Alapon

আমরা কি পারি না ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেতে...?



আমরা কি জানি পৃথিবীর প্রথম নির্ভুল মানচিত্র অঙ্কনকারি বা বিশ্বের প্রথম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের আবিষ্কারক কে ছিলেন? কিংবা গুতিবসন্তের আবিস্কারক, স্টাটিক্স এর প্রতিষ্ঠাতা, আলোক বিজ্ঞান, রসায়ন, বীজগণিত বা ত্রিকোণমিতির জনক কে? কেই বা মিকিওেয়র গঠন সনাক্ত করেছিলো? পদার্থ বিজ্ঞানে শূন্যের অবাস্থান কে সনাক্ত করেছিলো? ফাউন্টেন পেন, উইন্ডমিল, গুরনায়মান হাতল, পিন হোল ক্যামেরা, প্যারাসুট, শ্যাম্পু, ইত্যাধি জিনিস কারা আবিস্কার করেছিলো? এই প্রতিটি জিনিসের আবিষ্কারক, গবেষক, উদ্ভাবকই কিন্তু ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। যা আমরা খুব কম মানুষই জানি।

বর্তমানে যে মুসলিমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, আবিস্কার ইত্যাধি দিক দিয়ে পিছিয়ে পরছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এটা নিয়ে অনেক মুসলিম শিশু, কিশোর বা সাধারণ মুসলিমরাই হিনমন্যতায় ভোগে। তারা দেখে সকল বিজ্ঞানীরই ইহুদি, খৃষ্টান বা অমুসলিম। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে কেন কোন মুসলিম বিজ্ঞানী নেই?

এই পরিস্থিতির জন্য অনেক গুলা কারণই দায়ী।

মুসলিম বিজ্ঞানী নেই, মুসলিমদের উদ্ভাবনি মেধা নেই। মানব সভ্যতার সকল বড় বড় আবিস্কার করেছেন অমুসলিম বিজ্ঞানীর এই তত্ত্ব কে আমাদের দিয়েছে? বিজ্ঞানী হিসেবে গেলিলিও, আলেকজেন্দার গ্রাহাম বেল, লুইস পাস্তুর, আলফ্রেড নোবেলদের কথা জানলেও, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, আল খাওয়ারিজমি, আল ফরগানি, আল রাজি, ইবনে সিনান ওনাদের কথা আমরা কয় জন জানি? কেন এমনটা হল?

প্রথম কারণ হচ্ছে. ইসলামিক স্বর্ণযুগ আড়াল করা বা মুসলিম বিজ্ঞানীদের পরিচয় লুকানো এবং তাদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। আর দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, মুসলিম হিসেবে তাদের চাপিয়ে দেওয়া এই তত্ত্ব গুলা মেনে নেওয়া এবং মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম বিজ্ঞানী এবং তাদের আবিস্কার গুলো নিয়ে পড়াশুনা না করা। আর ৩য় কারণ হচ্ছে বর্তমানে আমাদের পরাজিত মানসিকতা।

৭৫০ থেকে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত সময়টা ইসলামের স্বর্ণযুগ বা ইসলামিক রেনেসাঁ হিসেবে পরিচিত। এই সময় মুসলিম সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিস্কার, রাজনীতি, বাণিজ্য, ভূখণ্ড, দর্শন সব দিক থেকে স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। এবং সেই সময় এই মুসলিম সভ্যতার সাথে অন্য কোন সভ্যতার তুলনাই ছিলনা। এই সম্পর্কে ঐতিহাসিক জ্যাক লিখেছেন, “ইসলাম তার ক্ষমতা, শিক্ষা ও শ্রেষ্ঠতর সভ্যতার জোরে বিশ্বে পাঁচ শত বছর আদিপত্য করেছে।”

কিন্তু ক্রুসেডর দের পরবর্তী প্রজন্ম মুসলিমদের এই গৌরবউজ্জ্বল অর্জন ও ইতিহাস বিকৃত করার জন্য অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে নানা প্রচেষ্টা চালায়। তারা তাদের দুরবিসন্ধি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এই সময়টাকে অর্থাৎ মধ্যযুগকে অন্ধকার এবং বর্বর যুগ হিসেবে চিনহিত করতে চেয়েছে। কিন্তু সত্য ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না। হ্যাঁ, মধ্য যুগ অন্ধকারাছন্ন এবং বর্বর ছিল তবে সেটা মুসলিম সভ্যতা নয়। বরং তখন গোঁটা ইউরোপই অন্ধকার এবং কুসংস্কারে আছন্ন ছিল।

Hp র প্রাক্তন CEO কারলি ফিওরিনা ২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এক ভাষণে, সেই সময়ের ইসলামিক সভ্যতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকার করে নেন। ঐ ভাষণের লিঙ্ক টা আমি কমেন্ট বক্সে দিয়ে দিব।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমারা স্বর্ণযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীদের নানা বই ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে অত্যন্ত অদ্ভুত এবং ঘৃণিত এক কাজ করে বসে। তারা ইতেহাসে প্রথম বারের মত অনুবাদের পাশাপাশি মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে, যেটাকে তারা বলে ল্যাটিন ভাষায় নাম অনুবাদ। আচ্ছা নাম কি কখনো অনুবাদ করা যায়! বা নাম কি অনুবাদ করার মত কোন জিনিস!? তারা মুসলিম বিজ্ঞানীদের এমন এমন নাম দেয় যা শুনে বুঝার উপায় নেই যে উনারা আসলে মুসলিম। মুসলিম লেখক ও বিজ্ঞানীদের নাম বেশ বড়সড় হলেও, ল্যাটিন ভাষায় তাদের নাম দেওয়া হয়েছে একটি মাত্র শব্দে।

যেমনঃ ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা হলেও পরিবর্তন করে তার নাম দেওয়া হয়েছে আভিসিনা(Avicenna), বীজগণিতের জনক খাওয়ারিজমির নাম দেওয়া হয়েছে এলগোরিজম(Algorism), প্রথম মানচিত্র অঙ্কনকারি আল-ইদ্রিসের নাম দেওয়া হয়েছে দ্রেসেস(Dresses)। শুদু এই কয়েক জনই নয় বরং সকল মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রতিই তারা এই অবিচার করেছে। আমি আরেকটি সাইটের লিঙ্ক দিয়ে দিব, যেখানে অন্যান্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের আসল নাম ও তাদের বিকৃত নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই দেখে নিবেন।

তাদের দেওয়ার এই নাম গুলা যখন কোন শিক্ষার্থী বা যে কেউ প্রথম বার শুনবে, তারা কখনো চিন্তাও করবেনা যে উনারা আসলে মুসলিম। নাম শুনে উনাদেরকে অমুসলিম হিসেবে ভেবে নিবে। মানে ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখেছেন, কত গভীর আর সুদূর প্রসারী চক্রান্ত। আব্দুল্লাহ, মোহাম্মদ, আবু বকর, আল-শরীফ এই সুন্দর ইসলামিক নাম গুলো পর্যন্ত তাদের সহ্য হল না। ইসলামিক স্বর্ণযুগের শুরুতেও তো মুসলিমরা প্রাচীন গ্রিক ও ভারত দার্শনিকদের নানা রচনা আরবি, সিরিয় ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করেছে, কই তারা তো এমনটা করেনি।

এই পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত অদ্ভুতরে ঠেকেছে। লেখকের আসল নাম বদল করে নতুন নাম দেওয়ার মত এমন ঘটনা এর পূর্বে বা এর পড়ে কখনো ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

আরও শুনেন, তারা শুধু নাম বিকৃত করা পর্যন্তই থেমে থাকেনি, এমনকি তাদের পরিচয় নিয়েও নানা বিভ্রান্তি,ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে। কারো ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে উনি আদৌ মুসলিম নন, কারো অবদানকে খাটো করে দেখানো হচ্ছে। রসায়নের জনক জাবির হাইয়ান এমন এক চক্রান্তের স্বীকার। ইউরোপের এক ঐতিহাসিকের দাবি, জাবির ইবনে হাইয়ান ছাড়াও আরেক জন জাবির ছিলেন। উনার না ‘জিবার’ এবং উনি ইউরোপের অদিবাসি। এমন আর অসংখ্য উদাহরন রয়েছে।

এবার আমাদের অবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। আমরা কি মুসলিম বিজ্ঞানী, তাদের আবিস্কার, গবেষণা গুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে? তাদের নিয়ে আলোচনা কিংবা লেখা-লেখি? আমাদের শিশু কিশোররা কি গ্যলিলিও, নিউটন দের পাশাপাশি নাসিরুদ্দিন তুসি, আল-ফরগানি, আল-জাজারিদের সম্পর্কে কখনো জেনেছে, তাদের সম্পর্কে কখনো পড়েছে? বিজ্ঞান বিষয়ক শিশুতোষ বা কিশোর লেখা গুলতে তারা কি কখনো মুসলিম বিজ্ঞানীদের অসাধারণ গবেষণা, আবিস্কার গুলো সম্পর্কে জেনেছে? কেন এমনটি হল? আসলে এই বিষয়ে পশ্চিমারা যে নীতি আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, আমাদের পরাজিত মন মানসিকতাও তা বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছে।

আমরা কি পারি না ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেতে, মুসলিম বিজ্ঞানদের অবদান, আবিস্কার নিয়ে কথা বলতে? আমাদের শিশু-কিশোররা যখন তাদের পূর্ব পুরুষদের এই গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস এবং অর্জন গুলো সম্পর্কে জানবে, তখন তাদের মধ্যে আর হীনমন্যতা কাজ করবেনা। এই ইতিহাস আর গল্প গু লো তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে দারুণ ভাবে। হলিউড, বলিউড এর নায়ক-নায়িকা, গায়ক বা সেলিব্রেটি খেলোয়াড় কিংবা তথাকথি টিকটক সেলিব্রেটিদের বদলে খোঁজে পাবে তার আসল আদর্শকে। তখন ইবনে সিনা, ছাবেত ইবনে কোরা, ওমর খৈয়ামরা হবে তাদের আইডল।

সেই শুভ দিনের প্রত্যাশা নিয়ে আমি আমার কথা আজকে এখানেই শেষ করছি!

পঠিত : ৯৬১ বার

মন্তব্য: ০