Alapon

সেশনজট ও বাটারফ্লাই ইফেক্ট: দুষ্ট বিশ্লেষণ



একাডেমিক পড়াশোনার বাহিরের জ্ঞানে পদচারণা নেই এমন খুব কম লোকই ’বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ সম্পর্কে জানেন। আমিও না জানাদের দলের। পড়াশোনা করা শিক্ষার্থী আমি নই। ঘুম ব্যতিত জাগতিক কোনো বিষয়কে ভালোবাসি বলে মনে হয়না। আমি সিঙ্গেল হলেও অলসতা আমার অর্ধাঙ্গিনীর মত জীবনসঙ্গী। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে দর্শন পড়তে বসলাম। দেখা হলো দর্শন শাস্ত্রের ক্যাজুয়াল থিওরি তথা কার্যকারণ তত্ত্বের সঙ্গে। তা হলো কার্যের সঙ্গে কারণের সম্বন্ধ। আমরা কার্য প্রত্যক্ষ করি, কিন্তু সেই কার্যের কারণ কী এবং সেই কারণের সঙ্গে ঐ কার্যের সম্বন্ধ কী ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করতে পারি না। দর্শন শাস্ত্রের এই ক্যাজুয়াল থিওরি আলোকে ঘটনার পিছনের ঘটনা, প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন, কার্যের সাথে কারণের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে দেখা হলো বাটারফ্লাই ইফেক্টের সাথে। মনে মনে ভাবলাম ক্ষুদ্র প্রজাপতি এমন কি অপরাধ করলো যে দর্শন শাস্ত্রের মারাত্মক এই থিওরিতে প্রজাপতিকে টেনে আনলো। কৌতুহল থেকে ডুবে পড়লাম এই তত্ত্বে। দেখলাম আসলেই প্রজাপতি অনেক বড় অন্যায় করে বসেছে। আমাজনের একটি প্রজাপতির পাখার বাতাসে আমেরিকার টেক্সাসে ঘূর্ণিজড় বয়ে গেলো।

‘আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’ এর ১৩৯ তম অধিবেশনে গণিতবিদ এবং আবহাওয়াবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ একটি বিশেষ প্রশ্নের উত্থাপন করেছিলেন। প্রশ্নটি ছিলো এমন যে, ব্রাজিলে যদি কোনো একটি প্রজাপতি তার ডানা ঝাপটায়, তবে সেই ডানা ঝাপটানোর সুবাদে টেক্সাসে টর্নেডো হতে পারে কি না? প্রশ্নটি শুনে অনেকেই এডওয়ার্ড লরেঞ্জকে মানসিক বিকারগ্রস্ত সাব্যস্ত করতে পারেন। কারণ- প্রথমত, প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর কারণে আর যা-ই হোক, টর্নেডো হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যদি টর্নেডো হয়েই থাকে, তবে ব্রাজিলে না হয়ে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে হবে কী করে! কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর আমরা যা জানি, তা নাও তো হতে পারে। প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর কারণে টর্নেডো হতেও পারে। আসলে এই অদ্ভুত তত্ত্বকেই ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ বা প্রজাপতি প্রভাব বলা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড একদিন অনেক গুলো তথ্য নিয়ে আবহাওয়া পূর্বাভাস হিসাব করছিলেন। তিনি হিসাব নেয়ার সময় দশমিকের পর প্রথমে তিন ঘর এবং পরে ছয় ঘর নিয়ে হিসাব করলেন। তারপর তিনি দেখলেন যে দুইটা হিসাবের উত্তর একদম ভিন্ন। অর্থাৎ দশমিকের পর মাত্র তিন ঘর অংকের পার্থক্য পুরো আবহাওয়ার পূর্বাভাস পরিবর্তন করে ফেলতে সক্ষম। এথেকেই পরবর্তীকালে তিনি ক্যাওস থিওরী তথা বিশৃঙ্খলতার তত্ত্ব এবং বাটারফ্লাই ইফেক্ট এর আবিষ্কার করেন।

বাটারফ্লাই ইফেক্টের মূল কথা হলো সামান্য বিশৃঙ্খলা অনেক বেশি পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম। বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন এই বাটারফ্লাই ইফেক্টকে একটু কবিত্ব দিয়ে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে,
"একটি পেরেকের অভাবে জুতা ব্যবহার হলো না
জুতার অভাবে ঘোড়াও চলতে পারলো না
ঘোড়ার অভাবে ঘোড়ার সহিসও থাকলো না
ঘোড়ার সহিসের অভাবে যুদ্ধে জেতা গেলো না
যুদ্ধে হারার কারণে রাজত্ব হারিয়ে গেলো
শুধুমাত্র ঘোড়ার জুতার একটি পেরেকের অভাবেই এতকিছু হলো। পেরেকের অভাবে হারিয়ে গেলো রাজত্ব"।

আশাকরি এতদ বর্ণনা উপস্থাপনের পর বাটারফ্লাই ইফেক্ট নিয়ে কারো বুঝতে বাকি থাকার নয়। এবার আসুন বাটারফ্লাই ইফেক্টের সাথে সেশনজটের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক দেখি। আমরা সকলেই জানি সেশনজট মানেই শিক্ষাব্যবস্থার বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থা। সামান্য ঘোড়ার জুতার পেরেকের অভাবে যেমনি ভাবে রাজত্ব হারিয়ে যায় তেমনি ভাবে সেশনজটের কবলে শিক্ষার্থীদের জীবন বিশৃংখল হয়ে যায়। এমনকি সেশনজটের কারণে মহাবিশ্ব যুদ্ধ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। মনে করুন, আপনি মেধাবী ও সম্ভাবনাময়ী শিক্ষার্থী। সেশনজটের কবলে আপনার জীবন থেকে অনেক সময় হারিয়ে গেলো। আপনি হতাশায় বিমূর্ত হলেন। পারিবারিক দুঃখ-দুর্দশা ও অর্থনৈতিক দৈন্যতা, বিয়ের জন্য প্রেমিকার চাপ, সমাজের মানুষের বিরূপ মন্তব্য ইত্যাদি সইতে না পেরে আপনি আত্মহত্যা করলেন। আপনার প্রেমিকা এটা মেনে নিতে পারেনি, সে পাগল হয়ে গেলো। প্রেমিকার বাবা মেয়ের কষ্ট মেনে নিতে না পেরে শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে চলে গেলেন। এই সুযোগে কিছু মহল অপতৎপরতা চালালো। দেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো। বিদ্রোহে পাকিস্তানের নাগরিক মারা গেলো। পাকিস্তান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলো। পাকিস্তানের জাত শত্রু ভারত সুযোগ বুঝে এতে বাঁধ সাধলো। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তিন দেশে চরম উত্তেজনা। নতুন করে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিলো। আমেরিকা নিলো ভারতের পক্ষ। ইউক্রেন ইস্যু নিয়া রাশিয়া আমেরিকার উপর ক্ষিপ্ত হওয়ায় পাকিস্তানের সাথে জোট বাঁধলো। লেগে গেলো মহাবিশ্ব যুদ্ধ। আচ্ছা, এই মহা বিশ্ব যুদ্ধের কারণ কি? নিশ্চয়ই শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপনার প্রেমিকার বাবার গড়ে তোলা আন্দোলন। আচ্ছা, আন্দোলনের কারণ কি? নিশ্চয়ই আপনার প্রেমিকার পাগল হয়ে যাওয়া। আপনার প্রেমিকার পাগল হওয়ার কারণ কি? নিশ্চয়ই আপনার আত্মহত্যা। আর আপনার আত্মহত্যার কারণ কি? নিশ্চয়ই হতাশা। আচ্ছা হতাশার কারণ কি? নিশ্চয়ই সেশন জট। আচ্ছা সেশনজটের কারণ কি? নিশ্চয়ই..........। আচ্ছা.........? নিশ্চয়ই...........। আচ্ছা..........? নিশ্চয়ই.........?

এখন আসুন, কার্যকারণ তত্ত্বের দিকে যাই। পৃথিবীতে যে ঘটনাই সংঘটিত হোক না কেন, তার অবশ্যই কোন না কোন কারণ বিদ্যমাণ আছে। কথায় আছে, বিনা বাতাসে গাঙ্গের জল নড়ে না। সুতরাং সহজেই বলা যায় যে বিনা কারণে কোন কার্যের উদ্ভব হয় না। চৈত্রের ১২ তারিখ। দিনভর ঠাঁ ঠাঁ রোদ। রাতের আকাশে তারা ঝিলমিল। কোথাও মেঘ নাই; নেই বৃষ্টির ছিটেফোঁটা। অথচ উত্তরবঙ্গীয় জেলা কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ে পানিতে প্লাবিত হয়ে বিপাকে জনজীবন। কথা হলো আকাশে মেঘ নাই, কোথাও বৃষ্টি নাই; কিন্তু পানি আসলো কোত্থেকে? নিশ্চয়ই এর কোনো কারণ আছে। কিন্তু কি সে কারণ? ইহার কারণ ভারতের তিস্তা নদীতে বন্যা হয়েছে, সে বন্যার পানি উত্তরবঙ্গীয় জেলা সমূহে প্লাবিত হচ্ছে। আচ্ছা, হঠাৎ করে তিস্তা নদীতে এতো পানি আসার কারণ কি? ইহার কারণ হলো হিমালয়ের পাদদেশে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে; সেই অতিবৃষ্টির ফলে তিস্তাতে বন্যার দেখা দিয়েছে। এখন জানার বিষয় হলো, হিমালয়ের পাদদেশে এতো বৃষ্টির কারণ কি? এর কারণ হলো, বঙ্গোপসাগর থেকে মেঘ এসে হিমালয়ে জমা হয়েছে; সেই মেঘ থেকে বৃষ্টির সূত্রপাত। এই ভাবে কারণ খুঁজতে গেলে কারণের পর কারণ আসবে; সে সকল লিখতে গেলে পৃথিবীর সকল কি-বোর্ড ক্ষয় হয়ে যাবে তবুও কারণ লেখা শেষ হবে না।


পরিশেষে আসুন মূল আলোচনায় যাই। এই যে আমরা সেশন জটের জন্য স্যারদের দোষারোপ করি ইহা আসলে কার্যকারণ তত্ত্বের আলোকে সঠিক নয়। আপনারা স্যারদের অবহেলার কারণে সেশনজট হয় বলে মনে করেন। কিন্তু কথা হলো স্যারদের অবহেলার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে আবার সে কারণেরও কোনো কারণ রয়েছে। কারণের পিছনে কারণ থাকবেই থাকবে। সুতরাং স্যারদের দোষ না দিয়ে সেশনজটকে অনাবস্থা দোষে দুষ্ট বলে ধরে নেই (যদিও তা সম্ভব না)। আর হ্যাঁ, সেশনজটের হতাশা থেকে আত্মহত্যা করে ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে বিশ্ববাসীকে মহা-বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিবেন না।

পঠিত : ২৯০ বার

মন্তব্য: ০