Alapon

সুন্নি, আলীভক্ত সুন্নি ও শিয়া (বাংলাদেশে শিয়াপ্রভাব ও প্রতিরোধ প্রসঙ্গ)




মুসলিম উম্মাহর চরম দুর্ভাগ্য এই যে, মহানবি (সা)-এর ওফাতের এক-দেড় শত বছরের মাঝে বহু ফির্কার উদ্ভবে উম্মাহ বিভক্ত হয়ে যায়। বহুমুখী দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের ফলাফল দাঁড়াল এই যে, উম্মাহর মূলধারা (যারা মহানবি [সা] ও সাহাবায়ের কেরামের আদর্শে স্থিত) আহলুস সুন্নাহ (সংক্ষেপে সুন্নি) নামে পরিচিতি লাভ করে। পাশাপাশি উদ্ভ ঘটে অনেক উপদলের: খারিজি, শিয়া, মুতাজিলা, মুর্জিয়া ইত্যাদি। বহু উপদল কালক্রমে বিলুপ্ত দুর্বল হয়ে যায়। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম হল শিয়া সম্প্রদায়। শত শত বছর ধরে উপদলটি অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, কখনো এটির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বেড়েছে, কখনো কমেছে, কিন্তু একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। 1979 সালে ইরানি বিপ্লবের পর শিয়াদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব আরো জোরদার হয়েছে।

সুন্নি ও শিয়া’র পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা এ পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। এর উদ্দেশ্য হল ধর্মীয় উপধারার প্রভাব প্রতিহত করতে গিয়ে সাম্প্রতিক কালে যে প্রবণতাগুলো পরিদৃষ্ট হচ্ছে, সেগুলোকে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের আলোকে পর্যালোচনা করা।
তবে শিয়া সম্প্রদায়ের পরিচয় সংক্ষেপে উপস্থাপন না করলে আলোচনাটি বোধগম্য হবে না। মহানবি (সা)-এর শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণের ব্যাপারে অন্য সাহাবীগণের নানাবিধ মনোভাব ছিল, বিশেষত শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ ও ভালোবাসার প্রশ্নে। কোন কোন সাহাবী হয়ত ‘আলী (রা) কে অধিক ভালোবাসতেন। এতে আপত্তির কিছু নেই, ভালোবাসার বিষয়টি মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু আবু বাকর (রা) খালিফা নির্বাচিত হওয়ার পর, ‘আলি (রা)-এর প্রতি অধিক ভালোবাসা আছে বলে, কেউ প্রথম খালিফার কাছে বায়আত করতে অস্বীকৃত হননি। তার মানে অধিক ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি অন্তর্গত ও অনুভবের বিষয় ছিল, পার্থিব সিদ্ধান্তে প্রভাবক ছিল না। তাই কোন সাহাবি, আবু বাকর, ‘উমার ও ‘উসমান (রা)-এর প্রতি বায়আত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন, এমনটি জানা যায় না।

‘আলি (রা) ও নবীপরিবারের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার মত নির্দোষ বিষয়টিকে পূঁজি করে কালে কালে একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক তত্ত্ব হাজির করা হয়, যুগপরিক্রমায় যা একটি মতবাদ ও ধর্মীয় উপদলের জন্ম দেয়: শিয়াবাদ। কিন্তু শিয়াবাদের নানাবিধ রূপ রয়েছে। আগেই যেমনটি বলা হয়েছে, সাহাবিগণের কেউ কেউ ‘আলী (রা) কে বেশি ভালোবাসতেন। তাবিঈ ও তাবা তাবিঈগণের যুগে অনেক বিদ্বান ব্যক্তি ‘আলী (রা) ও নবীপরিবারের প্রতি অধিক ভালোবাসা পোষণ করতেন, এমনকি তাঁদের কেউ কেউ মনে করতেন, ‘আলী (রা) সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী। এটুকুই, তাঁরা আবু বাকর, ‘উমার (রা), ‘উসমান (রা)-এর খিলাফাহকে বৈধ মনে করতেন। সকল সাহাবীকে ভালোবাসতেন, কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। এটিকে মায়ল ইলাত তাশায়‘উ‘ বলেছেন, কেউ কেউ। কিন্তু এ প্রবণতার কারণে কেউ তাদেরকে শিয়া বলে অভিহিত করেননি। ‘আলি ও নবীপরিবারের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা পোষণ করতেন এবং ‘আলি (রা) কে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী মনে করতেন, এমন অনেক রাবির বর্ণনা ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম গ্রহণ করেছেন। এঁদের সংখ্যা 17/18 হবে। তার মানে এতটুকু মানসিক ঝোঁক ও আসক্তিকে তারা গর্হিত মনে করেননি।

কিন্তু পরবর্তীতে শিয়াবাদে যে রূপান্তর ঘটে তা কেবল ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ভালোবাসার পাশাপাশি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও তাকফির এটির অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়। উগ্র শিয়ারা আবু বাকর, ‘উমার ও ‘উসমান (রা) কে অধিকারহরণকারী বলে মনে করে, কারণ, তাদের মতে, ‘আলী (রা) খিলাফাত লাভে অধিক হকদার ছিলেন। প্রথম তিন খালিফা তাঁর অধিকার হরণ করেছেন। তাঁরা এমনও মনে করে, মহানবি (সা)-এর ইন্তেকালের পর মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত অন্য সাহাবিরা মুরতাদ হয়ে যায় (নাউজুবিল্লাহ)। এ দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তারা বহু বানোয়াট হাদিস রটনা করে, ভুয়া তাফসির রচনা করে।

বলাবাহুল্য, এহেন মতাদর্শের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। তাই আলিমগণ এ ধারার শিয়াদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। প্রতিবছর মুহাররম মাসে একটি আলোচনা বারবার ঘুরেফিরে আসে। আর তা হল, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে শিয়াপ্রভাব। এটা সত্য যে, বাংলাদেশে দশ মুহাররম তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। এটা শিয়া সম্প্রদায় আয়োজন করে। গণতান্ত্রিক দেশে তাদের আচার পালনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু আরো কিছু বিষয়ে আলোচনা আবর্তিত হয়। যেমন ইয়াজিদকে লানত দেয়া এবং মুয়াবিয়া (রা) কে গালমন্দ করা। শায়খগণ এগুলোকেও শিয়াপ্রভাব বলে গণ্য করেন। তারা বলার চেষ্টা করেন যে, অজান্তে বাংলাদেশের অনেক মানুষ শিয়া হয়ে গেছেন। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে শিয়াবাদ প্রসারের অন্যতম গলিপথ হল সুফিবাদ। অনেকে এমন মন্তব্যও করেন যে, সুফিবাদ ও শিয়াবাদ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

আমার দৃষ্টিতে শিয়াবাদ প্রতিরোধে এটি একটি ভুল পদ্ধতি। এ পদ্ধতির ফলাফল হিতে বিপরীত হতে পারে। ‘আলী (রা) ও নাবীপরিবারের প্রতি অধিক ভালোবাসা ও শিয়াবাদ- দু’টো ভিন্ন বিষয়। যেমনিভাবে মুয়াবিয়া (রা)-প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও এজিদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন – দু’টো ভিন্ন বিষয়। উভয় পক্ষের কিছু মানুষ সরলীকরণের মাধ্যমে এ দু’টাকে গুলিয়ে ফেলে এবং ঢালাও মন্তব্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করে।

বাংলাদেশের তাসাওউফপন্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ সাহাবি হিসেবে মুয়াবিয়া (রা) এর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান পোষণ করে। এমনকি আমি নিজ কানে কথিত সুন্নি ওয়ায়েজদের অনেককে বলতে শুনেছি, মুয়াবিয়া (রা)-এর প্রতি ভালোবাসা ও এজিদের প্রতি ঘৃণা দু’টো ভিন্ন বিষয়। এমনকি তাদের মুখে আমি এটিও শুনেছি যে, নূহ (আ)-এর পুত্রের কাজের জন্য যেমন নূহ (আ) কে দায়ী করা যায় না, তেমনিভাবে এজিদের কাজের জন্য মুয়াবিয়াকে দায়ি করা যায় না।’ তবে তারা এজিদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে এবং তাকে লানত করে। এখন এটুকুর জন্য তাদেরকে শিয়া ট্যাগ দেয়া অন্যায় ও অবিচার হবে। আমি মনে করি, সাহাবী মুয়াবিয়া (রা)-এর পুত্র বলে এজিদকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা করা উচিত নয়। এজিদের ব্যাপারে আমাদের কোন এজেন্ডা থাকা উচিত নয়, না তাকে পরিষ্কার করা, আর না তাকে কলঙ্কিত করা। এজিদ কখনো সুন্নিয়্যত ও শিয়াবাদের মাপকাঠি হতে পারে না।

বাকি রইল কথিত সুন্নি ও তাসাওউফপন্থদের ওই অংশ, যারা, জেনে বা না জেনে, বহু শিয়া এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। যেমন, মুয়াবিয়া (রা)-এর প্রতি অসম্মানসূচক মন্তব্য করা, ঈদে গাদিরে খুম পালন করা ইত্যাদি। কোন সন্দেহ নেই, এরা আহলুস সুন্নাহ-এর সীমা পেরিয়ে শিয়াবাদে পা রেখেছে। এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সতর্ক করা উচিত। তারপরও বলব, দরদ ও ভালোবাসার সাথে। আপনজনের একাংশকে শিয়াবাদি ট্যাগ দিলে তাদেরকে ওদিকেই ঠেলে দেয়া হয়। বরং তাদেরকে এমন সুন্নি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে, যাদের মাঝে কিছু বিচ্যুতি রয়েছে, আশা করা যায়, উপদেশ ও মঙ্গল কামনায় তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যাবে। একটি বড় ধারায় অনেকগুলো উপধারা থাকে, দুয়েকটি উপশাখার কর্মকাণ্ডের পুরো ধারাকে দায়ি করা বা নেতিবাচক ট্যাগ দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়া কখনো প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না।

প্রতীকী কার্টুন
সূত্র: https://cartoonmovement.com/cartoon/sunni-shia

পঠিত : ৫০৯ বার

মন্তব্য: ০