Alapon

ছোট শিরক এবং কিছু কথা...



একদিন সাহাবিরা মসজিদে বসে এন্টিক্রাইস্ট বা দাজ্জালের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন। দাজ্জাল। তারা বলাবলি করছিলেন ইতিমধ্যে তারা যা কিছু শুনেছেন এবং রাসুল এ ব্যাপারে তাদের যা যা বলেছেন.. আর তাদের কথাবার্তা বাস্তবতা,সত্যের সীমা অতিক্রম করে বহুদুর চলে গেল - যেমনটা আপনারা জানেন, এ ধরনের আলোচনায় ঠিক যা হয়। এতে সাহাবিরা কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। ঘাবড়ে গেলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন উপস্থিত হলেন, তিনি এমন মানুষদের সম্মুখে পেলেন যারা কোন কারনে কিছুটা আতঙ্কিত। তিনি বললেন, কী হয়েছে এখানে? তোমাদের এমন ভীত দেখাচ্ছে কেন? তারা বললেন, আমরা দাজ্জালের আবির্ভাবের ব্যাপারে কথা বলছিলাম, এন্টিক্রাইস্টকে নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এটা নিয়ে আমরা খুবই আতঙ্কগ্রন্থ হয়ে পরলাম। দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম ৷

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কী এমনকিছুর ব্যাপারে জান যা আমার কাছে তোমাদের জন্য স্বয়ং দাজ্জালের বা এন্টিক্রাইস্টের চাইতেও বেশি ভয়ংকর ? তারা বললেন, সেটা কী হে আল্লাহর রাসুল? তিনি জবাব দিলেন - ছোট শিরক । ছোট শিরক মানে এখানে বহু ইশ্বরের পূজা। তো সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ছোট শিরক বলতে আপনি কি বোঝালেন? ছোট শিরক আসলে কী হে আল্লাহর রাসুল ?

তিনি বললেন - মনে কর কোন ব্যক্তি সালাতের জন্য দাড়ালো আর তখন লক্ষ্য করলো যে অন্য কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে, তাই সে তার নামাজের সৌন্দর্য বাড়াতে শুরু করলো.. কেননা কেউ তাকে দেখছে এটা সে বুঝতে পেরেছে। তো এই ব্যক্তি নামাজ পড়ছে, আল্লাহু আকবার বলছে, শুধু আল্লাহকেই তার মনে ধরছে - ঠিক এমন সময়েই সে দেখলো মসজিদেরই কেউ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে - হঠাৎ তার পৃষ্ঠদেশ সোজা হয়ে গেল ! আর তারপর সে শুরু করলো, তাজবিদের সাথে সুন্দর তেলাওয়াতে -
الحمد لله رب العالمين
আর যখন সুরা ফাতিহা সমাপ্ত হলো, লম্বাচড়া একখানা "আমিন" তার মুখ থেকে প্রস্ফুটিত হলো। সে জানে যে ওই ব্যক্তি তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর তাই শুরু করে দিল সুরা বাকারা।

الٓمٓ
অথচ সাধারণত সে সুরা কাউসার পাঠ করে থাকে। কিন্তু এখন ওই ব্যক্তি যেহেতু তাকে দেখছে - সে সুরা বাকারা শুরু করেছে - এটাকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন " ছোট শিরক "। নামাজকে অলঙ্কৃত করা - যেটাকে বলা যায়, আপনার নিয়ত পরিবর্তন করা। অথবা আমার বলা উচিত - আপনার নিয়তকে দূষিত করা। হ্যা এটাই হচ্ছে ছোট শিরক বলতে যা বোঝায়। এটা মূলত আপনার নিয়তকে দূষিত করা এবং আল্লাহর পাশে বাকিদেরও সেখানে যুক্ত করা যাতে করে তাদের প্রশংসা লাভ করা যায়।

তো আপনি আল্লাহর ইবাদত করছেন, অন্য কোন প্রতিমার নয় - যদি অন্য প্রতিমার ইবাদত করতেন,সেটাকে বলা হত মুখ্য বা বড় শিরক। ঠিক? এটা বড় শিরক নয়, এটা হচ্ছে ছোট শিরক। আপনি কোন প্রতিমার পূজা করছেন না, কোন মেকি ইশ্বরের সামনে মাথা নত করছেন না। আপনি আল্লাহর প্রার্থনা করছেন,আল্লাহর জন্য দান খয়রাত করছেন। যা-ই করছিলেন শুধু আল্লাহর জন্য করছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে আপনার নিয়ত দূষিত হতে শুরু হল। আপনার নিয়ত পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হয়ে গেল। সেটা কিসের জন্য পরিবর্তিত হল? - যাতে মানুষদের মাঝে কিছুটা খ্যাতি অর্জন করা যায়, কিছুটা প্রশংসা লাভ করা যায়। তো এখানে দুই ধরনের উদ্দেশ্য একত্রিত রয়েছে, গভীরে পর্যবেক্ষণ করলে অবশ্যই আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশ্য আপনার আছে - সেজন্যই তো আপনি পড়ছেন।

কিন্তু সাথে খ্যাতি উপার্জনের উদ্দ্যেশ্যটাও রয়েছে, রয়েছে পরিচিতি লাভের আকাঙ্খা - যাতে মানুষ আপনাকে পবিত্র ও ধার্মিক হিসেবে জানে। আর এটাকেই আমরা বলি 'লোক দেখানো কাজ' বা রিয়া । এটাই হচ্ছে তা যেটাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুদ্রতর শিরক বলে সাব্যস্ত করেছেন। জেনে রাখুন যে অতিরিক্ত পর্যায়ে যদি এই ছোট শিরক হতে থাকে, দীর্ঘদিন ধরে এই ছোট শির্ক হওয়া মূলত মূনাফিকির লক্ষন।

একজন পুরোদস্তুর মুনাফিক, ভন্ড - সে যা ই করে সবই মানুষের জন্য। সে মসজিদে কেন আসে? কেননা সে যাদের সাথে সালাত আদায় করে তাদের সে খুশি করতে চায়। কেন সে দান খয়রাত করে, কারন সে চায় মানুষ দেখুক যে সে দানসদকা করছে। যদি কোন মানুষের সমগ্র জীবন, তার সকল কাজ রিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যায় - তাহলে সে একজন মুনাফিক। সেই মানুষটা মুনাফিক কেননা তার সকল ইবাদত উৎসর্গিত ছিল শুধুমাত্র নিজের খ্যাতি,পরিচিতি,মর্যাদা,আত্মসম্মানের জন্য। এবং আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে ' আল্লাহ বলেন - আমি সেই সত্তা যার যেকোন ধরনের সঙ্গের সবচাইতে কম প্রয়োজন। আমার কোন সঙ্গীর প্রয়োজন নেই।'

এটি একটি হাদিসে কুদসি। বিখ্যাত হাদিস। যেকোন ধরনের সঙ্গীরই আমি সর্বনিম্ন মুখাপেক্ষী, আমার কারো সাথে কোন কিছু ভাগাভাগি করবার প্রয়োজন নেই! 'তো যে কেউ, যখন আমাকে খুশি করার জন্য কোন কিছু করে, সাথে আমার সাথে অন্য কারো জন্যও করে' - লক্ষ্য করুন এখানে ছোট শিরকের কথা বলা হচ্ছে, সে কোন প্রতিমার জন্য সেটা করছে না, অন্য কোন সত্তার জন্যও করছে না - 'যে কেউ আমাকে খুশি করবার জন্য কিছু করবে এবং সাথে আমাকে ভিন্ন অন্য কারো জন্যও করবে - আমি তাকে তার সেই সঙ্গীর জন্য ছেড়ে দেই। তাকে তার সেই সঙ্গী পুরস্কৃত করুক, আমি তাকে পুরষ্কৃত করছি না '।

তো সে ব্যক্তি যে নামাজের জন্য দাড়িয়েছিল, এবং পৃষ্ঠদেশ সোজা করে সুরাতুল বাকারা তেলাওয়াত ধরেছিল এবং মানুষদের খুশি করতে আপ্রান চেষ্টা করছিল - বুঝতে পারেনি যে তার সমগ্র সালাত, তার পুরো ইবাদত তার দিকেই ছুরে মারা হবে। দান সংগ্রহের সময় হয়েছে - কেউ খুবই বড়সড় চেক এমাউন্ট লিখে দিল, আর তার লক্ষ্য হল যাতে করে বিষয়টি মাইকে ঘোষণা করা হয় - ' ও মা শা আল্লাহ, ড. উমুক পাঁচ লক্ষ্য টাকা দান করেছেন, তাকবির!! '.... সবাই চিল্লিয়ে উঠলো তাকবীর। - এখন এই ব্যক্তির ইগো সে কক্ষের চাইতের বড় হয়ে গেল যেখানে তাকবীর ধ্বনিটি উচ্চারিত হয়! যখন এমনটা হয়, আমাদের আসলেই গুরুতর সমস্যা রয়েছে - আর সেটা হচ্ছে সেই ছোট শিরকের সমস্যা। সেই সমস্যা যেটার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি এই সমস্যার ব্যাপারে বেশি চিন্তিত, দাজ্জালের থেকে। আপনারা জানেন সেটা কেন?... যদিও আমাদের ট্রেডিশান অনুযায়ী দাজ্জাল সবচাইতে ভয়ংকর একটা ঘটনা যা মানুষের সাথে হতে পারে। যখন দাজ্জাল আসবে, সাগর বিভাজিত হবে, চাঁদ… ইত্যাদি সকল বিষয় ঘটতে থাকবে। কেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের আবির্ভাবের চাইতেও এই ছোট শিরকের অস্তিত্ব নিয়ে বেশি চিন্তিত ? এটি মূলত বাস্তবতার সাথে জড়িত একটি বিষয়। দাজ্জাল শুধুমাত্র একবার আসবে, যখন সে আসে - আল্লাহ সে সময়ের মানুষদের সাহায্য করুক। কিন্তু যতদিনে সে আসে ততদিনে শত শত প্রজন্ম আসবে,হাজার হাজার জেনারেসান অতিক্রান্ত হবে যারা ছোট শিরকের এই রোগে আক্রান্ত হতে থাকবে। নিষ্ঠাহীনতার এই বিপর্যয়ে পর্যদুস্ত হবে - যেখানে আল্লাহর জন্য করা তাদের পবিত্র কোন উদ্দেশ্য মিশে যাবে মানুষদের খুশি করার আকাঙ্ক্ষার সাথে।

এবং এটি একটি বর্তমান ও বাস্তব সমস্যা। ' তাই, তোমরা আমার সঙ্গীরা, তোমরা কেন এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলছো যেটা বহুদূরে - যখন তোমাদের সামনেই স্পষ্ট ও উপস্থিত বিপদ রয়েছে, এখানেই এবং এখনই। আর সেটা হচ্ছে কপটতা '। তো তিনি বলেন, আমি দাজ্জালের আবির্ভাবের থেকে অধিক চিন্তিত এই কপটতা নিয়ে যা কিনা লোকদেখানো কাজের সাথে বা রিয়ার সাথে বা ছোট শিরকের সাথে জড়িত। আর এটা আমার উম্মাহর জন্য বেশি ক্ষতিকর হবে দাজ্জালের আবির্ভাবের চাইতে।

পঠিত : ৪০১ বার

মন্তব্য: ০