Alapon

ফিরে দেখা পাকিস্তান : ক্বতল এ আম-এর দিনে 'ভদ্রলোক' দাদা ও দিদিরা (০১)




ফিরে দেখা পাকিস্তান : ক্বতল এ আম-এর দিনে 'ভদ্রলোক' দাদা ও দিদিরা (০১)
=================================
০১.
"... অল্পক্ষণ পরেই নানা গুজবে হস্টেলের আবহাওয়া গরম হয়ে উঠল। রাজাবাজার, কলুটোলা, পার্ক সার্কাসে নাকি হাজার হাজার হিন্দু খুন হয়েছে। কত হিন্দু মেয়ে যে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত হয়েছে তার সীমাসংখ্যা নেই। একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লােমহর্ষক সব কাহিনিতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোনও কর্মচারী রাখার মতাে সামর্থ্য বা প্রয়ােজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনােভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসাবে সত্যের আকর হয়ে উঠল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতিশ্রুতির স্থান অধিকার করল। শহরের সর্বত্র কী ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগল। যদি প্রশ্ন করা হত — এসব যে সত্যি তা তােমরা কী করে জানলে, তাহলে লােকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিত। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, কয়েক দশক ধরে বিপ্লব বা গণসংঘর্ষে গুজবের অবদান নিয়ে অনেক আলােচনা হয়েছে। যুক্তবঙ্গে দাঙ্গার ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাস '৪৬ সনের ঘটনায় গুজবের অবদান নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কোনও কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।

গুজবের সুফল কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বচক্ষে দেখতে হল। ন-দশ বছর বয়সি একটি মুসলমান ছেলে আমাদের পাড়ায় আম বিক্রি করতে আসত। সেদিনও একটু বেলা হলে ঝাঁকা মাথায় করে ছেলেটি এল। হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনলাম “মােছলমান! মােছলমান!” তারপর দৌড়ােদৌড়ির আওয়াজ। হস্টেলের বারান্দায় গিয়ে দেখি রাস্তায় ছােটখাটো একটি ভিড় জমেছে। তার মধ্যে বাঙালি ভদ্রলােকই সংখ্যায় বেশি। কিছু দরিদ্র বস্তিবাসীও আছে। সকলেরই হাতে লাঠিসােটা। একটা আর্ত চিৎকার কানে এল। তারপর সব চুপ। লাঠি হস্তে বীরবৃন্দ তখন পলায়নতৎপর। দেখলাম রােগা ছেলেটার অর্ধাহারক্লিষ্ট রক্তাক্ত শরীরটা রাস্তায় কুঁকড়ে পড়ে আছে। হিন্দু জাতি এবং কৃষ্টির সম্মান রক্ষা হয়েছে দেখে বড় গর্বিত বােধ করলাম। তাছাড়া শিক্ষিত বাঙালির মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথাটাও ভুললে চলবে না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি বলে কথা!

ওই ছেলেটা আমাদের হস্টেলেও আম বেচতে আসত। মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে কথা হত। বিধবা মাকে নিয়ে ও কলকাতার দক্ষিণে শহরতলির এক বস্তিতে থাকত। ওর রােজগারেই মা-ছেলের আহার জুটত। প্রতিবন্ধী মায়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু রােজগার করার মতাে ক্ষমতা ছিল না। সহায়সম্বলহীন ওসমানের কিন্তু উচ্চাশার অভাব ছিল না। একটু পয়সা জমাতে পারলেই ও নাকি গড়িয়াহাটের বাজারে একটা ফল-তরকারির দোকান খুলবে। ওর আরও একটা উচ্চাশা ছিল। মাঝে মাঝে ও আমাদের গান শােনাত। লাজুক লাজুক মুখে বলত, যখন একটু পয়সা হবে তখন ওর ইচ্ছা মাস্টার রেখে গান শিখবে। অবিনাশী আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না। করলে বলতাম, যদি নিস্পাপ অসহায় মানুষের জন্য ঈশ্বর নামক কোনও সত্তা স্বর্গ বা বেহেস্তের বন্দোবস্ত করে থাকেন, তা হলে আমার সহায়-সম্বলহীন ছােট ভাই ওসমানের জন্য সেখানে যেন একটা ফল-তরকারির দোকান খুলে দেন। আর যেন কোনও দেবদূত ওকে গান শেখায় তারও ব্যবস্থা করেন। আর ওসমান, নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত তােমার অমানুষ এই দাদাটি, তােমাকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টা করেনি। পারাে তাে তুমি তাকে ক্ষমা কোরাে। তােমাকে যে কথা দিয়েছিলাম তােমার গান শেখার খরচটা আমি দেব, সেই প্রতিশ্রুতি রাখার তাে আর পথ রইল না।

দিন যতই গড়াতে লাগল গুজবে গুজবে হাওয়া ক্রমেই গরম হয়ে উঠল। বিকেল নাগাদ নতুন এক রাজনৈতিক থিসিস কানে এল, 'অফেনস্ ইজ দা বেস্ট মিনস্ অফ ডিফেন্স’ অর্থাৎ “হে হিন্দু সন্তানগণ, খরকরবাল হাতে নিয়ে এবার তােমরা যবননিধনের জন্য প্রস্তুত হও।” হস্টেলের স্পাের্টস রুম থেকে সব হকি স্টিক বের হয়ে এল। দু-চারটে বন্দুক, কিছু গােলাগুলিও অজ্ঞাত কোনও উৎস থেকে সংগৃহীত হল। কোথা থেকে যেন বেশ কয়েক টিন কেরােসিনও জোগাড় হয়েছে দেখলাম। সংগ্রামী পুরুষদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বামপন্থী ছাত্রও আছেন দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। অন্য সকলের সঙ্গে কোনও আলােচনা তখন আর সম্ভব না। তাই আগ্রাসী হিন্দু বনে যাওয়া বামপন্থীদেরই শুধু প্রশ্ন করি নীতির কথা ছেড়ে দিলেও তারা যা করতে যাচ্ছে তাতে কার কী লাভ হবে। উত্তর পেলাম মুসলমান খুন হচ্ছে এই খবর যথাস্থানে পৌঁছলে হিন্দু হত্যা বন্ধ হবে। বললাম — হিন্দু হত্যার খবর বা গুজব যথাস্থানে পৌঁছনাের ফলে তাে তােমরা মুসলমান মারার জন্য উদ্যোগী হয়েছ। মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া তােমাদের থেকে ভিন্ন হবে মনে করছ কেন? উত্তর — এখন কাজের সময়। বাজে কথা শােনার তাদের অবসর নেই।

অন্ধকার একটু ঘন হওয়ার পর আসল কাজ শুরু হল। বেশ ভাল করে খাওয়াদাওয়া সেরে বীরবৃন্দ রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। হাতে কেরােসিনের টিন এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। ভাবলাম আমাদের পাড়ায় তাে মুসলমান নেই। তবে বীরকৃত্যটা এঁরা কোথায় করবেন? পার্ক সার্কাস বা রাজাবাজার অভিযান করে শত্রুর সঙ্গে মােকাবেলা হবে? না, না! অকারণ ঝক্কি নেওয়ার লােক এঁরা না। আর একটু রাত বাড়লে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি তুলে সশস্ত্র যােদ্ধারা সার্কুলার রােড পার হয়ে রাস্তার পাশের মুসলমান বস্তি আক্রমণ করলেন। ওখানকার হতদরিদ্র বাসিন্দারা কোনও হিন্দুকে হত্যা করেনি অথবা কোনও হিন্দু নারীকে লাঞ্ছনা করেনি। দুষ্কর্মের মধ্যে তাদের কেউ কেউ সকালবেলার মিষ্টান্ন লুণ্ঠনে শরিক হয়েছিল। কাজটা গর্হিত সন্দেহ নেই কিন্তু তার জন্য প্রাণদণ্ডটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।

আমার চেনা হিন্দু বীরবৃন্দ কওমের সেবায় কী মহৎ কর্ম করেছিলেন তা আমার সঠিক জানা নেই। কিন্তু তাঁরা যখন বীরকৃত্য সেরে ফিরে এলেন, তখন তাঁদের মুখভাবে উদ্দীপ্ত গৌরবের কোনও লক্ষণ দেখিনি। বরং তাঁদের দেখে যে প্রাণীটির কথা মনে এসেছিল সে পশুরাজ সিংহ না, গৃহস্থের তাড়া খাওয়া লেজ গুটিয়ে পলায়মান রাস্তার কুকুর।

... ক্রমে ক্রমে আরও সব বীভৎসতার কাহিনি এল। রাজাবাজারে পােস্ট-গ্র্যাজুয়েট হস্টেলের ছ'টি ছেলে খুন হয়েছে শুনলাম। একজন ক্ষতবিক্ষত হয়েও বেঁচে ছিল। আমার পিসতুতাে দিদির বাড়িতে আক্রমণের কথা আগেই লিখেছি। নানা খুনজখম বলাৎকারের কাহিনি চারিদিক থেকে আসতে থাকে। তার কিছু সত্যি, অধিকাংশই মিথ্যা। বীভৎস সব কাহিনি রটিয়ে কিছু লােক এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়। তার চেয়েও অবাক হলাম যখন দেখলাম কয়েকজন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত লােক মুসলমানদের উপর নানা অত্যাচারের সত্যি বা কল্পিত কাহিনি বলে বা শুনে বিশেষ আনন্দ পাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে দু-তিনজন রীতিমতাে বিখ্যাত লােক। প্রয়াত এক পণ্ডিত ব্যক্তি, যাঁর নাম শুনলে অনেক নিষ্ঠাবান হিন্দু এখনও যুক্তকরে প্রণাম জানায়, তাঁকে এবং সমবেত অধ্যাপকদের কাছে নিকাশিপাড়ার মুসলমান বস্তি পােড়ানাের কাহিনি বলা হচ্ছিল। যিনি বলছিলেন তিনি প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিশ্বাসযােগ্য লােক। বেড়া আগুন দিয়ে বস্তিবাসীদের পুড়িয়ে মারা হয়। একজনও নাকি পালাতে পারেনি। ছেলেটি বলছিল কয়েকটি শিশুকে আগুনের বেড়া টপকে তাদের মায়েরা আক্রমণকারীদের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে ওদের প্রাণগুলি বাঁচে। বাচ্চাগুলিকে নির্দ্বিধায় আবার আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। আমরা শুনেছিলাম, এই কুকীর্তির নায়ক কিছু বিহারি কালােয়ার। তাই ভয়াবহ বর্ণনাটি শুনে সুশােভনবাবু মন্তব্য করেন, “এর মধ্যে নিশ্চয়ই বাঙালি ছেলেরা ছিল না?” শুনে সেই পণ্ডিতপ্রবর গর্জে উঠলেন, “কেন, বাঙালি ছেলেদের গায়ে কি পুরুষের রক্ত নেই?” আমি বরিশালের বাঙাল। ফলে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ভেবেছিলাম প্রশ্ন করি, “বরাহশাবক, তােমার ধমনীতে কোন্ জানােয়ারের রক্ত, একটু বলবে?” কিন্তু সব সদিচ্ছা পূর্ণ হয় না। কী আর করা যাবে॥"
— তপন রায় চৌধুরী / বাঙালনামা ॥ [ আনন্দ পাবলিশার্স - মে, ২০০৯ । পৃ: ১৫২ - ১৫৬ ]


০২.
"... দাঙ্গার কথা আর লিখব না। ওই কলঙ্কের বিবরণ দেওয়াও যায় না। কিন্তু আমার একটা ধারণা ছিল — মেয়েরা এর মধ্যে নেই। তারা এ হিংস্রতা বােধহয় সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বালিগঞ্জ পাড়া আমার এ ধারণা পাল্টে দিয়েছিল। রাস্তাটার নাম বলব না। ফার্ন রােড থেকে রাসবিহারীর ট্রাম লাইনে আসতে দুপুর বেলা ঐ রকম একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছি। দেখলাম সেখানে একটা চাঞ্চল্য। বাড়িগুলাের উপরতলা থেকে মহিলারা রাস্তায় দাঁড়ানো পুরুষদের হাতে লাঠি ফেলে দিচ্ছে। কি ব্যাপার? না, মুসলমান আসছে। আমি ভাবলাম বােধহয় মুসলমানরা দল বেঁধে আক্রমণ করতে এসেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু ভয়ও পেলাম। ও হরি, শুনলাম একটা লুঙ্গি পরা লােককে মুসলমান ভেবে পাড়াময় এই উত্তেজনা। পরে লােকটির পরিচয় পেয়ে সবাই আশ্বস্ত হলো। আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। একটা মাত্র লােককে নিকেশ করতে তাে কয়েক শো বীর পুরুষ দাঁড়িয়ে গেছেন। কিন্তু মেয়েরা এই ব্যাপারে স্বামী-পুত্রদের ঠেকানাের চেষ্টা না করে উল্টে কি করে লাঠি এগিয়ে দিচ্ছেন? দাঙ্গার মত্ততা মানুষকে এতখানি নীচুতে টেনে নামায়? নারী-হৃদয়ের স্বাভাবিক কোমলতাও উধাও হয়ে যায়?"

— মণিকুন্তলা সেন / সেদিনের কথা ॥ [ নবপত্র প্রকাশন - শ্রাবণ, ১৩৫৯ । পৃ: ১৭৪-১৭৫ ]

-কায় কাউস

পঠিত : ৪৪২ বার

মন্তব্য: ০