Alapon

|| দ্বীন, আমি ও আমরা ||



১.
ইসলাম সম্পর্কে জানার প্রথম আগ্রহ আসে একটি ধাক্কা থেকে৷ সেই ধাক্কায় হয় হৃদয় ভেঙে যায় নতুবা বিশ্বাসের দেয়ালে নতুন চিন্তার ধাক্কা লাগে। মানুষ সংশয় নিরসনের জন্য কিংবা জানা জিনিসের প্রতি বিশ্বাসকে পাকাপোক্ত করার জন্য ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহবোধ করে। পুরনো চিন্তার উপর থেকে ভুলের আস্তরণ সরিয়ে ফেলার জন্য প্রথমবারের মতো আমরা একটি নতুন পদক্ষেপ নেয়ার সাহস করি। এই সাহসটুকু পুরনো অভ্যাসকে পরিত্যাগ করে নিজেকে নতুন পথের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে।
.
দ্বীনে প্রবেশের পর, আমরা প্রথমে অনুভব করি ইসলাম সম্পর্কে আমাকে জানতে হবে। নতুন নতুন লেকচার শোনা, তাফসীর ও বিষয়ভিত্তিক জানাশোনার জন্য আমাদের আগ্রহ থাকে সবচেয়ে বেশি। পরিবর্তন আসে, আসবেই মনে ও মগজে পরিবর্তন ঘটে যায়। যেটাকে সভ্য সমাজ ব্রেইন-ওয়াশ বলে। অসত্য ও খোঁড়া যুক্তি মুছে দিয়ে, সেখানে স্পষ্ট ও শক্তভাবে জায়গা করে নেয় সত্য। যা মুহুর্তের মধ্যে বদলে দেয় বহুবছরের জীবনধারা, বহু বছরের অভ্যাস ও পোশাক।
.
মানুষ পোশাকের পরিবর্তন দেখে ভাবে - লোকটা বদলে গেল! কিভাবে এর ব্রেইন-ওয়াশ করা হলো? অথচ পোশাকের পরিবর্তন ঘটানো সহজ ব্যাপার নয়। চাইলেই আপনি কাউকে পোশাক পরিবর্তন করার উপদেশ দিতে পারবেন না। অন্ততপক্ষে এই 'মাই লাইফ, মাই রুলস' এর জামানায় এটা আরও সম্ভব না। পোশাকের পরিবর্তন আসে ধাপে ধাপে, চিন্তা বদলের প্রভাব পরে অভ্যাসে, অভ্যাস পরিবর্তন এর প্রভাবে কর্মপন্থা বদলে যায়। আমাদের কর্মপন্থা আমাদের ব্যক্তিত্বে প্রভাব ফেলে, প্রথম দেখাতেই ব্যক্তিত্ব যাচাই করার বিশেষ মাধ্যম হলো আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ।
.
ক্রোধের কারণে সুপরিচিত ব্যক্তিও পোশাক নিয়ে কটাক্ষ-কে সহ্য করে নেয় শুধুমাত্র দ্বীনের কারণে। শুধুমাত্র দ্বীনের সীমারেখার সম্মান আছে বলেই দ্বীনে ফেরা ব্যক্তি তর্কে লিপ্ত হয় না। দ্বীনের সম্মানে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় আমাদের প্রত্যেকের জীবনে। কী সেই শক্তি? কীসের কারণে তর্কবাগীশ ব্যক্তিও স্বেচ্ছায় বোকাদের মতো তর্কে হেরে যায়? কতখানি প্রভাবিত হলে একজন মানুষ সবকিছু বদলে ফেলে! সবকিছু আসলেও কী বদলে ফেলা সহজ!
.
জীবনধারা পরিবর্তনের এই জোয়ারে নতুন মাত্রা যোগ করে ইলম অর্জনের স্পৃহা। নতুন নতুন বইপত্র ঘেঁটে দ্বীনের সূক্ষ্মতা বোঝার চেষ্টা ও মানুষের মাঝে তা ছড়িয়ে দেয়ার তাগিদ, অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তা নিয়মশৃঙ্খলা অনুসরণ না করলে, খুব বেশি ফলদায়ক হয় না। বিচ্ছিন্নভাবে ইলম অর্জনে বিশেষ কোন ফায়দা থাকে না, ভাসাভাসা জ্ঞান অর্জিত হয়।
.
ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে অবশ্যই উস্তাদের সান্নিধ্য প্রয়োজন। নিজে নিজে কিছু তথ্য জানা যায়, তবে হিকমাহ ও প্রজ্ঞা শিখতে উস্তাদ লাগে। উস্তাদের সান্নিধ্য লাগে। উস্তাদের সামনে নিজের অহমিকাকে ভেঙেচুরে জ্ঞানশূন্য হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। শিখতে হয় দিলকে খালি করে। আগে যা জানতাম ও এখন যা শুনছি তাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করানোই উস্তাদের কাজ। ইলম অর্জনের আদব রক্ষা করতে হয়। সেই আদবটুকুও শিখতে হয় উস্তাদের সামনে হাটু গেড়ে। স্রেফ বই পড়ে যে শিখতে চায়, সে হাঁটু গেড়ে বসবে কার সামনে?
.
দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পন্থা, উত্তম আখলাকের প্রমাণ স্বচক্ষে দেখার জন্য হলেও উস্তাদের কাছে যান। নিজেকে শেখান, ভালো থেকে উত্তমে পরিনত হোন। বড় হওয়ার প্রথম ধাপ থেকে শুরু করুন। ছোট হয়ে যান, খুউব ছোট। আল্লাহ আপনার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন, ইন শা আল্লাহ্।
.
২.
দ্বীনের পথে কয়েকবছর কাটিয়ে দেয়ার পরে পুরাতনদের অভ্যাস পরিবর্তন হতে থাকে। ইবাদতের প্রতি আগ্রহ বুলেট ট্রেনের গতি থেকে নেমে এসে ঠেলাগাড়িতে পরিনত হয়। শয়তান ঠিক এই সময়ের অপেক্ষায় থাকে, বান্দা যখন দ্বীনকে নিজের ব্যক্তিগত অভ্যাস মনে করে। জানতে জানতে একটা পর্যায় আসে, যখন আনমনেই বান্দার মনে হয় "আমি তো অনেককিছু জেনে ফেলেছি, আমি অমুকের চেয়ে বেশি জানি।" তখন জ্ঞানী ব্যক্তির মাঝে শয়তান অহমিকা প্রবেশ করিয়ে দেয়।
.
অহংকার পতনের মূল - আমরা পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। তার উজ্জ্বল প্রমাণ হলো, দ্বীনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ব্যক্তির নিকৃষ্ট ব্যক্তিতে পরিনত হওয়া। এই পরিবর্তনের ধাপগুলোও দ্বীনের পথে প্রবেশের ধাপের মতোই স্পষ্ট। এক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষ্য করে আমাদের আশেপাশের ব্যক্তিরা। অহমিকায় অন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যক্তি নিজের ভুলগুলোকে শুদ্ধ না করে ভুলের উপর অটল থাকে। একের পর এক ভুল করেও অনুতপ্ত হওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
.
এদের সদুপদেশ গ্রহণ করার মানসিকতা ঝরে যায় স্রেফ একটা ধারণার জন্য, "আমি তো জানি আমি সঠিক। আমি অমুকের চেয়ে উত্তম। আমি ওদের চেয়ে বেশি জানি।"। একটু খেয়াল করে যদি অতীতের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখব শয়তানকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল শুধুমাত্র এই ধারণার জন্যই "আমি আদমের তুলনায় উত্তম। আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে, আর আমাকে আগুন থেকে.."
.
অন্যকে হেয় করে, নিজেকে সেরা প্রমাণের খেলায় মেতে ওঠার আগে আমাদের এই স্মৃতিটুকু স্মরণে রাখা চাই। “দ্বীনের সম্মানের জন্যই আমাকে মানুষ ভালোবাসে, দ্বীনের জন্যই আমার মতো তুচ্ছ মানুষকে মানুষ কাছে টেনে নেয়। আমার যত প্রাপ্তি, তা আমার নিজের যোগ্যতায় অর্জিত হয়নি। আল্লাহর দেয়া সম্মানের বদৌলতে আমি আজ সম্মানিত, এই দ্বীনের অসম্মান করলে আল্লাহই আমাকে লাঞ্চিত করবেন। মানুষের হৃদয় কোমল বলেই, আমার দোষগুলো ক্ষমা করে আমার গুণগুলোকে আঁকড়ে ধরে। আমি কিছুই নই, কিছুই ছিলাম না, মৃত্যুর পরে আমার কোন চিহ্নও অবশিষ্ট থাকবে না। তবে দ্বীন যেমন সম্মানিত ছিলো, ততটাই সম্মানিত থেকে যাবে। আমার চেয়েও যোগ্য মানুষকে দ্বীনের বিজয়ের কাফেলায় শামিল করা হবে। দ্বীন গৌরবময়, তবে আমি নই। আমি অহমিকায় অন্ধ হয়ে পথ হারাতে পারি, তবে সিরাত্বল মুস্তাকীম থাকবে সরল সহজ, সবসময়ের জন্য।"
.
৩.
দ্বীনের পথে ফেরা ও দ্বীন থেকে ছিটকে সরে যাওয়ার মাঝে একটি ধাপ আছে, যা দ্বীনের পথে অটল থাকতে সহযোগিতা করে। তা হলো নেককারদের সোহবত, উত্তমদের সাথে ওঠাবসার অভ্যাস। সত্যবাদীদের মাঝখান থেকে উত্তমদের সঙ্গ গ্রহণ করা ও গুনাহের দিকে ধাবিত করে এমন সঙ্গীদের সাহচর্য পরিত্যাগ করা।
.
আপনি একাকী পথ চলতে গেলে সঠিক পথ ভেবে কখনো পথ হারাতেও পারেন। কিন্তু, উত্তমদের সঙ্গে একই পথের পথিক হলে আপনি পথ হারাবেন না। উত্তম বন্ধুদের সঙ্গে থাকার প্রভাব বেশ চমকপ্রদ। আপনি ইচ্ছা করলেই গুনাহে জড়াতে পারবেন না, আপনি চাইলেই সালাত পরিত্যাগ করতে পারবেন না। আপনি কুরআন তিলাওয়াত একদিন না করলেও আপনি বন্ধুদের কাছে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পারবেন। আপনি উত্তম কাজ শিখতে পারবেন, উত্তম আখলাক চর্চা করতে পারবেন। হিকমাহ, প্রজ্ঞা, অর্জিত ইলম প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হবে।
.
আসমানে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পায়রাকে লক্ষ্য করুন। একাকী কবুতরও উড়তে উড়তে যখন একঝাঁক কবুতরের সঙ্গে মিশে যায়, তখন তার গন্তব্য হয়ে যায় সেটাই, যেখানে কবুতরের ঝাঁক গিয়ে থামে। আপনি, আমি, আমরা সবাই সেই একাকী কবুতরের মতো; নেককারদের সঙ্গ পেলে আমরাও নেক হবো, গুনাহগারদের সংস্পর্শে এই আমরাই পথভ্রষ্ট হয়ে যাব।
.
আপনার আত্মশুদ্ধির জন্য হলেও নেককারদের মাঝে মিশে যান। আতর বিক্রেতার স্পর্শে চারপাশটা যেমন সুগন্ধি বিলিয়ে দেয়, নেককারদের কাছাকাছি গেলে আমাদের হৃদয়ের কলুষতা দূর হবে। আমরা গুনাহ থেকে বাঁচার পথ খুঁজে পাব। পথভোলা পায়রা না হয়ে নেককারদের সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচি, চলেন!
.
.

পঠিত : ৮৪২ বার

মন্তব্য: ০