Alapon

গণতন্ত্রের ইসলামী রূপ এবং কিছু কথা...



গণতন্ত্রের কিছু বিষয় কোনো মুসলিম নীতিগতভাবে মেনে নিতে পারে না। যদি কোনো মুসলিম এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, জনগণই নিরংকুশ ও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং আল্লাহর দেয়া আইনের পরিবর্তে মানব রচিত আইনই বর্তমান সময়োপযোগী ও অধিক কল্যাণকর, তাহলে সে আর মুসলিম থাকবে না। তবে পারিভাষিক ও তাত্ত্বিক অর্থে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় (অর্থাৎ জনসাধারণের এবং জনসাধারণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সরকারের কর্তৃত্ব) তার সাথে ইসলামের বড়ো ধরনের মিল আমরা খুঁজে পাই।

গণতন্ত্রের মানে কখনও এমন নয় যে, একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে নাস্তিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। তার মানে এও নয় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সংবিধানে রাষ্ট্রের বিবেচনা অনুযায়ী কিছু স্থায়ী মৌলিক নীতিমালা সন্নিবেশ করা যেতে পারবে না। পাশ্চাত্যে প্রচলিত গণতন্ত্রেও নীতিগতভাবে কিংবা প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু নিয়ম নীতি রয়েছে, যেগুলোর ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই বা যেগুলো পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। গণতন্ত্রের অনেক প্রবক্তা জোর দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তিকেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করতে এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে না। অনেকে এমনও বিশ্বাস করে যে, কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির প্রকৃতি যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কার্যকারণের সাথে সংঘাতময়, তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তার অস্তিত্বকে বৈধ হিসেবে স্বীকার করা উচিত নয়।

অতএব, যে দেশের জনসাধারণের অধিকাংশই মুসলিম হয়, যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং শরীয়তের আইন প্রবর্তনকে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় কর্তব্য বলে বিশ্বাস করে, তাদের গণতন্ত্র চর্চাও আল্লাহপ্রদত্ত বিধানসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত রেখেই ইজতিহাদের ব্যাপক ক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হবে। মুসলিমদের গণতন্ত্র হবে আল্লাহ তা‘আলাকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মেনে নিয়ে শাসনব্যবস্থাকে খিলাফতের ধারণার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা। স্বাধীন জনমতের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হবে এবং সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম পরামর্শক্রমেই চলতে থাকবে। আর এজন্য যুগোপযোগী ও কল্যাণকর যেকোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

পাশ্চাত্য জগতে ধর্মকে গণতন্ত্র থেকে পৃথক করার কারণে কোনো কোনো ইসলামপন্থীর মনে এই চিন্তার সৃষ্টি হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়। এ ধরনের চিন্তাধারার পেছনে যে বিশ্বাস কাজ করেছে তা হচ্ছে— দুটি পদ্ধতির মাঝে মৌলিক ও আদর্শগত পার্থক্য দেখা দিলে এদের একটিকে গ্রহণ করে অন্যটি থেকে দূরে থাকার জন্য তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে হবে। অথচ ইসলাম সব সময় নিজ আদর্শের বিশুদ্ধতা ও যোগ্যতার সাথে সাথে কোনো কোনো মানবীয় অভিজ্ঞতা বা আইন, যা ইসলামী শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক নয় এবং যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাকে নিজের কাঠামোর মধ্যে গ্রহণ করেছে।

কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদ ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেছেন। আমরা মনে করি, ইসলাম সর্বার্থে গণতন্ত্র নয়; আর গণতন্ত্রও সর্বার্থে ইসলাম নয়। গণতন্ত্র হলো নিছক মানব-অভিজ্ঞতার নির্যাস। আর ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি ব্যবস্থা; যা উদ্দেশ্য, পন্থা ও পদ্ধতিগত দিক থেকে একমাত্র নির্ভুল ও অতুলনীয়। আমরা এও আশা করি, আমাদেরকে বাদ দিয়ে আমাদের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থায় যোগসূত্র স্থাপনের নিমিত্ত আমাদের আদর্শ ও মূল্যবোধকে গ্রহণ না করে পশ্চিমা গণতন্ত্র তাদের আদর্শ (যেমন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র প্রভৃতি) আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। কারও কারও ভয়, গণতন্ত্র মানুষকে সকল ক্ষমতার উৎসে পরিণত করে, এমনকি এটি তাকে বিধি-বিধান প্রণয়নেরও একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান করে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. ইউসূফ আল-কারযাভী বলেন,
“তাদের এ ভয়ের প্রতি কর্ণপাত করা উচিত হবে না। কেননা, আমরা এমন এক জনগণের কথা বলছি, যারা মুসলিম হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, যারা আল্লাহকে তাদের রাব্ব হিসেবে মেনে নিয়েছে, মুহাম্মাদ সা.-কে তাঁর রাসূল এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
আশা করা যায়, এ ধরনের জনগণ এমন কোনো আইন প্রণয়ন করবে না, যা ইসলামের অকাট্য নীতি ও সিদ্ধান্তমূলক আইনের পরিপন্থি হবে। উপরন্তু, ইসলামের অকাট্য ধারার বিরুদ্ধে প্রণীত যেকোনো আইন বাতিল বলে গণ্য হবে এমন একটি অনুচ্ছেদ সংবিধানে সংযোজন করে এ ভয় দূর করা যেতে পারে। কারণ, রাষ্ট্রের একমাত্র ধর্ম ইসলাম এবং ইসলামই তার সকল বিধি-বিধানের বৈধতার সূত্র। বিধি-বিধান প্রণয়নের মালিক আল্লাহ তা‘আলা— এ মূলনীতির মাধ্যমে আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পরিবর্তনশীল জীবন আর পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর জন্য ইসলামের মৌলিক আইন ও শরীয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিধি প্রণয়নের সীমিত ক্ষমতাও আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দান করেছেন।”

এ কারণে আধুনিককালের অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ ও পণ্ডিত ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি পুরো পরিত্যাগ করেননি। তাঁরা আল্লাহর সার্বভৈৗমত্বের অধীনে শর্তসাপেক্ষে শব্দটি গ্রহণ করে নিয়েছেন। মহাকবি ড. মুহাম্মদ ইকবাল রাহ.-এর মতে, গণতন্ত্রের ভিত্তি যদি রূহানী ও নৈতিক হয়, তাহলেই তা হবে সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি। রূহানী গণতন্ত্রের মানে হলো, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে, আল্লাহর চূড়ান্ত ক্ষমতার অধীনে মানুষের গণতন্ত্র। ইসলামী রাষ্ট্রকে এ কারণেই তিনি ‘রূহানী গণতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাইয়িদ আবুল আ‘লা মাওদূদী (রাহ.) বলেন,
“ইসলাম ও গণতন্ত্র পরস্পর বিরোধী নয়। গণতন্ত্র সেই শাসনব্যবস্থার নাম, যেখানে জনমতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত, পরিচালিত ও পরিবর্তিত হয়। ইসলামী শাসনব্যবস্থাও তদ্রুপ। তবে পাশ্চাত্য গণতন্ত্র থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভিন্ন। কেননা, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র লাগামহীন হয়ে থাকে; সেখানে জনগণের রায় হালালকে হারাম করে দিতে পারে। ... পক্ষান্তরে ইসলামী গণতন্ত্র কুর’আন ও হাদীস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। গোটা জাতি চাইলেও ইসলামের সীমানার বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।”

আমরা মনে করি যে, বর্তমানে ইসলামী চিন্তাবিদগণ যেহেতু আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা, জনগণের নির্বাচিত সরকার ও জবাবদিহিতার কথা বলে থাকেন, আর এসব বোঝানোর জন্য আজকাল ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিই বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়, তাই সার্বিক বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে ‘গণতন্ত্র’ শব্দ গ্রহণ করার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই। এর ফলে একদিকে পাশ্চাত্য জগতে প্রচলিত ইসলাম সম্পর্কে ভুল ম্যাসেজ ‘ইসলাম আগ্রাসী ও কর্তৃত্ববাদী’— তা দূর হবে, অপরদিকে মুসলিম বিশ্বে এর ফলে কর্তৃত্ববাদী রাজা-বাদশাহ, সামরিক একনায়ক ও স্বৈরশাসকগণ অন্যায় সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে না।

আমরা এও লক্ষ করছি, বিশ্বের ইসলামী দলগুলো এবং ইসলামী চিন্তাবিদগণ (বিচ্ছিন্ন কিছু দল ও লোক ছাড়া) ইতোমধ্যেই শর্তসাপেক্ষে ‘গণতন্ত্র’ পরিভাষাটি ব্যবহার করছেন। আবার কেউ কেউ অগ্রসর হয়ে এমন কথাও বলছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতিষ্ঠিত মাদীনার ইসলামী রাষ্ট্রটিই ছিল মানবজাতির ইতিহাসে সর্বোত্তম জনকল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক নীতিমালাই ছিল এ রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলভিত্তি। তাঁদের এ কথায় গণতন্ত্র দ্বারা উদ্দেশ্য অবশ্যই পাশ্চাত্য ধাঁচের সেক্যুলার গণতন্ত্র নয়, যেখানে জনগণই হলো সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের মর্জি ও মতামতই হচ্ছে হক-নাহকের মানদণ্ড ও আইনের উৎস।

বরং তাঁদের কথায় গণতন্ত্র দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, , Rulership of Allah on men by pious ruler with justice.- “আল্লাহর শাসন জনগণের ওপর, সৎ লোকদের দ্বারা, ন্যায়বিচার সহকারে।” অন্য কথায়, আল্লাহর শাসন, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য। আল্লাহর এ শাসন আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে জনগণ পরিচালনা করবে। কাজেই ইসলামে গণতন্ত্র বলতে জনগণের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণকে বোঝানো হয়ে থাকে।

পঠিত : ৩২৩ বার

মন্তব্য: ০