Alapon

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এবং ইতিহাসের কিছু কথা...



মক্কায় তান্ডবটা এতটা ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর হবে তা খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের জানা ছিলোনা। যখন তিনি হাজ্জাজের নিষ্ঠুরতা জানলেন তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে দু:খপ্রকাশ করলেও তিনি হাজ্জাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি তার নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্যে। বরং এই ঘটনার পর হাজ্জাজকে মক্কা ও মদীনার গভর্ণর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই ক্ষমতা পেয়ে হাজ্জাজ বেপরোয়া আচরণ করতে থাকেন। তিনি নামাজের সঠিক সময়ে জামাতে আসতেন না এবং তিনি না আসা পর্যন্ত জামাত শুরু হত না।

হাজ্জাজ ছিলো অসাধারন বক্তা। বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে বশ করতে পারতেন। তবে তিনি আল্লাহর রসূলের প্রিয় খাদেম ও প্রখ্যাত সাহাবী ৯০ উর্ধ্ব বয়স্ক হযরত আনাস ইবনে মালিক(রাঃ) এর সাথে অসাদাচরণ করেন। আনাস (রাঃ) হযরত আলীকে সমর্থন করেছিলেন, আর হাজ্জাজ ছিলেন আলীর(রাঃ) বিরুদ্ধ পক্ষ। আনাস(রাঃ) আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের পক্ষে কথা বলেছিলেন ফলে হাজ্জাজ তাকে জনসম্মুখে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। সাহাবী আনাস(রাঃ) এই ঘটনায় একই ক্ষিপ্ত হন যে, তিনি খলিফা আব্দুল মালিককে একটি কঠিন চিঠি লেখেন। তিনি বলেন যে, 'আমি আল্লাহর রসূলের খাদেম আনাস বলছি। আপনার গভর্ণর হাজ্জাজ আমাকে অপমানিত করেছে মানুষের সামনে। আমি আশা করি আপনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবেন। '

হযরত আনাসের(রাঃ) এই চিঠি খলিফাহর হস্তগত হবার পর খলিফা আব্দুল মালিক একটি কঠিন চিঠি লিখেন হাজ্জাজকে। তিনি লেখেন- ' হাজ্জাজ ! আমি তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি। তুমি আল্লাহর রসূলের(সাঃ) প্রিয় খাদেম ও সাহাবীকে অপমান করেছো। আমার চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে করজোড়ে আনাসের (রাঃ) কাছে তুমি ক্ষমা চাইবে। আর যদি তুমি তাকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হও, তাহলে তোমাকে আমি সেই অবস্থায় পৌঁছে দেব, যে অবস্থায় প্রথম দিন তুমি আমার বাহিনীতে এসেছিলে। '

প্রচন্ড ক্রোধমাখা হুমকীমূলক এই চিঠি পেয়ে হাজ্জাজ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তাৎক্ষনিকভাবে হযরত আনাসের(রাঃ) বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার সাথে ঘটা ঘটনার জন্যে অত্যন্ত দু:খিত হৃদয়ে, নতজানু অবস্থায় ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আনাস(রাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এরপর খলিফা আব্দুল মালিক হাজ্জাজকে মক্কা,মদীনার গভর্ণরের পদ থেকে সরিয়ে তাকে মিশরের গভর্ণর হিসেবে নিযুক্ত করেন।

মিশরের অধিকাংশ মানুষ ছিলো উমাইয়া খিলাফতের বিরোধী। তারা হযরত আলীকে এবং তার পুত্রদেরকে খিলাফতের যোগ্য উত্তরসূরী মনে করত। মিশর ছিলো বিদ্রোহী এলাকা। হাজ্জাজ উমাইয়া খিলাফতকে প্রতিষ্ঠায় তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছেন। যা দরকার এবং যা দরকার নয় সেটাও দরকারী মনে করে তিনি তা করেছেন। গোপনে ও প্রকাশ্যে তিনি উমাইয়া খিলাফতকে শক্তিশালী করার কাজ করেছেন।

এখানে একটা বিষয় বলা প্রয়োজন মনে করছি। আমরা অনেক বছর পর এসে ইতিহাসে যাদেরকে ভিলেন হিসেবে দেখী, তাদের জীবনাচার ,রাজনৈতিক চিন্তাগুলো যদি তারা আমাদের সামনে বিশ্লেষন করতেন তাহলে আমরা নিজেদের অজান্তেই হয়ত তাদের চিন্তার দিকে ঝুকে পড়তাম। খিলাফত নিয়ে এই যে বিরোধ, সেটা তাদের ব্যক্তিগত আকিদা, ইসলামিক সমাজ, ইসলামের রাজনৈতিক কাঠামো,বিচার, আইন, শাসন বিভাগ সংক্রান্ত বিষয়াবলীকে আক্রান্ত করেনি। ইসলাম সম্পর্কে তাদের ধারনা ,আগ্রহ,আবেগ ছিলো অনন্য, কিন্তু সেই আবেগের বহির্প্রকাশে তারতম্য হয়েছে। সমস্যার পুরোটাই ছিলো রাজনৈতিক। রসূল(সাঃ) বলেছেন, "যখন মুসলিমদের খলিফা নির্বাচিত হয়ে যাবে, তখন কেউ যদি এসে খিলাফতের দাবী করে বা নিজেকে খলিফা দাবী করে, তখন তাকে হত্যা করো"- সহি মুসলিমে বর্ণিত হাদীস।

এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে উমাইয়া খলিফাহগণ ইসলামী রাষ্ট্রের অন্য খলিফা দাবীদারকে হত্যার যোগ্য মনে করত এবং হাজ্জাজ বিন ইউসূফও একই চিন্তায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু যদি নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হয় তাহলে বলতে হয়, যারা সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী, তারাই খলিফা হওয়া যোগ্য। কিন্তু নানামুখী রাজনৈতিক চালের মাধ্যমে খলিফা নির্বাচনকে নিজেদের পক্ষে নিয়েছে উমাইয়া খলিফাগণ এবং এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো নিজেদের পক্ষে কাজে লাগিয়েছে। আর এ কারনেই মুসলিমরা এবং প্রথম শ্রেণীর ইমানদারগনও তাদের পক্ষে ছিলো। তারা চেয়েছে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা না হোক। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বজায় থাকুক। এ কারনেই খলিফা সঠিক নন জেনেও তারা সমর্থন করেছেন।
যাইহোক মিশরে যেদিন হাজ্জাজ বিন ইউসূফ গমন করেন, সেদিন বড় মসজিদে সেখানকার প্রধান প্রধান সকল উলামা,বিরোধী পক্ষের নেতাদেরকে একত্রিত করে বক্তব্য প্রদান করেন। হাজ্জাজ প্রথমেই বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি এখানে সকলে মাথা ছাড়া দাড়িয়ে আছে, রক্তের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। আমার সামনে থাকা লোকেদের কারো মাথা নেই। আচ্ছা আপনাদের পূর্বের গভর্ণর রাষ্ট্রের আইন কানুন না মানলে কি শাস্তি দিতেন ? লোকেরা বলল, তিনি চাবুক মারার নির্দেশ দিতেন। হাজ্জাজ বললেন, আমি চাবুক চিনিনা, আমি চিনি তলোয়ার। খলিফাহর আদেশ পরিপালিত না হলে মাথা কেটে ফেলব। '

হাজ্জাজ মিশরে বিদ্রোহীদেরকে কচুকাটা করেছেন এবং তিনি ছিলেন এক ভয়ঙ্কর শাসক। তার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই জীবন নাশ। তবে এর ভেতর দিয়ে এই তিনিই এমন সব কাজ করেছেন যা বহু শাসকের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। হাজ্জাজ হযরত ওসমানের(রাঃ) নিজ হাতে লেখা আল কুরআনের অনেকগুলো কপি তৈরী করেন এবং খিলাফতভূক্ত সকল অঞ্চলে সেটা পৌছে দেন এবং সংরক্ষন করেন। বহু কুরআনী হাফিজ তৈরী করেন। বহু মসজিদ,শিক্ষাকেন্দ্র,চিকিৎস্যাকেন্দ্রসহ জনগনের কল্যানে বহুমূখী কাজ করেন। আর মুসলিমদের ভূখন্ড রাখেন নিরাপদ। তার কর্তৃত্ব স্বীকার করলে তিনি মাথায় তুলে রাখতেন এবং সকল সহযোগীতা প্রদান করতেন। তিনি ক্ষমতা উপভোগ করতেন আর ক্ষমতাকে নিষ্কন্টক করতে সম্ভাভ্য সকল কিছুই করতেন।

হাজ্জাজ বিশাল কোনো নেতা ছিলেন না। ছিলেন মিশরের গভর্ণর মাত্র, কিন্তু খিলাফতের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হত। এটা হয়েছিলো তার রাজনৈতিক ও সামরিক যোগ্যতার কারনে। তার মত সেনানায়ক ইতিহাসে বিরল। আর উমাইয়া খলিফাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার কারনে সকলে তাকে সমীহ করত। হাজ্জাজ যখন মিশরের গভর্ণর ,তখন একটি ঘটনা ঘটে। তৎকালীন সিংহল বা আজকের শ্রীলংকাতে অনেক আরব মুসলিম ব্যবসায়ী বসবাস করত। সেখান থেকে হজ্জ যাত্রাকালে জাহাজডুবি হয়ে অনেক মুসলিম মারা গেলে তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে কয়েকটি জাহাজযোগে শ্রীলংকার দয়ালু রাজা সম্মানের সাথে নিজ দেশে পাঠায়। সেসব জাহাজে রাজা কর্তৃক প্রদত্ত বহু স্বর্ণ,রৌপ্যসহ মূল্যবান উপহার সামগ্রী ছিলো, যা ছিলো ওই সব শোক সন্তপ্ত পরিবারের জন্যে। জাহাজের বেশীরভাগ লোকই ছিলো নারী ও শিশু। এই জাহাজগুলো যখন সিন্ধুর দেবাল বন্দরের কাছাকাছি আসে, তখন সিন্ধুর রাজা দাহিরের নৌসেনারা মতান্তরে জলদস্যুরা জাহাজে আক্রমন করে। তারা জানত যে এই জাহাজগুলোতে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। তারা সকল সম্পদ লুটপাট করে এবং নারী,শিশুদেরকে বন্দী করে রাখে।

এই ঘটনা খলিফা আব্দুল মালিক জানতে পেরে রাজা দাহিরকে চিঠি লেখেন সকল বন্দীদেরকে মুক্ত করে স্বসম্মানে তাদেরকে দেশে পাঠাতে। কিন্তু রাজা দাহির খলিফাহর কথায় কর্ণপাত করেনা। দূৎকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। ফলে দাহিরকে শায়েস্তা করতে উবায়দুল্লাহ ও বুদায়েল নামক সেনাপতির নেতৃত্বে দুটো সেনা বাহিনী পাঠান খলিফা । দামেস্ক থেকে বহু দূরে আসা এই বাহিনী সুশিক্ষিত ছিলোনা এবং তাদের নৌযুদ্ধের ভালো অভিজ্ঞতা ছিলোনা। সঠিক গোয়েন্দা তথ্যও ছিলোনা। ফলে তারা দাহিরের বাহিনীর সাথে পেরে ওঠেনি।

এরপর বন্দীদের ভেতর থেকে এক নারী হাজ্জাজ বিন ইউসূফকে চরম আর্তনাদপূর্ণ এক হৃদয়স্পর্শী চিঠি লিখেন এবং নিজেদের অরাজকতা, নির্যাতনের কথা বলেন। খুবই গোপনে কারো মাধ্যমে এই চিঠি হাজ্জাজের নিকট পৌঁছে যায়। উক্ত নারী হাজ্জাজকে বলেন, আপনার বোনেরা মুশরিকদের খাঁচায় বন্দী, আপনি কিভাবে ঘুমাতে পারেন ? আপনি কি আপনার বোনদেরকে উদ্ধার করতে আসবেন না ?

হাজ্জাজ এই চিঠি পেয়ে এমন ক্রদ্ধ হয়ে ওঠেন যে, ইতিপূর্বে এরকম ক্রোধ কেউ কখনই দেখেনি। তিনি নাওয়া খাওয়া ভুলে যান। ওদিকে খিলাফত সঙ্কটে, বিভিন্ন ফ্রন্টে সৈন্য দরকার। হাজ্জাজকে সৈন্যদের প্রশিক্ষন, বিভিন্ন স্থানে প্রেরন করতে হচ্ছিলো। কিন্তু হাজ্জাজ রাজা দাহিরকে ধ্বংস করার ওয়াদা করেন। অত্যন্ত অপমানকর ভাষায় কুকুর সম্বোধন করে হাজ্জাজ দাহিরকে বলেন, তুই অপেক্ষা কর, তোর মৃত্যুদূত আসছে ! জবাবে রাজা দাহিরও একই ক্ষিপ্ততায় হাজ্জাজকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন এবং পূর্বে পাঠানো নৌ-সেনাদের পরিনতীর কথা জানিয়ে দেন।

হাজ্জাজের হাতে এক বিশ্ময় বালক ছিলো। স্বয়ং হাজ্জাজের ভাইও তার নিষ্ঠুরতা থেকে রেহায় পায়নি। হাজ্জাজের ভায়ের স্ত্রীর অভিযোগ ছিলো হাজ্জাজই তার নিজ ভাইকে হত্যা করেছে ক্ষমতার জন্যে। কিন্তু পরবর্তীতে তার ভায়ের পরিবারের প্রতি তিনি খুবই দয়ালু হয়ে ওঠেন। ভায়ের স্ত্রীর সাথে দেখা করে তিনি ক্ষমা চান এবং তার ভায়ের পুত্রকে চান। তার ভায়ের স্ত্রী নিজ পুত্রকে হাজ্জাজের কাছে দেন শিক্ষার জন্যে। হাজ্জাজ নিজ হাতে তাকে গড়ে তুলতে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই সে ছিলো মহা সাহসী এবং ভিন্ন রকম প্রতিভাসম্পন্ন। বালক অবস্থাতেই সে যুদ্ধে পারদর্শী হয়ে ওঠে। তার প্রতি খুশী হয়ে হাজ্জাজ তার নিজ কন্যাকে তার সাথে বিয়ে দেন। এই বালকের নাম ছিলো মুহাম্মদ বিন কাশিম।
হাজ্জাজ সিন্ধুর অভিযানে একটি বাহিনী তৈরী করেন খলিফা আব্দুল মালিকের অনুমতি ছাড়াই, সম্ভবত এর সৈন্য সংখ্যা ছিলো ৮ হাজার। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত করেন নিজ ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে। সে সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স ছিলো ১৭ বছর অথবা ১৬ বছর ১০ মাস। মুখে কেবল গোফ দাড়ি গজিয়েছে তার।

ইতিহাস বলে এই কিশোর দুনিয়ার বিশাল সব যুদ্ধের হিসাব নিকাশ পাল্টে দেয়। অসম্ভব ক্ষিপ্র গতি ,গোয়েন্দা তথ্য,শত্রুর শত্রুকে বাগে আনা, নির্যাতিতদের সাথে অতিমাত্রায় সুআচরন, আর যুদ্ধ দক্ষতা দ্বারা তিনি একের পর এক যুদ্ধে বিজয় লাভ করতে থাকেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরকে তছনছ করে দেন এবং তার সেনাপতিসহ তাকে হত্যা করেন। ভারতের অন্য রাজারা ক্ষেপে ওঠে। এরপর ভারতের বিভিন্ন রাজাদের বিরুদ্ধে তিনি একের পর এক অভিযান চালান এবং বিজয় অর্জন করতে থাকেন।

তার সবচেয়ে বড় গুন ছিলো তিনি ইসলাম প্রচারক দলকে ব্যবহার করেছিলেন। যে এলাকায় তিনি যেতেন সেখানকার মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান,দিক নির্দেশনা দিতেন এবং তাদের অধিকার,মর্যাদার কথা বলতেন। দলিত শ্রেণীর লোকেরা নির্দিধায় ইসলাম গ্রহন করেছে সে সময় এবং তারা কখনই আর পূর্বের ধর্মে ফিরে যায়নি, কখনই না। এ সময় ভারতের কয়েকটি অঙ্গ রাজ্যের রাজা এবং রানী ইসলাম গ্রহন করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারত অভিযানের বিষয়টা এরকম ছিলো যে, নির্যাতিত,দলিত সনাতন ধর্মীরা তাকে বরণ করে নিয়েছিলো। তারা তাকে নিজেদের মুক্তির দ্যূত ভাবত। এমনকি তাদের অনেকে ভালোবেসে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মূর্তি তৈরী করেও পূজা করেছে, কিন্তু তিনি নিজ হাতে সেসব ভেঙ্গে ফেলেন। মুহাম্মদ বিন কাশিম প্রথম দিকে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন এবং পরে তিনি মানুষের মনোজগতে আসন গাড়েন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের সফলতায় তার বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র হয় এবং হাজ্জাজকে ক্ষিপ্ত করা হয় তার বিরুদ্ধে খুবই কৌশলে। শত্রুতা উভয়ের কাছে ভিন্ন ভিন্ন চিঠি লিখে উত্তেজিত করতে থাকে পরষ্পরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা হয়। এরপর হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমকে আটক করে নিয়ে আসেন এবং অসুস্থ্য হয়ে তিনি মারা যান। অনেকে বলেন হাজ্জাজই তাকে হত্যা করেছে। অনেকে বলেন, তাকে গ্রেফতারের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন এবং অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। এভাবেই মৃত্যু হয়।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের শ্রেষ্ঠ ছাত্র, প্রখ্যাত স্কলার সাঈদ ইবনে জুবায়ের হাজ্জাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন যদিও তার সাথে লোক সংখ্যা ছিলো কম। হাজ্জাজের হাত থেকে তিনি অবশ্য পালিয়ে ছিলেন এবং গোপনে বিদ্রোহ করতেন, জনমতকেও প্রভাবিত করতেন । প্রায় ১৫ বছর পর হাজ্জাজ তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন। হাজ্জাজ ছিলেন প্রচন্ড ক্রোধান্বিত। সাঈদ ইবনে জুবায়েরকে তিনি সামনে দাড় করান এবং তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। এরপর বলেন, তুমি যা করেছো সেটার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পূর্বে সাঈদ হাজ্জাজের চোখে চোখ রেখে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন- ' ইয়া আল্লাহ, আমার মাত্র একটা দোয়া আছে, আপনি কবুল করুন ! আমার এই মৃত্যুই যেন হয় হাজ্জাজের হাতে সর্বশেষ হত্যাকান্ড'। এই দোয়ায় হাজ্জাজ ঘাবড়ে যান কিন্তু তার ক্রোধ তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য করে দেয়। সে সাঈদ ইবনে জুবায়েরকে হত্যা করে। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহর ভেতর হাজ্জাজের এক অজ্ঞাত রোগ হয়। রাজ্যের কোনো ডাক্তারই সেই রোগের কোনো কারন বের করতে পারেনা।

হাজ্জাজ বলতে থাকে, 'আমি জানি এটা কোন রোগ। এটা হল সাঈদের দোয়া। আল্লাহ হয়ত তার দোয়া কবুল করেছেন। আহ আমি যদি তাকে হত্যা না করতাম ! আমি কত খারাপ কাজ করেছি !'

হাজ্জাজ তার নিজের কৃত কর্মের জন্যে তার শাসনের শেষ সময়ে অনুতপ্ত ছিলেন। কখনও তিনি সেসব প্রকাশ করতেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। কিন্তু তারপরও ক্ষমতার জন্যে তিনি মানুষ হত্যা করেছেন। তার অনুশোচনাবোধও ছিলো প্রবল। তিনি ছিলেন কবি। কবিতার ভাষায় তিনি তার পাপবোধকে তুলে আনতেন। হাজ্জাজ বিন ইউসূফ ভিন্ন এলাকার মানুষদের কুরআন পাঠের সুবিধার্তে আরবী ভাষায় জের,জবর,নোক্তা এসব চালু করেন। আমরা বর্তমানে কুরআনের যে লিখিত রূপটি দেখী তার ভেতর জের,জবর,নোক্তা রয়েছে এবং এটা থাকলে পড়তে সুবিধা হয় শিক্ষনবিশদের। অবশ্য এটা ছাড়াও আল কুরআনের প্রিন্ট রয়েছে যা ব্যপকভাবে পঠিত।

সাঈদ ইবনে জুবায়েরের বদদোয়ায় তার শরীরের ভেতরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পচে যায়। এভাবেই দ্রুত তিনি মারা যান যান ৯৫ হিজরীতে। হাজ্জাজের শেষ উক্তি ছিলো, " ইয়া আল্লাহ আপনার অধিকাংশ বান্দাহ'রা আপনার নামে শপথ করে বলে আমি জাহান্নামী। তারা আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে চায়। কিন্তু আমি তো জানি, আমার রব কত মহান ! আমার রব সবচেয়ে বেশী দয়ালু এবং তিনিই ক্ষমাশীল ! "

পঠিত : ২২৮১ বার

মন্তব্য: ০