Alapon

বাবা যেন বেঁচে থাকেন একশত বছর...



বাবা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে। আমাদেরও ডেকে দেয়। আমরা চোখ কচলাতে কচলাতে ক্ষেতে যাই। বাবা দুধ বেচতে বাজারে যায়। ফেরার সময় আলু, ধনেপাতা, ডাল, ডিম, সবজি কেনে। কখনো কখনো মাছ কেনে।বাবা মাছ বেছে কিনতে পারে না। মা রাগ করে মাছ কুটে না!

বাবা নিরবে কিছু খেয়ে মাঠে চলে আসে।শিশির মাখা শীতের সকালে আমরা পেয়াজ, রসুন লাগাই। বাবা সার দেয়, পানি দেয়। রোদ উঠলে আমরা ভাইয়েরা বাড়ি ফিরি। স্কুল ,কলেজে যে যার ভুবনে যাই। বাবা রোদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যায়।

কখনো কখনো বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাবা বাড়ি ফেরে না। গোয়ালের গরুগুলো বাবার অপেক্ষায় থাকে। একসময় উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকাডাকি করে। বাবা আসলে তাদের দানাপানি হবে। সন্ধ্যার আলো- আধারী তে বাবা এক বোঝা ঘাস সমেত দ্রুত পদে আসে।
দেখতে দেখতে পেয়াজ, রসুন বড় হয়ে যায়। বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।খেতভরা ধনে, মসুরি, কালোজিরা, কলাই। বৃষ্টি আসলে সব শেষ! কখনো কখনো বৃষ্টি আসে। বাবা নিরব হয়ে যায়। বৃষ্টির আগে যখন আমরা ফসল ঘরে তুলি। মা গভীর রাত পর্যন্ত ঘুমে ঢুলে ঢুলে কাজ করে।

চৈত্র মাসের পয়লা ই আমরা পাট বুনি। সোনালী আশ!আগাম পাট হলে বর্ষা মৌসুমে এক খন্দ ধানও বোনা যায়। আউশ, আমন আরও কত কি! পাট নিয়ে বাবা খুব উদ্বিগ্ন থাকে।
একবার পাট বিক্রি করে আমার জন্য একটা উলের সোয়েটার কিনতে গিয়ে বাবা ৩০০ টাকা হারায়। পকেটমার বাবার পকেট কেটে টাকা নিয়ে পালিয়েছে। বাবা শুকনো মুখে আমার হাতে সোয়েটার দিতে দিতে এই গল্প বলে। আমি কচু ও ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল বাবার অবস্থা দেখে।

বর্ষাকালে বড় ভাই মাঝে মাঝে পাতিল ভরে মাছ ধরে আনে। কৈ, শিং,পুটি, বেলে, বাইনসহ আরও হরেক রকম মাছ। বাবা মাছ দেখে হেসেই কুটিকুটি। মা ধুন্দল দিয়ে রান্না করে।
বাবা বৃষ্টির মধ্যে আমাদের গজল শোনায়। সাত গ্রামের বাদশা ছিল শাহা সিকান্দার..... বাবার গলার সুর ভালো।

মাঝে মাঝে আমাদের গল্প শোনাত।বাবা খুব বেশি গল্প জানত না। একটা ইঁদুর আর বিড়ালের গল্পই বলত বেশি। আমাদের চিরচেনা গল্প। তারপরও বাবাকে খুশি করতে আমরা আগ্রহী শ্রোতার ভাণ ধরে শুনতাম।

বর্ষা শেষে জমিতে পলি মাটি জমা হয় । বাবা কলই, কালাই নিয়ে নেমে পড়ে। তারপর ধান, পেয়াজ, রসুন, মসুরি, পাট চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।

শরতে ময়নাকাটার তীরে কাশফুলের মেলা বসে। শীতের শুরুতে ওয়াজ মাহফিল আর পালা গানের আসর জমে। বাবা আমাদের রাতে বাইরে যেতে বারণ করে। আমরা তাকে উপেক্ষা করে চলে যাই। গভীর রাতে যখন ফিরি বাবা মমতা মিশিয়ে রাগ করে।
এসবের মধ্যেই কেমন করে যেন বড় হয়ে যাই।বাড়ি থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্দেশ্যে যখন রওনা হই।বাবা অশ্রুসিক্ত চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর আর কী?

বাবা আবার ধানে সার দেয়, কলাই মসুরি তুলে, দুধ বেঁচে সওদা করে বাড়ি ফেরে।
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে গরুগুলোকে ঘাস দেয়। গরুগুলো কৃতজ্ঞতায় বাবার গায়ে মাথা ঘষে। দুপুরের তীব্র গরমে বাবা যখন একফোঁটা স্বস্তির জন্য আকাশের দিকে তাকায়। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ইলেকট্রিক পাখার নিচে বসে ২য় বিশ্বযুদ্ধের হিরোশিমা - নাগাসাকির ইতিহাস পড়ি।

- সংগৃহিত

পঠিত : ২২৬ বার

মন্তব্য: ০