Alapon

ইমামুল হাদিস ওয়াত তাফসির শায়খ বাক্বী ইবনে মাখলাদ রহিমাহুল্লাহ...



সুদূর আন্দালুস থেকে থেকে সফর করে এক ব্যক্তি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে এলেন। উদ্দেশ্য, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ'র কাছে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস শিখবেন। তিনি তাঁর যুগের শ্রেষ্ট হাদিস বিশারদ হিসেবে ইমাম আহমাদের নাম শুনতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়েন। বাগদাদের উদ্দেশ্যে আন্দালুস ত্যাগ করার প্রাক্কালে তাঁর হাতে তেমন কোনো পয়সাকড়ি ছিল না। কিন্তু ইলম তলবের অদম্য চাহিদা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারল না। তিনি আন্দালুস থেকে হেঁটেই রওয়ানা দিলেন। হেঁটে হেঁটেই বাগদাদ এসে গেলেন!

এই ব্যক্তি আর কেউ নন। তিনি হলেন, আন্দালুসের বিখ্যাত আলিম, ইমামুল হাদিস ওয়াত তাফসির শায়খ বাক্বী ইবনে মাখলাদ রহিমাহুল্লাহ। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত বলছি একটু পর। আগে গল্পটা শেষ করি...

তো বাক্বী ইবনে মাখলাদ যখন বাগদাদে এসে পৌঁছলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র পঁচিশ বছর। বাগদাদ তখন আব্বাসী খিলাফতের রাজধানী। খিলাফতের মসনদে সমাসীন হয়ে আছে আব্বাসী খিলাফতের প্রতাপশালী, যুলুমবাজ অজ্ঞ খলিফা মু্'তাসিম বিল্লাহ। মু'তাসিম বিল্লাহ নিজে পড়ালেখা বিশেষ জানত না। সে টিকে ছিল সেনাশক্তির উপর ভর করে। কিন্তু নিজে পড়ালেখা না জানলে কী হবে! আলিমদের উপর নির্যাতনে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। বাক্বী ইবনে মাখলাদ বাগদাদে এসে শুনতে পেলেন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। তার দরস-তাদরিসের উপর দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তাঁর অপরাধ, তিনি খলকে কুরআনের ফিতনায় খলিফার সুরে সুর মেলাননি। খলিফার আক্বিদার সাথে দ্বিমত করায় ইতিপূর্বে তাঁকে দুবছর কারাগারে রাখা হয়েছে। মু'তাসিমের নির্দেশে তাঁকে উদোম গায়ে ত্রিশ ঘা চাবুক মেরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আটাশ মাস তাঁকে বন্দী করে রেখে অবশেষে তাঁকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এমনিতেও ইমাম আহমাদ খলিফা মামুনের যুগের শেষ সময় থেকে নানাভাবে পরীক্ষিত হয়ে এসেছেন। নির্যাতন সয়েছেন মু'তাসিম বিল্লাহ, ওয়াসিক বিল্লাহর সময়েও। খলিফা মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ'র সময়ে এসে তিনি মুক্ত হন। মুতাওয়াক্কিল আহলুস সুন্নাহ'র আক্বিদার অনুসারী ছিলেন বিধায় ইমাম আহমাদের উপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

বাক্বী ইবনে মাখলাদ মু'তাসিম বিল্লাহর মৃত্যুর কিছুকাল আগে বাগদাদা এসেছিলেন। মু'তাসিম বিল্লাহ মারা যায় ২২৬/২২৭ হিজরি সনে। তো বাক্বী ইবনে মাখলাদ বাগদাদ এসে শুনতে পেলেন, ইমামকে কারো সাথে মিশতে দেয়া হয় না, কথা বলতে দেয়া হয় না। কিন্তু হাদিস যে শিখতে হবে! কী করা যায় ভাবতে লাগলেন। ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধিও বের করলেন।

এরপর তিনি বাগদাদের এক সরাইখানার একটি কক্ষ ভাড়া নিলেন। সবকিছু গুছিয়ে বাগদাদের আরেক প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রহিমাহুল্লাহ'র দরসে বসে পড়লেন। দরস শেষে তিনি ইমাম আহমাদ হাম্বলের ব্যাপারে ইয়াহইয়া ইবনে মাঈনকে প্রশ্ন করলেন। ইমামের ব্যাপারে তার অভিমত কী তা জানতে চাইলেন। প্রশ্ন শুনে ইবনে মাঈন আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'আপনি ইমামকে চেনেন না? আমরা ইমামের তুলনায় কিছুই নই। তিনি মুসলমানদের ইমাম! উম্মাহর শ্রেষ্টতম ব্যক্তি!'

এরপর বাক্বী ইবনে মাখলাদের মুখেই শুনুন:
'ইবনে মাঈনের একথা শুনে আমি ইমাম আহমাদের ঘরের ঠিকানা জানতে চাইলাম। আমাকে ঠিকানা দেয়া হলে আমি ইমামের বাড়ি পৌঁছে দরজায় টোকা দিলাম। ইমাম বেরিয়ে এলে আমি বললাম, 'হে আবু আব্দুল্লাহ! আমি এক আগন্তুক। এই দেশে প্রথম এসেছি। আমার একটা আশ্রয় দরকার। তাছাড়া আমি হাদিস শিখতে এসেছি। এতদূর থেকে সফর করে কেবল আপনার কাছেই এসেছি।'

তিনি আমায় এদিকওদিক তাকিয়ে চুপিসারে ঘরের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। এরপর বললেন,
-কোথা থেকে এসেছো বাছা?
-সুদূর পশ্চিম থেকে।
-আফ্রিকা থেকে?
-আফ্রিকা থেকেও অনেক দূরে আমার বাড়ী। আফ্রিকার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দালুস থেকে থেকে এসেছি।
সব শুনে ইমাম বললেন,
'বাবা! বুঝতে পারছি অনেকদূর থেকে এসেছো। তোমার মত উদ্দেশ্য নিয়ে আগমনের চেয়ে আনন্দকর আমার জন্য আর কিছু নেই। কিন্তু আল্লাহ আমাকে পরীক্ষায় ফেলেছেন, তা তুমি হয়ত শুনতে পেয়েছ।'

আমি বললাম,
'তা আমি জানি। কিন্তু একটা বুদ্ধি আমি বের করেছি। আমি যেহেতু এদেশে নতুন তাই কেউ আমায় চেনে না। আপনি অনুমতি দিলে আমি প্রতিদিন ভিক্ষুকের বেশে ছেঁড়া জামা গায়ে, থালা হাতে আপনার বাড়ী এসে দরজায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষুকের মত কথাবার্তা বলব। আপনি দরজায় এসে ভিক্ষা দেয়ার ছলে প্রতিদিন একটা হাদিস শোনাবেন। তা-ই আমার জন্য যথেষ্ট।'

ইমাম রাজী হলেন। তবে একটা শর্ত দিলেন। তা হলো, কোনো হালাকায় এই হাদিস ইমাম আহমাদের রিওয়ায়াতে বর্ণনা করা যাবে না, বাগদাদের অপরাপর মুহাদ্দিসগণকেও শোনানো যাবে না। আমি শর্ত মেনে নিলাম। এরপর থেকে প্রতিদিন ছেঁড়া কাপড়ে মাথা ঢেকে হাতে একটা লাঠি নিয়ে ইমামের বাড়ী গিয়ে বলতাম,
'আল্লাহর নামে কিছু দিন আমায়'
ইমাম বেরিয়ে এসে আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দুইটা তিনটা হাদিস শোনাতেন। কাপড়ের হাতায় লুকিয়ে রাখা দোয়াত কালির সাহায্যে আমি সেগুলো লিখে নিতাম।'
এভাবে মু'তাসিমের মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইমাম আহমাদের কাছে হাদিস শেখেন বাক্বী ইবনে মাখলাদ রহিমাহুল্লাহ। খলিফা মুতাওয়াক্কিলের যুগে অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে ইমাম আবার হাদিসের মসনদে বসে যান। তিনি বাক্বী ইবনে মাখলাদের ইলম তলবের এই সবরে যারপরনাই সন্তুষ্ট ছিলেন। দূরদূরান্ত থেকে তাঁর কাছে ইলম পিপাসুরা আসত। সকলে তাঁকে ঘিরে রাখত। কিন্তু বাক্বী ইবনে মাখলাদ যখনই ইমামের দরসে যেতেন, ইমাম সবাইকে সরিয়ে তাঁকে জায়গা করে দিতেন সামনে আসার। সবাইকে শোনাতেন বাক্বী ইবনে মাখলাদের গল্প।

প্রিয় পাঠক! এই ঘটনা যখন লিখছি, আমার হাত কাঁপছে। শরীর পশম দাঁড়িয়ে গেছে। ইলমের জন্য কি ত্যাগ, কি অনুপম নজিরটাই না শায়খ বাক্বী ইবনে মাখলাদ রহিমাহুল্লাহ স্থাপন করেছেন! কল্পনা করা যায় বলুন তো! অথচ আমাদের কত গাফলতি, কত অজুহাত!
বাক্বী ইবনে মাখলাদ রহিমাহুল্লাহ'র ইলমী রিহলাহ অনেক বিস্তৃত। ক্ষেত্র বিশেষে সিহাহ সিত্তাহর ইমামগণের চেয়েও বিশাল। ইবনে হাযম বলেন, 'আমরা যখনই বাক্বী ইবনে মাখলাদের নাম নিই, তখন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, মুসলিম বিন হাজ্জাজ নিশাপুরী, সুলাইমান ইবনে আশআছ সাজিস্তানী (আবু দাউদ), আহমাদ ইবনে শুআইব আন নাসাঈ'র সাথেই কেবলমাত্র তাঁর তুলনা করি।'

বিশিষ্ট ফকিহ মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল হাদী আল মাক্বদিসী (মৃত্যু: ৭৪৪ হিঃ) 'ত্বাবাকাতে উলামায়িল হাদিসে' লিখেছেন, 'বাক্বী ইবনে মাখলাদের গুণের শেষ নেই। তিনি দুআ করলে দুআ কবুল হত। কথিত আছে, তিনি প্রতিরাতে তের রাকআত নামাজে পুরো কুরআন খতম করতেন। পুরো সপ্তাহ রোজা রাখতেন। সত্তরটি যুদ্ধে তিনি শরীক হয়েছেন।'

আল্লাহু আকবার! আমাদের আলিমগণ ইলমের পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রেও অনন্য ছিলেন। আজ আমরা কোথায়?

আরো শুনুন বাক্বী ইবনে মাখলাদের কথা...
ঐতিহাসিক ইবনে হাইসামা (মৃত্যু:২৭৯ হিঃ) বলেন,
'আমরা ইবনে মাখলাদকে 'ঝাড়ু' বলতাম। কারণ, ঝাড়ু যেমন ঘরের কোনোকিছু বাদ রাখে না, তেমনি ইবনে মাখলাদও যেখানে যা ইলম পেয়েছেন, কুড়িয়ে নিয়েছেন। নইলে তাঁর মত ব্যক্তি আন্দালুসে থাকতে ইরাকে ইলম শিখতে আসার কী প্রয়োজন ছিল?'

আন্দালুসের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনুল ফারযী (মৃত্যু: ৪০৩ হিঃ) বলেন,
'বাক্বী ইবনে মাখলাদ আন্দালুসে অমর হয়ে রয়েছেন হাদিসের কারণে।'
বাক্বী ইবনে মাখলাদের তাফসীরের ব্যাপারে ইবনে হাযম বলেন,
'বাক্বী ইবনে মাখলাদ এমন তাফসীর রচনা করেছেন, যার সমকক্ষ তাফসীর আর কেউ রচনা করেননি। এমনকি ইমাম ইবনে জারির আত তাবারী কিংবা অন্যরাও নন।'
ইমাম বাক্বী ইবনে মাখলাদের ইলমী রিহলাহ লোমহর্ষক। হায়াত তিনি বেশিদিন পাননি। কিন্তু ইলম তলবে সফর করেছেন পুরো জীবনজুড়ে। তাঁর প্রথম রিহলাহ শুরু হয় ২২৪ হিজরি সনে। যা শেষ হয় ২৪৪ হিজরি সনে। বিশ বিশটা বছর!

দ্বিতীয় রিহলাহ কবে শুরু হয় তা জানা যায় না। কিন্তু সেটা শেষ হয়েছে চৌদ্দ বছর পর!
মোট চৌত্রিশ বছর তিনি শুধু ইলম শিখেছেন। পুরো যৌবনকালটা তিনি এক আলিম থেকে অন্য আলিমের দরসে দরসে কাটিয়েছেন। কথিত আছে, তিনি প্রতিবছর ইলমী রিহলাহ শুরু করতেন মহররম মাসে। হজ্বের সময় সেটা শেষ হত। এরপর হজ্ব করে নিজ দেশে ফিরতেন। ইলম শিখতে তিনি তিউনিসিয়া, মিশর, কুফা, বাগদাদসহ চষে বেড়িয়েছেন বহু এলাকা।

ইমাম বাক্বী ইবনে মাখলাদ হাদিস বর্ণনা করেছেন দুইশত চুরাশিজনের চেয়েও অধিক রিজাল থেকে। এদের মধ্যে কেউই দূর্বল রাবী ছিলেন না। প্রত্যেকেই প্রসিদ্ধ এবং গ্রহণযোগ্য আলিম ছিলেন। এবং তাঁর রচিত হাদিস গ্রন্থ 'মুসনাদে বাক্বী ইবনে মাখলাদ' মুসনাদে আহমাদের চেয়েও বড়! মুসনাদে আহমাদ বিশখণ্ডে ত্রিশহাজার হাদিসের সংকলন। অন্যদিকে মুসনাদে বাক্বী ইবনে মাখলাদের হাদিস সংখ্যা ত্রিশহাজার নয়শত উনসত্তর! তিনি দুইশত চুরাশিজন শায়খের কাছ থেকে একহাজার তেরজন সাহাবির বর্ণিত হাদিস পেয়েছিলেন। সুবহানাল্লাহ!

তিনি সাহাবিদের সংখ্যার ভিত্তিতে বর্ণিত হাদিস একত্রিত করেছিলেন। কোনো একটি সহস্রাধিক সাহাবির বর্ণিত হাদিস, অপর কোনোটি এক হাজার সাহাবির বর্ণিত হাদিস, একশত জনের বর্ণনা, দশজন, নয়জন, একজন এভাবে...

বাক্বী ইবনে মাখলাদ রহিমাহুল্লাহ'র কীর্তিময় জীবনের বিস্তৃত শেষ করার মত নয়। তিনি কেবল আলিম ছিলেন না। ছিলেন একজন যুহদ ও পরহেজগারিতারও ইমাম। যখনই দুআ করতেন, আল্লাহ কবুল করতেন তাঁর দুআ। এরাই আমাদের ইতিহাস, আমাদের নক্ষত্র। কবির ভাষায়,
أولئك آبائي فجئني بمثلهم
'এরাই তো আমার পূর্বপুরুষ! পারলে দেখি দেখাও তোমাদের এমন কে আছে!'
বাক্বী ইবনে মাখলাদ ২৭৬ হিজরি সনে ইন্তিকাল করেন। রহিমাহুল্লাহ।

তথ্যসুত্র-
[১] তারিখুল উলামায়িল উন্দুলুস (১/১০৮): ইবনুল ফারাযী
[২] সিয়ারু আলামিন নুবালা (১৩/২৯২): ইমাম যাহাবী
[৩] রাসায়িলু ইবনে হাযম আল উন্দুলুসী (২/১৭৮): ইবনে হাযম

পঠিত : ৯৮২ বার

মন্তব্য: ০