুল করেছিল ইসলামের এ সমর্থকরা ঠিক সেই পর্যায়ে ভুল করে চলছিল। অর্থাৎ ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাসের যুক্তি-প্রমাণকে কতক সুস্পষ্ট অযৌক্তিক বিষয়াবলীর ওপর নির্ভরশীল মনে করে অযথা সেগুলোকে মূলনীতি হিসেবে গণ্য করা, অতঃপর ঐ মনগড়া মূলনীতিগুলোকেও ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের মধ্যে শামিল করে, যারা সেগুলো অস্বীকার করে তাদেরকে কাফের গণ্য করা, আর যে সমস্ত দলিল-প্রমাণ, অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মনগড়া ঐ নীতিগুলোর গলদ প্রমাণিত হয়, সেগুলোকে ধর্মের জন্যে বিপদ স্বরূপ মনে করা। এ জিনিসটিই ইউরোপকে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে মুসলিম দেশসমূহে এ জিনিসটিই বিপুল বিক্রমে কাজ করে যাচ্ছিল এবং জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করছিল । কিন্তু ইমাম গাজ্জালী যথাসময়ে এর সংশোধন করেন। তিনি মুসলমানদেরকে জানান যে, অযৌক্তিক বিষয়সমূহের ওপর তোমাদের ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের প্রমাণ নির্ভরশীল নয় বরং এর পেছনে উপযুক্ত যুক্তি-প্রমাণ আছে। কাজেই ঐগুলোর ওপর জোর দেয়া অর্থহীন।(রেনেসাঁ/৫০) পরবর্তীকালে ইমাম ইবনে তায়মিয়া গ্রিক যুক্তি ও দর্শনের সমালোচনায় গাজ্জালীর চাইতেও কঠোরতা আরোপ করেন। এবং সমকালীন দর্শন চর্চায় মুসলমানদের জন্য ইসলামের মধ্য থেকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সীমানা নির্দেশক পাটাতন তৈরির চেষ্টা করেন।

মুসলিম বিশ্বে যখন তাসাউফী ধারার সাথে গ্রিক দর্শন ও অন্যান্য জাতির জাহেলিয়াতী দর্শনগুলো এসে মিশে যায়, তখন ভারতবর্ষও এর বাহিরে ছিল না। এখানকার পীর মশায়েখদের মধ্যে সমকালীন অন্যান্য রোগ বিস্তার করার পাশাপাশি দর্শন সংক্রান্ত একটি নয়া রোগও বিস্তার লাভ করেছিল। মওদুদী লিখেছেন, "নয়া প্লেটোবাদ, বৈরাগ্যবাদ (Stoicism), মনুবাদ ও বেদান্তবাদের সংমিশ্রণে এক অদ্ভূত ধরনের দর্শন ভিত্তিক তাসাউফ জন্মলাভ করে। ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক ব্যবস্থায় তাকে স্থান দেয়া হয়। তরিকত ও হকিকতকে ইসলামী শরীয়ত থেকে পৃথক এবং তার থেকে মুখাপেক্ষীহীন গণ্য করা হয়। বাতেনের এলাকা জাহের থেকে পৃথক করে নেয়া হয়। এ এলাকার আইনে হালাল ও হারামের সীমানা বিলুপ্ত ইসলামী বিধি-নিষেধসমূহ কার্যতঃ বাতিল এবং সমস্ত ক্ষমতা ইন্দ্রিয় লিপ্সার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ইচ্ছা মতো কোনো হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করা ছিল এ আইনের বৈশিষ্ট্য। এ সাধারণ পীরদের থেকে যার অবস্থা ভালো ছিল সেও কমবেশী ঐ দর্শন ভিত্তিক তাসাউফ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিশেষ করে সর্বেশ্বরবাদের ভ্রান্ত ধারণা সমস্ত কর্মক্ষমতা হরণ করে নেয়।(রেনেসাঁ/৬২)

উপমহাদেশে ইসলামের এমন দুর্যোগময় ক্রান্তিলগ্নে ইলমী সিলসিলা ও সংস্কার আন্দোলনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের মাঝে শায়খ আহমদ সরহিন্দীর নাম উল্লেখযোগ্য। যিনি প্রথম উপমহাদেশে তাসাউফী ধারায় দর্শন ও বৈরাগ্যবাদী ভ্রষ্টতার কারণে সৃষ্ট হওয়া জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে বিশাল লেখনী তৈরি করেন। এবং তার বিপরীতে ইসলামের নির্ভেজাল ও আসল তাসাউফী চিন্তা ও পদ্ধতিকে উল্লেখ করে ইসলামের ব্যপক খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। এছাড়াও, শায়খ সরহিন্দী তার সমকালীন জনসাধারণের মাঝে প্রচলিত যেসব জাহেলী রসম-রেওয়াজ বিস্তার লাভ করে তিনি তার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে শরীয়ত অনুসারিতার এক শক্তিশালী আন্দোলন পরিচালনা করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর ক্ষেত্রেও একই দিক দেখি আমরা। তিনি নিজেদের উলামা আখ্যাদানকারী তালেবে ইলমদের উদ্দেশ্যে তার তাফহিমাতে বলেন, "নির্বোধের দল! তোমরা গ্রীকদের বিদ্যা, ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রের গোলক ধাঁধায় আটকে পড়েছো আর মনে করছো যে, বিদ্যা-বুদ্ধি এগুলোর নাম। অথচ বিদ্যা খোদার কিতাবের আয়াতে সুস্পষ্ট অথবা তাঁর রসূলের মাধ্যমে প্রমাণিত সুন্নাতের মধ্যে নিহিত।" এছাড়াও, গ্রিক দর্শন ভিত্তিক জ্ঞান ও তাসাউফী চর্চার ধারা থেকে বাহির হয়ে নতুন আঙ্গিকে ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞান ও তাসাউফ চর্চার নতুন আঙ্গিক টেক্সট নির্ভর বয়ান হাজির করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিদের তাসাউফী চিন্তার ব্যাপারে মাওলানা মওদুদীর একটা আপত্তি ছিল যে, তারা তাসাউফের সংস্কারে যে আলাপ হাজির করেন তা ইসলামের সত্যিকার তাসাউফী মেথডই ছিল। কিন্তু, একইরূপ শব্দের ব্যবহার,উপমা ও পদ্ধতিগত সামঞ্জস্য থাকার ফলে লোকেরা সঠিক পদ্ধতির অনুসরণ না করে পূর্বের চিন্তা ও পদ্ধতিতেই স্থির হইয়া থাকে। ফলে, তাদের চিন্তা বইয়ের পাতা থেকে কিছুকালের জন্য বাহিরে আসলেও তা আবার ভিতরে আঁটকে যায়। মাওলানা ইসমাইল শহীদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে আবার নতুন করে তাসাউফী ধারায় সংস্কার আনার প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যায়। কিন্তু জিহাদ আন্দোলনের ভিতর দিয়ে পরাজয়ের মাধ্যমে সেই সংস্কারও আর পূর্ণতা লাভ করে নি। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ভারতবর্ষের এমন জাহালতপূর্ণ তাসাউফী চর্চার ভিতরে থেকেও কিছু ভালো পীর মশায়েখ ছিলেন না বললে ভুল হবে। কিন্তু, বৃহৎ পরিসরে তাদের প্রভাব খুব একটা দেখা যায় নি। এই পর্যায়ে মওদুদীর ক্ষেত্রেও যখন বিষয়টা আমরা পরখ করি তখন দেখা যায় যে, তিনিও তাসাউফের যে ধারার (দ্বিতীয় প্রকার) প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন এবং সেটা খারিজ করেছেন, তা তারই পূর্ববর্তী মুজাদ্দিদ আলেমদের জ্ঞানগত দার্শনিক সমালোচনারই সিলসিলা ছিল। পাশাপাশি, যে ধারার তাসাউফী চর্চার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা অর্জন হতে পারে, কিংবা আলেমদের সমর্থনের ভিতর দিয়ে (তৃতীয় প্রকার) যা চলে আসছে তাকেও তিনি সমালোচনা করেছেন বর্তমানের আলোকে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানাপ্রকার জাহেলিয়াতমূলক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে।
ফলতঃ মওদুদীর তাসাউফী চিন্তা নিয়ে মনোয়ার শামসীর মন্তব্যের প্রেক্ষিত মওদুদীর ভাষ্য এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শামসী লিখেছেন "তার ইসলামভাষ্যে ইবনে আরাবী, শিহাবউদ্দীন সুহরাওয়ার্দী ও মোল্লা সদরা প্রমুখ দ্বারা যে ইরফানী, ইশরাকী ও হিকমাতী ভাববিপ্লব ঘটে গেছে তার কোনো উপস্থিতি নেই। এই ভাববিপ্লবে অনেক বিচ্যুতি ও বিকৃতি এসেছিল একথা ঠিক, কিন্তু মুহাম্মদ ইকবাল যেমনিভাবে সেসবের সংস্কার করে তার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে সক্রিয় ও সকর্মক খুদী তত্ত্বের উদ্ভাবন করেছিলেন এবং এই সমস্যাগুলির একপ্রকার নিষ্পত্তি করেছিলেন, মওদূদী তেমন কোনো চেষ্টাই করেন নি। ফলে মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মজ্ঞানের পরিসরে মওদূদীর ইসলামভাষ্য যারপরনাই নীরব এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। মানুষের আত্মসত্তা ও কর্তাসত্তার প্রশ্নে তিনি ইসফাহান স্কুল ও ফিরিঙ্গী মহলী দারসে নিজামী পরবর্তী মহাচৈতন্য ও অস্তিত্ব ভিত্তিক অর্থাৎ উজুদী কোনো বীক্ষার প্রতি আগ্রহ দেখাবার প্রয়োজন বোধ করেন নি। এখানেও মওদূদী দারুণভাবে খন্ডিত, আংশিক ও সংকীর্ণ। এর ফলে আজ তার সূচিত ইক্বামতে দ্বীনের আন্দোলন রুহানীয়াতের চর্চার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে।"

শামসী তার বক্তব্যের আলোকে মওদুদীর বিরুদ্ধে যেই ধারার তাসাউফী দর্শন চর্চার সংকট অনুভব করেছেন। তাকে মওদুদী নিজেই খারিজ করেছেন। এবং সেটার কারণও মওদুদীর বক্তব্যের আলোকে ব্যখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষত, শুধুমাত্র আল্লামা ইকবালই একমাত্র নয়, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে তায়মিয়া ও শাহ ওয়ালিউল্লাহসহ আরো অনেকেই এই ধারার দর্শন ভিত্তিক তাসাউফের সমালোচনা করে শরীয়তের অধীনস্থ টেক্সট ভিত্তিক তাসাউফী তরিকত হাজির করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, কালের বিবর্তে সেগুলো তার নিজ জায়গায় স্থির থাকে নি। ফলে, সেই একই পথে মওদুদী পুনর্বার যাওয়ার চেষ্টা করেন নাই। তিনি সংস্কারকদের মত মূল উদ্দেশ্য ও ধরণগত জায়গাকে ঠিক রেখে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় তাসাউফের ভাষা, ধরণ ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন হাজির করেন। এবং বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ককে টেক্সট ভিত্তিক দার্শনিকারে পর্যালোচনা করেন। যার অসাধারণ একটি উপস্থাপনা কারজাবির (মওদুদীর জীবন) বইতে পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য যে, তৃতীয় প্রকার তাসাউফের ক্ষেত্রে মওদুদী মধ্যমপন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করেছেন। না তাকে খারিজ করেছেন, না তাকে পূর্ণভাবে সমর্থন জানিয়েছেন। বরং তিনি এর সংস্কার চেয়েছেন। এর প্রতিষ্ঠাকালীন মুরব্বিরা শরীয়তী সীমানায় থেকে যে চিন্তা ও পদ্ধতির অনুসরণে তাসাউফী চর্চা করে গেছেন সেই মূলে ফেরত যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছেন। আধুনিক কালে এসে এধরণের তাসাউফের উদ্দেশ্য ও ফলাফলও ইসলামের উদ্দেশ্য ও তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল থেকে কম বেশী ভিন্নতর হয়ে দেখা দিচ্ছে। না তার উদ্দেশ্য সুস্পষ্টরূপে মানুষকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে তৈরী করা, না তার উদ্দেশ্য মানুষকে ইকামাতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য উদগ্রীব করে তোলা। বরং ব্যক্তিকে নির্জনপ্রিয় ও বৈরাগ্যবাদী দর্শনে প্রভাবিত করার মধ্য দিয়ে দুনিয়াকে তাগুতের হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা নামকাওয়াস্তে জান্নাতের অপেক্ষায় দুনিয়া ত্যাগের বাসনায় বিভোর হয়ে চটপট করছে। শুধু তাই নয় আজকের যুগে এসে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইসলামের রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিতে এই ধরনের বৈরাগ্যবাদী সুফিবাদকে পালনের প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে।

মওদুদীর চোখে তৃতীয় প্রকার তাসাউফ আধুনিক সময়ে এসে ইসলামের মৌলিক অবস্থা থেকে অনেকখানি সরে এসে কিছু নামসর্বস্ব আমল ও ধর্মীয় খোলসের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাছাড়া, উপমহাদেশে ধর্মীয় পুনর্জাগরণে সুফি ও অনেক আলেমসমাজের যে ভূমিকা তাও তার সময়কালে এসে অনেকটাই শ্রীহীন ও তার বিপ্লবী প্রভাববলয় অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। "এ মানসিকতা নবীগণের উম্মতের একটি অংশকে মোরাকাবা, মোশাহাদা, কাশফ, চিল্লাদান, অজীফা পাঠ. মাকামাত সফর ও হাকীকত প্রভৃতির দার্শনিক ব্যাখ্যার, গোলক ধাঁধায় নিক্ষেপ করেছে। তারা মুস্তাহাব ও নফল আদায়ের ব্যাপারে ফরজের চাইতেও বেশী মনোযোগী হয়েছে।.. অন্যদিকে আরো একটি অংশের মধ্যে কাশফ ও কেরামত, দীনের নির্দেশের ব্যাপারে অযথা বাড়াবাড়ি, অনর্থক প্রশ্ন উত্থাপন, ছোট ছোট জিনিসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিমাপ করা এবং খুঁটিনাটি ব্যাপারে অস্বাভাবিক মনোযোগ ও যত্ন নেয়ার রোগ জন্ম নিয়েছে। এমনকি খোদার দ্বীন তাদের নিকট এমন একটি হালকা কাঁচপাত্রে পরিণত হয়েছে, যা সামান্য কথায় বা সামান্য ব্যাপারে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যায়, ফলে তাদের মনে সবসময় সন্ত্রস্তভাব বিরাজিত, যেন একটু এদিক-ওদিক না হয়ে যায়, তাদের শিরোপরি রক্ষিত কাঁচপাত্র যেন ভেঙে টুকরো টুকরো না হয়ে যায়—এ সন্ত্রস্ততার মধ্যেই তাদের সবটা সময় অতিবাহিত হয়। দীনের মধ্যে এ গভীর সূক্ষ্মতার পথ প্রশস্ত হবার পর অনিবার্যরূপে স্থবিরতা, সংকীর্ণ চিন্তা ও স্বল্প হিম্মত সৃষ্টি হয়। (রেনেসাঁ/২১)
মওদুদী প্রচলিত তাসাউফের নামগত ও পদ্ধতিগত দিকের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা অর্জনের পদ্ধতিগত বিষয়কে 'তাযকিয়াতুন নফস' বলে নতুনভাবে টেক্সট ভিত্তিক সংজ্ঞায়ন করার চেষ্টা করেছেন। যেমন সংজ্ঞায়ন ও তাসাউফ চর্চার উদ্দেশ্যগত দিক পরিলক্ষিত হয় সুফিদের কিতাবগুলিতে। বিশেষ করে, ইমাম কুশায়রীর (র) কিতাব 'রিসালায়ে কুশায়রিয়া' কে আমরা ধর্তব্য হিসেবে নিতে পারি। এই কিতাবের মাঝে অসংখ্য সুফিদের জীবনাচরণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তাদের আত্ম পরিশুদ্ধির বিশাল এক সংগ্রহ তুলে ধরেছেন। সেখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পূর্ববর্তী কালের ঐতিহ্যিক ধারার অনেক আলেম ও সুফিদের মাঝে ইহসানের পর্যায়ে উপনীত হতে ব্যক্তিগত অসংখ্য মতামত থাকলেও সেগুলো একজন মানুষকে কিভাবে তার ব্যক্তিগত অহমিকা, হিংসা বিদ্বেষ ও আচরণগত হিংস্রতা থেকে পবিত্র করে আল্লাহর নিকটবর্তী করে তোলা যায় এমন কিছু বুঝানোর মধ্যেই তাসাউফের উদ্দেশ্য ছিল। আর তাসাউফের উৎকর্ষতা অর্জনের পথে মাধ্যম হিসেবে কোরআন ও রাসুল সাঃ এর সুন্নাহই প্রধান তরিকত হিসেবে বিবেচিত হতো। তারা কখনোই শরীয়তের অনুমোদনের বাহিরে গিয়ে মৌলিক তাসাউফী চর্চার বাহিরে আলাদা কোন তরিকত গ্রহণ করেন নাই। কিন্তু, তাদের ব্যক্তিগত মূল ইবাদতের পাশাপাশি স্বাতন্ত্র্যিক দার্শনিক ভাবনা, নফল আমল ও অন্যান্য কাজকর্মের প্রতি বিভিন্নভাবে ঝোঁকপ্রবনতা একটাসময় তাদের অনুসারীদের আলাদা আলাদা তরিকতের দিকে নিয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে, একটা সময় এসে সেই ধারা শরীয়তের গণ্ডি থেকে বের হয়ে দর্শন ও রিচুয়াল ভিত্তিক পৃথক পৃথক তরিকতে বিভক্তি তৈরির মাধ্যমে তাসাউফী ধারার বিকৃতির পথে গিয়ে সমাসীন হয়। মওদুদী তাসাউফী চর্চার বিকৃতিময়, দুর্বল ও অধিকার চেতানাহীন পথে না হেঁটে, শরীয়তের গণ্ডি বেয়ে সরাসরি টেক্সট ভিত্তিক (তাযকিয়াতুন নফস) আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ অর্জনের পথকেই বেঁচে নিয়েছেন। ফলে, দেওবন্দের অধিকাংশ বুজুর্গদের লিখিত কিতাবে মওদুদী ও তার রাজনৈতিক দলের চিন্তা চেতনা ও আমলে তাসাউফের পূর্ণতা না থাকার পক্ষে মতামত একধরণের অতিরঞ্জিতকরণ ব্যতিত আর কিছুই নয়।

- মুহাম্মদ কামরুজ্জামান

পঠিত : ৪১৪ বার

মন্তব্য: ০