Alapon

শাইখুল মুজাহিদ উমর আল মুখতার রহিমাহুল্লাহ



মরু সিংহখ্যাত শাইখুল মুজাহিদ উমর মুখতার রহিমাহুল্লাহ। তিনি ১৮৫৮ সালে লিবিয়ার আল-বুতনান জেলায় জানজুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর দ্বীনের এই মুজাহিদ, দখলদার ও সাম্রাজ্যবাদীদের ত্রাশ ছোটোবেলায়ই নিজ বাবা-মাকে হারান।

তাঁকে লালনপালন করেন শারিফ আল গারিয়ানী নামক এক ব্যক্তি।

দখলদারদের জম এই মর্দে মুজাহিদ ১৯৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টম্বর সাম্রাজ্যবাদী দখলদার ইতালীয় কাফির সেনাদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের অমিয় সুধা পানে যখন তিনি ধন্য হন, সে সময় তাঁর বয়স ছিলো ৭২ বছর।

মরু সিংহ উমর মুখতারের জীবনটাই কেটেছে দাওয়াত-তারবিয়াত ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মাধ্যমে। তিনি ১৮৯৯ সালে সুদান থেকে সাম্রাজ্যবাদী বর্বর ফরাসি কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চাদে গিয়েছিলেন। উসমানি সালতানাতের পক্ষেও তিনি একইভাবে জিহাদ করেছেন।


মুসলিম ভূখণ্ড দখলকারী সাম্রাজ্যবাদি ক্রুসেডার সেনারা যখন উমর আল মুখতারকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে, তখন মানবতার দুশমন মুসোলিনির ইটালিয়ান এক সেনা অফিসার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলো:

তুমি কি জানো তোমার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড?

জবাবে উমর মুখতার বলেছিলেন, হ্যাঁ জানি। ওই অফিসার বললেন, তুমি যা করেছো সেটার জন্য তুমি কি অনুতপ্ত?

উমর মুখতার বললেন: প্রশ্নই হয় না, আমি আমার ভূখণ্ড আর মানুষের জন্য লড়েছি।

সেনা আদালতের বিচারক তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার মতো লোকের এমন পরিণতি দেখে আমি দুঃখিত।

শাইখুল মুজাহিদ বললেন, "কিন্তু এটাই তো জীবন শেষ করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। মহান আল্লাহ তাআলাকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে এভাবে বীরের মতো শহীদ হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।”

এরপর বিচারক তাঁকে অফার দিলো যে, তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হবে যদি তিনি মুজাহিদদের কাছে এই মর্মে চিঠি লেখেন যেনো মুজাহিদরা তাদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করে। তখন উমর মুখতার বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন:

"যেই শাহাদাত অঙ্গুলি দিয়ে আমি প্রতিদিন সাক্ষ্য দেই যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। সেই আঙ্গুল দিয়ে অসত্য কোনো কথা লিখতে পারবো না। আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করি না। আমরা হয় জিতি, না হয় মরি।"

সত্যিই তিনি বাতিলের কাছে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন- হয় জিতি না হয় মরি ! এই মরাটাও কিন্তু এক প্রকার জিতে যাওয়া। যেই জেতাটা অনন্তকালের জন্য !


শাইখুল মুজাহিদ উমর মুখতার রহিমাহুল্লাহ ২০ আগস্ট ১৮৫৮ (মতান্তরে ১৮৬২ সালে) সালে লিবিয়ার সিরনিকার আল-বুতনান জেলায় জানযুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই মহান মানুষটি শৈশবেই নিজ পিতা-মাতাকে হারান।

তাঁর বাবা মারা যান তখন, যখন তাঁর বয়স ষোলো বছর। তিনিও একজন সৌভাগ্যবান সুপুরুষ, তিনি হজ করতে গিয়েক ইন্তেকাল করেন। উমর আল মুখতারের বাবা মারা যাওয়ার পরে উমরের এতিম উমর আল মুখতারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্থানীয় সেনুসি শাইখ শেরিফ আল-গারিয়ানি।

লিবিয়াতে সেনুসি দর্শনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন শেরিফ আল-গারিয়ানির চাচা হুসেন আল-গারিয়ানি। তিনি সর্বপ্রথম ১৮৪৪ সালে আল-বেইদাতে গ্র্যান্ড সেনুসির ছেলে মোহাম্মদ আল-মাহদির সাথে মিলে সেনুসি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ছোটবেলা থেকেই উমর আল-মুখতার সেনুসিদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ এবং মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। বাবার মৃত্যুর পর শেরিফ আল-গারিয়ানির তত্ত্বাবধানে তিনি আল-জাগবুবের সেনুসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ বছর পড়াশোনা করেন। এ সময় তিনি পবিত্র কুরআনুল কারিম হিফজ সম্পন্ন করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করার পরে তিনি স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কুরআনের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

শাইখুল মুজাহিদ সব সময়ই একজন আবেদ ইনসান ছিলেন। অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার একজন মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত সলাত তিনি জামাতের সাথেই আদায় করতেন। ইবাদাতগুজারি এবং কাজকর্মে এতো বেশি নিবেদিত থাকতেন যে, রাতে তিনি তিন-চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেনই না। শুরু থেকেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হতো সত্যিকারের মুজাহিদদের মতো। তাঁর রাতের শেষাংশ কাটতো তাঁর তাহাজ্জুদের জায়নামাজে। এমনও শোনা যায় যে, প্রতি সপ্তাহে তিনি একবার পবিত্র কুরআন মাজিদ খতম করতেন। দ্বীনি ইলমে তাঁর ছিলো অগাধ গভীরতা এবং শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন তিনি স্বনামধন্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত। যার কারণে সেনুসি কর্তৃপক্ষ তাঁকে কুরআনের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে সুদানে প্রেরণ করে।

সুদানে যাওয়ার কয়েক বছর পরেই তিনি ১৮৯৯ সালে স্রমাজ্যবাদি বর্বর ফরাসি কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সেনুসিদের প্রধান, মোহাম্মদ আল-মাহদির নির্দেশে সেনুসি মুজাহিদদের সাথে চাদে গিয়েছিলেন। ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তি তখন চাদ দখল করে উত্তরে দিকের আরো কিছু জায়গা দখল করার জন্যে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে বলেই সেনুসিরা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়।

১৯১১ সালে ইতালিয়ানরা লিবিয়া আক্রমণ করে। লিবিয়া ছিলো তখন উসমানি সালতানাতের অধীন। ইতালিয়ানরা লিবিয়ার উপকূলে এসে উসমানি সুলতানের কাছে লিবিয়াকে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, উসমানি সালতানাতের খলিফা তখন কোনো ধরনের প্রতিরোধ না করে ইতালিয়ানদের সাথে সমঝোতায় যান, এবং লিবিয়ার একটা অংশকে ইতালির হাতে তুলে দিতে চায়।

কিন্তু এতেও তুষ্ট হয়নি তারা। যার প্রেক্ষিতে তারা লিবিয়ার ত্রিপলী এবং বেনগাজীতে আক্রমণ শুরু করে। টানা তিন দিন ধরে তারা ত্রিপলী এবং বেনগাজীতে জাহাজ থেকে বোমা বর্ষণ করতে থাকে।

এই যখন অবস্থা, তখন বাধ্য হয়েই প্রতিরোধ-যুদ্ধ শুরু করে উসমানিও সৈনিকরা। এরপর মুসলিম ভূখণ্ড কাফিরদের হাত থেকে রক্ষার্থে তাদের সাথে যোগ দেয় স্থানীয় লিবিয়ানরা এবং সেনুসি সৈন্যরা।

যখব যুদ্ধ ‍শুরু হয়, সে সময়টাতে উমর মুখতার এখানে ছিলেন না। তিনি যখন খবর পেয়েছেন, তখন তিনি ইতালীয় কাফির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্যে একদল মুজাহিদকে সাথে করে নিয়ে আসেন এবং বীর বিক্রমে সিংহ গর্জনে দখলদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে যান।

১৯১১ সাল থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত টানা বিশটা বছর লড়াই করার পরে ১১-ই সেপ্টম্বর তিনি দখলদার হাতে বন্দী হন, এবং তাঁকে কোনোভাবে ম্যানেজ করতে না পেরে ১৬-ই সেপ্টেম্বরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয় এই মুজাহিদ-নায়ককে।

আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে এই মর্দে মুজাহিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। আ-মী-ন !!

~ রেদওয়ান রাওয়াহা
https://t.me/RedwanRawaha

পঠিত : ৪৮০ বার

মন্তব্য: ০