Alapon

আসুন, নিয়ত মেরামত করি

যদি সত্যিই আজ এই হুকুম বহাল থাকত—নিজ পুত্রকে নিজ হাতে কুরবানি দিতে হবে; তবে কি আমরা সত্যিই দিতাম?

পুত্রহত্যার হুকুম না হয় রহিত হয়েছে, কিন্তু ভেতরের পশুটা হত্যার হুকুম তো রহিত হয়নি। কিন্তু আমরা কি মোটেই পেরেছি সে পশুটিকে হত্যা করতে? হত্যা তো দূরের কথা, পেরেছি কি আহত করে সামান্য দুর্বল করে দিতে? পারিনি।

কুরবানির ইতিহাসটা আমরা জানি। জানি কোন প্রেক্ষাপটে ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামকে জবাই হওয়া থেকে রক্ষা করে আল্লাহ সেখানে একটি প্রাণি এনে দিয়েছিলেন।

লোক দেখানোর জন্য বিশাল গরু কিনে মালা পরিয়ে রাস্তায় ঘোরানোর কথা বলছি না। আমাদের যাদেরকে আল্লাহ এমন নিম্নরুচির হাত থেকে রক্ষা করেছেন সেই আমাদের নিয়েই বলছি। এই আমরা যারা অন্যদের প্রদর্শনেচ্ছা নিয়ে মন্তব্য করি, এই আমরা যারা অন্যদের কুরবানি কেবলই গোশত খাওয়া আর লোক দেখানোর ভড়ং মনে করি, অথচ নিজের কুরবানিকে কবুল ভাবতে পছন্দ করি—এই আমাদেরকে আমাকে নিয়েই বলছি।

সচেতনভাবে যদি আমরা একান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করতাম তাহলে আমাদের অনেক কিছু অন্য রকম হতো। তাহলে কেবল পশু জবাইয়ের মধ্যেই এর প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকত না। এটা হতো নির্মল এক ‘ইবাদাতের উপলক্ষ্য; আর গোটা জীবনের ওপর থাকত এর গভীর প্রভাব। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে গিয়ে নানা অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে কুরবানি আজ আমাদের কাছেও কেবলই উৎসব। বাস্তব জীবনে এর কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না।

আল্লাহর অনেক নির্দেশ স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে অবহেলাভরে যে আমরা উপেক্ষা করি, সেই আমরাই কুরবানি দেওয়ার পর্যাপ্ত সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় জোর করে দিই। অনেক সময় নিজের সামর্থ্য ডিঙিয়ে বড় আকারের পশু কোরবানি দিই। যে আমি অন্য ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করি, সেই আমাকে যখন দেখা যায় কুরবানির ক্ষেত্রে এত সচেতন, এত সজাগ, এত তৎপর তখন নিজের কাছেই তো প্রশ্ন জাগা উচিত—আমার এই ‘নুসুখ’ কার জন্য?

আমাদের অবচেতন মনে আল্লাহর সন্তুষ্টির একটা প্রচ্ছন্ন প্রণোদনা থাকলেও তার সচেতন ও কার্যকর উপস্থিতি সত্যিই অনুল্লেখযোগ্য। অন্তত আল্লাহর কাছে আমল গৃহীত হওয়ার জন্য ন্যূনতম যে মাত্রার একনিষ্ঠতা থাকা প্রয়োজন তাও নেই। সত্যিই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরবানি করা হচ্ছে কি না উপলব্ধির জন্য আপনি একটা কৌশল প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।

ধরুন, আপনি এই বছর কুরবানি দেবেন না, বা দিতে পারবেন না। একারণে আপনার মন কিছুটা খারাপ, মনের মধ্যে খচখচ করছে; একটা অস্বস্তিবোধও কাজ করছে। সেক্ষেত্রে আপনার মনে কোন জিনিসটা অধিক জোরালোভাবে খচখচ করে সেটাকে বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার মনে কি সত্যিই আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথাটা বারবার জেগে উঠছে, নাকি অন্য কোনো বিষয় এসে হাজির হচ্ছে। আহ, ছেলেমেয়েগুলো মন খারাপ করবে, কী বলবে আশপাশের মানুষ; পাশের বাসার ভাবির সামনে স্ত্রী কতটা হীনম্মন্যতায় ভুগবেন, পাড়ামহল্লার লোকেরা আন্ডার-এস্টিমেট করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি কুরবানি না দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোই অধিক জোরালোভাবে মনে জেগে ওঠে, তাহলে বোঝা যাবে দেওয়ার পেছনেও এগুলোই মুখ্য কারণ ছিল—হোক সচেতনভাবে, কিংবা অবচেতনভাবে।

আমাদের পশুর দাম সাওয়াবের আকাঙ্ক্ষার উপর নির্ধারিত হয় না। কী পরিমাণ গোশত আমরা সংরক্ষণ করতে চাই ফ্রিজে, এর ওপর নির্ভর করে পশুর সাইজ কেমন হবে। সমাজে রাজনৈতিক অবস্থান থাকলে সেক্ষেত্রে দরিদ্রদের মাঝে বিলি করার একটা রাজনৈতিক ব্যাপার থাকে; কতটুকু সেটা ধর্মীয় সে বিবেচনার ভার আপনার ওপর।

ছেলেমেয়েগুলো অন্যের কুরবানি দেওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকবে, ওদের খারাপ লাগবে, হীনম্মন্যতায় ভুগবে ইত্যাদি বিষয় চিন্তা করে সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও কখনো কুরবানি দিই আমরা। এটা একটা বেশ আবেগের জায়গা।

সব মিলিয়ে প্রশ্ন হলো—এই কুরবানির পেছনে সত্যিকারে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য কতটুকু থাকে সেটা আমাদের সচেতনভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

এরপর আসে উপলব্ধির প্রশ্ন। কুরবানির সত্যিকার উপলব্ধি কি আমাদের মধ্যে থাকে? এটা কি সত্যি আমরা বিশ্বাস করি—“নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার ত্যাগ, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবই বিশ্বজাহানের রব আল্লাহর জন্য” নাকি কেবল মুখেই বলি?

আমাদের জীবন-মরণ কি সত্যিই আল্লাহর জন্য নিবেদিত? নাকি কেবলই নিজের নাফ্স আর পরিবার-পূজায় দিবানিশি উৎসর্গিত?

আমরা অধিকাংশই সকালে ঘর থেকে বের হই কেবলই নিজের আর নিজের পরিবারের চাহিদার (কেবল প্রয়োজন নয়) জোগান দিতে। সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটে এই আলু-পটল জোগানোর চিন্তা নিয়েই। আবার অফিস শেষ করেই আদর্শ স্বামী হওয়ার জোর তাগাদা থাকে, কত দ্রুত গিয়ে আঁচলে মুখ লুকানো যায়! নাহলে ‘তিনি’ গোস্বা করবেন!

তো দিনশেষে সেই দিনও কেবল নিজেদের জন্য আর রাতও কেবল নিজেদেরই জন্য। তাহলে জীবন মরণ সব কেবল আল্লাহর জন্য এ কথার কী বাস্তবতা আমাদের জীবনে?

নিখাদ আত্মসমালোচনা এ আলোচনার উদ্দেশ্য। চিন্তাটা জাগার পেছনে কারণ হলো—আমরা যে পরিমাণে পশু কুরবানি করি, তা যদি আমাদের ভেতরের সত্যিকার অবস্থার মাত্র একভাগকেও প্রতিনিধিত্ব করত, বাকি নিরানব্বই ভাগও মিথ্যা হতো, তবু আমাদের ব্যক্তিগত, সসামাজিক ও জাতীয় অবস্থা এর চেয়ে হাজারগুণে ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য যে একান্ততা প্রয়োজন তা কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে স্ক্রলিংয়ের সময় হয় না। কোথাও একেবারেই নিভৃতে, কেবল মহান রব্বের সাথে একাকী বসে দেখতে হবে মনের সরোবরটাকে। যেন একদম স্বচ্ছ জলের মতো একেবারে তলাতে যা আছে তা-ও দেখা যায় পষ্ট। হয়তো তখন বুঝতে পারব—আমার জীবন, আমার মরণ, আমার সালাত, আমার কোরবানি এগুলো কি সব আসলেই আল্লাহর জন্য? নাকি অন্য কিছুর জন্য?

পঠিত : ৩৯৪ বার

মন্তব্য: ০