Alapon

সুখী সংসার গড়ার উপায়...



জাহেলী সমাজব্যবস্থায় সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে বিয়ের আগে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে জীবনযাপন করা খুব-ই কঠিন কাজ। এছাড়া যৌবনাবেগের কারণেও অনেকের দ্বারাই অনেক ভুল-ত্রুটি হয় বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। সেহেতু বিয়ের আগেই বর-কনে সম্পর্কে যথাসম্ভব অনুসন্ধান করে বা খোঁজ-খবর নিয়ে যতটুক জানা-বোঝা যায় জেনে-বুঝে নাও। তারপরে মনে চাইলে তাকে বিয়ে করো, না চাইলে কোর না।

কিন্তু বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার খোঁজ-খবর করতে যেও না। তা করতে যেয়ে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় জেনে গেলে দাম্পত্য জীবনের কোনো কল্যাণ তো বয়ে আনবেই না বরং সংসারে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। এমনকি একটি শান্তি-সুখের সংসারও ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেতে পারে এবং বহুসংখ্যক সংসার এই কারণে ভেঙ্গে যাওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

কেউ যদি অপরের সবকিছু জেনে-বুঝে মুখ বুঁজেও থাকে, সংসারে অশান্তির আগুন না জ্বললেও সে মনের আগুনে সারাক্ষণ জ্বলে-পুড়ে ছারখার হতে থাকবে।

বিয়ের আগে ভালো-মন্দ, সুকর্ম বা কুকর্ম যে যা-ই করে থাকো, সংসার সুখের রাখতে হলে বিয়ের পরে ভুলেও কেউ ভুল পথে পা বাড়াবে না। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে কোনো কারণে দু'জনের বনিবনা না হলে কিংবা একের অপরকে ভালো না লাগলে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন (যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে ঘৃণিত বৈধ কাজ) করে যাকে ভালো লাগে তাকে নিয়ে পুনরায় সংসার গড়ো। কিন্তু যতদিন বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখবে উভয়ে উভয়ের নিকট সৎ ও বিশ্বস্ত থাকবে।

বিয়ের পরে একে অপরকে কখনো একথাও বলবে না, 'তোমার সাথে বিয়ে না হলে অমুক রাজকন্যা বা রাজপুত্রের সাথে আমার বিয়ে হতো।' কারণ যে মাছটি ছুটে যায় তাকে সবসময় বোয়ালমাছ মনে হয়। কিন্তু মাছটি ধরা পড়লে দেখা যায় তা একটি পুঁটিমাছ মাত্র।

বিয়ের আগে কারো কোনো দোষ-ত্রুটি থাকলে উভয়পক্ষের নিকট উভয়ে যথাসম্ভব তা প্রকাশ করে দিবে বা খুলে বলবে। সব জেনে-শুনে কেউ কাউকে বিয়ে করলে তখন সেটা নিয়ে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু তা না করে কেউ যদি নিজের কোনো দোষ-ত্রুটি, অক্ষমতা বা দুর্বলতা গোপন রাখে, বিয়ের পরে তা প্রকাশ হয়ে গেলে সেটা নিয়ে চরম অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সেটা তার দাম্পত্য জীবনে বিষফোঁড়ার মতো প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা দিবে।

বিয়ের আগে বর বা কনের কোনো গুণাবলির কথাও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলবে না। বললে পরে যখন তার মধ্যে সেই গুণাবলিটা পাওয়া না যাবে সেটা নিয়েও প্রতিদিন কাঁটার আঘাত সইতে হবে।

স্বামী-স্ত্রী একের উপর আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্বও জাহির করতে যাবে না। কারণ কারো মনে কারো শ্রেষ্ঠত্ব স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে তা জোর করে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কেউ এমন বোকামী করলে অন্যজনের নিকট ঘৃণার পাত্র/পাত্রী হবে এবং কথায় কথায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হবে।

স্বামী-স্ত্রীর পিতা-মাতা, ভাই-বোন বা আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারেও কেউ কোনো অসম্মানজনক অবমাননাকর কথা বলবে না। কারণ যার যার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন তার তার নিকট অতিপ্রিয়। তাদের অবমাননা করলে সংসারে নির্ঘাত অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এবং তার কুফল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

যে স্বামী নিজের স্ত্রীর নিকট পরস্ত্রীর এবং যে স্ত্রী নিজের স্বামীর নিকট পরপুরুষের প্রশংসা করে, এরচেয়ে আত্মঘাতী বা আহম্মকি কাজ দ্বিতীয়টি আর নেই। সুতরাং এব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক থাকতে হবে। কোনোক্রমেই কাজটি করতে নেই। বুঝতে হবে, নিজের স্ত্রী বা স্বামী যেমন-ই হোক, দুনিয়াতে সে-ই তোমার একান্ত আপনজন। সুখে-দু:খে চিরসাথী। পরস্ত্রী বা পরপুরুষ ভালো হলে তোমার কী লাভ? তাকে নিয়ে তো তুমি ঘর-সংসার করতে পারবে না। পারো যদি নিজের স্ত্রী বা স্বামীর প্রাণখুলে প্রশংসা করো। সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার কোনো ভালো গুণাবলি খুঁজে বের করো এবং সেই গুণের কথা বলেই তার প্রশংসা করো। তোমার সংসারে শান্তি-সুখের জোয়ার বয়ে যাবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি : অধিকাংশ সংসারে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত করে থাকে তৃতীয় পক্ষ। সেই পক্ষটা নিজের অতি নিকটজন হতে পারে, হতে পারে বাইরের কেউ। এই তৃতীয় পক্ষের কোনো কথায় কেউ কখনো কর্ণপাত করবে না। তা করেছো কি মরেছো।

তৃতীয় পক্ষের কাজ হলো সবসময় একের বিরুদ্ধে অপরের নিকট মিথ্যা ও বানোয়াটসব গল্প বলে কানভারি করা কিংবা শান্তি-সুখের সংসারে ভাঙ্গন সৃষ্টি করার জন্য আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো কুকর্ম করা। অতএব এই দুষ্টচক্র হতে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
সংসার সুখের এবং দাম্পত্য জীবন মধুর করতে হলে বিয়ের আগে এবং পরে এমনি ধরনের অনেক কাজ-ই করণীয় ও বর্জনীয়, যা এই স্বল্পপরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে সবাই নিজের শিক্ষা ও বুদ্ধি-জ্ঞান এবং অভিজ্ঞা দ্বারা বুঝতে পারা করণীয় কাজ করতে এবং বর্জনীয় কাজগুলো বর্জন করে চলতে পারলে সবার দাম্পত্য ও সংসারজীবনে কখনো অশান্তির আগুন জ্বলবে না। সংসারও ভাঙবে না। এই ব্যাপারে আমি একশতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারি।

একটি ভুল ধারণার অপনোদন : একসময় আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত ছিল, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।'

কিন্তু বর্তমানকালে সেই কথার গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা কোনোটাই নেই। এখন প্রচলিত হয়েছে, 'সংসার সুখের হয় উভয়ের গুণে।' কথাটা কিন্তু আমার নয়, এই অধমের স্ত্রীরত্নের। এই বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরি।

একসময় আমি পেশাদার সম্পাদক হিসেবে অন্যের রচিত বা অনূদিত বিভিন্ন বিষয়ের শত শত বইয়ের ভুল-ত্রুটি সংশোধন বা পরিমার্জনার কাজ করে দিয়েছি। এই কাজের অংশ হিসেবে ভারতের একজন বিদুষী ও মুত্তাকী মহিলার উদু ভাষায় লিখিত 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে' বইয়ের বাংলা অনুবাদের ভাষাগত এবং ব্যাকরণিক ভুল-ত্রুটি পরিমার্জনা করে দিয়েছিলাম। বইটি প্রকাশ হলে প্রকাশক প্রথা অনুযায়ী আমাকে একটি সৌজন্য কপি দিয়েছিল। আমি বইটি বাসায় নিয়ে এসে আমার স্ত্রীর হাতে দিলে সে তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিল এই আপ্তবাক্যটি 'সংসার সুখের হয় উভয়ের গুণে।'

স্ত্রীর কাণ্ড দেখে এবং কথা শুনে সেই সময়ে আমার গায়ে আগুন জ্বলে উঠলেও পরে তা নিয়ে অনেক ভেবে-চিন্তে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমার মহিয়ষী স্ত্রীর কথাটা যথার্থই। ফেলে দেয়ার মতো নয়। কারণ 'তুই দিলে আমি দেই, একা একা কত দেই?' এবং এক হাতে যেমন তালি বাজে না তেমনিভাবে একতরফা ভালো হলেও সংসার সুখের হয় না। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দু'জনেরই ভালো হতে হবে এবং ভূমিকা থাকতে হবে। তবে আমি দায়িত্বটা স্ত্রীর কাঁধে একটু বেশি এবং স্বামীর কাঁধে একটু কম চাপাতে চাই। পরিমাণটা হলো স্ত্রীর ৬০ এবং স্বামীর ৪০ ভাগ।

সবশেষে একটা দুষ্টবুদ্ধি : কোনো ছেলে যদি তার স্ত্রীকে 'ক্রীতদাসী' এবং কোনো মেয়ে যদি তার স্বামীকে 'ক্রীতদাস' বানিয়ে রাখতে চায়, সে যেন নিজের চেয়ে কম শিক্ষিত এবং বেশি দরিদ্রকে বিয়ে করে।

সমানে সমান হলে বাঁধবে লড়াই,
যার থেকে মুক্তির উপায় নাই।

- মোশাররফ হোসাইন সাগর

পঠিত : ৪০৬ বার

মন্তব্য: ০