Alapon

আদম আ.-এর ঘটনা ও শিক্ষা



হযরত আদম আঃ কে সৃষ্টির সময়কার ইতিহাস নিয়ে নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। সেগুলো হলো,

১- পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টির কথা জেনে ফেরেশতারা প্রতিবাদ করে।
২- আল্লাহ আদম আ.-কে গোপনে ইলম দান করে ফেরেশতাদের উপর আদম আ.-এর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
৩- আদম আ. জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৪- বেহেশতে ইবলিশের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার শাস্তিস্বরুপ আদম আ. দুনিয়ায় নির্বাসিত হন।
৫- আদম আ.-এর স্ত্রী তাঁকে ইবলিশের প্ররোচনায় ফল খাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে।
৬- নিষিদ্ধ ফল খেয়ে মলমূত্রের চাপ তৈরি হয়। মলত্যাগ করার জন্য আদম আ. ও তাঁর স্ত্রীকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়।
৭- দুনিয়ায় ৩০০ বছর তাওবা করার পর আদম আ. নবী হন।
৭- দুনিয়ার শাস্তি থেকে পাকসাফ হয়ে গেলে আবার বেহেশতে যাওয়ার সুযোগ আসবে।

পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ৪র্থ রুকুতে এই নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে

(২:৩০) আবার সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের বলেছিলেন , “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই ৷”তারা বললো, “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে? আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি৷” আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না ৷”

(২:৩১) অতপর আল্লাহ আদমকে সমস্ত জিনিসের নাম শেখালেন তারপর সেগুলো পেশ করলেন ফেরেশতাদের সামনে এবং বললেন, “যদি তোমাদের ধারণা সঠিক হয় তাহলে একটু বলতো দেখি এই জিনিসগুলোর নাম? ”

(২:৩২) তারা বললোঃ “ত্রুটিমুক্ত তো একমাত্র আপনারই সত্তা, আমরা তো মাত্র ততটুকু জ্ঞান রাখি ততটুকু আপনি আমাদের দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনি ছাড়া আর এমন কোন সত্তা নেই যিনি সবকিছু জানেন ও সবকিছু বোঝেন ৷”

(২:৩৩) তখন আল্লাহ আদমকে বললেন, “তুমি ওদেরকে এই জিনিসগুলোর নাম বলে দাও ৷”যখন সে তাদেরকে সেসবের নাম জানিয়ে দিল। তখন আল্লাহ বললেনঃ “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আকাশ ও পৃথিবীর এমন সমস্ত নিগূঢ় তত্ত্ব জানি যা তোমাদের অগোচরে রয়ে গেছে? যা কিছু তোমরা প্রকাশ করে থাকো তা আমি জানি এবং যা কিছু তোমরা গোপন করো তাও আমি জানি ৷”

(২:৩৪) তারপর যখন ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলাম, আদমের সামনে নত হও, তখন সবাই অবনত হলো, কিন্তু ইবলিস অস্বীকার করলো৷ সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মেতে উঠলো এবং নাফরমানদের অন্তরভুক্ত হলো ৷

(২:৩৫) তখন আমরা আদমকে বললাম , “তুমি ও তোমার স্ত্রী উভয়েই জান্নাতে থাকো এবং এখানে স্বাচ্ছন্দের সাথে ইচ্ছে মতো খেতে থাকো, তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না। অন্যথায় তোমরা দু’জন যালেমদের অন্তরভুক্ত হয়ে যাবে ৷”

(২:৩৬) শেষ পর্যন্ত শয়তান তাদেরকে সেই গাছটির লোভ দেখিয়ে আমার হুকুমের আনুগত্য থেকে সরিয়ে দিল এবং যে অবস্থার মধ্যে তারা ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে ছাড়লো ৷ আমি আদেশ করলাম, “ এখন তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ তোমরা একে অপরের শত্রু । তোমাদের একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করতে ও জীবন অতিবাহিত করতে হবে৷”

(২:৩৭) তখন আদম তার রবের কাছ থেকে কয়েকটি বাক্য শিখে নিয়ে তাওবা করলো ৷ তার রব তার এই তাওবা কবুল করে নিলেন৷ কারণ তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী৷

(২:৩৮) আমরা বললাম , “ তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও ৷ আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌঁছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা৷

(২:৩৯) আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী ৷ সেখানে তারা থাকবে চিরকাল ৷

এখানে ছাড়াও পবিত্র কুরআনে আরো ছয়টি সূরায় এই বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।

১- আল আরাফ ২য় রুকু
২- আল হিজর ৩য় রুকু
৩- বনী ইসরাঈল ৭ম রুকু
৪- আল কাহফ ৭ম রুকু
৫- ত্বাহা ৭ম রুকু
৬- সোয়াদ ৫ম বা শেষ রুকু

এই বিষয়ের উপযুক্ত ব্যাখ্যা হলো,
১- দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালা খলিফা পাঠাবেন বলে ঘোষনা শুনে ফেরেশতাদের মনে এই বিস্ময় সৃষ্টি হলো যে, তারা তো আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব যথাযথই পালন করছেন। তাহলে আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি? ফেরেশতাদের ধারণা ছিল তারা যে দায়িত্ব পালন করেছেন এতে আল্লাহ পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তাই ঐ দায়িত্বটি আরো ভালোভাবে পালন করার জন্যই হয়তো আদম আ. কে সৃষ্টি করার প্রয়োজন মনে করেছেন। ফেরেশতাদের এই ধারণা যে সঠিক ছিল না সে কথা বুঝানোর জন্যই আল্লাহ তায়ালা ব্যবস্থা করেছেন। ফেরেশতারা তাদের আশংকার কথা জানিয়েছেন। আপত্তি করার ইখতিয়ার ফেরেশতাদের থাকেনা।

২- আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন সে দায়িত্ব পালনের উপযোগী জ্ঞান তাদের দিয়েছেন। আদম আ. কে যে দায়িত্ব আল্লাহ দিতে চাচ্ছেন সে দায়িত্বের উপযোগী জ্ঞানও তাকে দিলেন। ফেরেশতাদের কাছে আদম আ. কে দেওয়া জ্ঞান যে নেই একথা প্রমাণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের বুঝিয়ে দিলেন আদম আ.-কে অন্যরকম দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

যেমন ডাক্তারী করার দায়িত্ব যাকে দেওয়া হবে তাকে মেডিকেল শিক্ষাই শিখানো হবে। অন্যদিকে যাকে দেশরক্ষার দায়িত্ব দেয়া হবে তাকে তার উপযোগী সমরাস্ত্রের জ্ঞানই দেয়া হবে। তাই ডাক্তার শ্রেষ্ঠ নাকি সেনা অফিসার শ্রেষ্ঠ এই প্রশ্ন অবান্তর। ঠিক তেমনি ফেরেশতার দায়িত্বের জায়গায় ফেরেশতা যোগ্য। খেলাফতের দায়িত্বের জায়গায় আদম আ. যোগ্য। এখানে আদম আ. এবং ফেরেশতাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা বা তুলনার ভিত্তি নেই।

৩- আদম আ. জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ তাই তাকে সিজদা করার জন্য বলা হয়েছে এটা ঠিক নয়। যদি জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতেই সিজদা করার নির্দেশ দেয়া আল্লাহ সঠিক মনে করতেন তাহলে পিতাকে সিজদা করার জন্য সন্তানদের নির্দেশ দিতেন। শিক্ষককে সিজদা করার জন্য ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন। এতে বুঝা যায় আদম আ. -কে সিজদা করার নির্দেশ ভিন্ন কারণে। মানুষকে খিলাফতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খিলাফতের কাজে সহযোগীতা না পেলে দুনিয়ায় কোন কাজই করতে পারবে না মানুষ। তাই খুব সম্ভবত ফেরেশতাদেরকে সিজদা করার নির্দেশ দেয়ার উদ্দেশ্য হলো মানুষের ইখতিয়ারে যাতে হস্তক্ষেপ না করা হয়। ফেরেশতারা আল্লাহর নাফরমানী করেন না এবং নাফরমানী পছন্দও করেন না তাদের সেই ইখতয়ারও নেই। মানুষ তার ইচ্ছামত কোনো বস্তুর ব্যবহার করতে চাইলে সেই বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী ফেরেশতা যদি বাধা দেয় তাহলে মানুষের ক্ষমতা থাকেনা। আল্লাহর নাফরমান বান্দাদের দুনিয়ায় চলার পথে পদে পদে বাধা দিলে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও চেষ্টার ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা দিয়েছেন তা ব্যহত হতে বাধ্য। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা আদম আ.-কে সিজদা করার মাধ্যমে ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা হয়।

৪- ইবলিশ নেতৃস্থানীয় জ্বিন ছিল। ফেরেশতা ছাড়াও জ্বিনদের মধ্যে শুধু ইবলিশকে সিজদা করার নির্দেশ দেয়া হলো কারণ সে আদম আ. কে খিলাফত দেবার বিরোধী ছিল এবং তার বিপরীতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিল। মহান আল্লাহ তায়ালা তার এই গোপন হিংসা প্রকাশ করার জন্যই তাকে সিজদা করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ আর ফেরেশতাদের নির্দেশের উদ্দেশ্য এবং কারণ ভিন্ন।

৫- মানুষকে খিলাফতের অযোগ্য প্রমাণ করার জন্য ইবলিশ যে কত যোগ্যতার সাথে শত্রুতা করতে সক্ষম সে কথা প্রমাণ করার জন্য আদম আ. কে দুনিয়ায় পাঠানোর পূর্বে জান্নাতে পাঠানো হয়েছে। খিলাফতের জন্য আদম আ. এবং ইবলিশের মধ্যে কে বেশী যোগ্য ও উপযোগী তা প্রমাণ হয়েছে যে, আদম আ. ইচ্ছে করে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেনি। আর ইবিলিশ জেনেশুনে অমান্য করেছে। আদম আ. যখন বুঝতে পারলেন আদেশ অমান্য হয়েছে তখন তিনি অনুতপ্ত হয়ে তওবা করেছেন আর ইবলিশ নাফরমানী করার যুক্তি প্রদর্শন করে জ্ঞানপাপী বলে পরিচয় দিয়েছে।

৬- এই কথা স্পষ্ট হয়ে গেলো ফেরেশতারা মানুষের প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং শুভাকাঙ্ক্ষী। আর এর বিপরীতে ইবলিশ মানুষের চরম শত্রু। ইবলিশ আদম আ. ও তাঁর স্ত্রীকে সমভাবেই ধোঁকা দিয়েছে। হাওয়া আ.-এর আলাদা ভূমিকার কথা কোনো সহীহ বর্ণনায় পাওয়া যায় না। মলমূত্র ত্যাগ করার গল্পও সহীহ সূত্রে পাওয়া যায় না। আর মলমূত্রের জন্য দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে এটাতো ভ্রান্ত কথা!

৭- মানুষকে দুনিয়ায় খেলাফতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনের পুরস্কার স্বরুপই মানুষ জান্নাতের অধিকারী হবে। তাই দুনিয়াটা মানুষের কর্মস্থল। শাস্তি দেবার জায়গা নয় এবং শাস্তির জন্য দুনিয়ায় পাঠানোও হয়নি। আদম আ.-এর নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার শাস্তি পুরো মানবজাতি ভোগ করছে না। এটা তো ইনসাফ নয়। বরং সত্য হলো আমাদের খলিফার দায়িত্ব পালনের জন্যই দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছে।

৮- আদম আ. দুনিয়ায় নবীর মর্যাদা নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন। নবী কখনো পাপী ও নাফরমান হন না। যে আদেশ অমান্য জান্নাতে হয়ে গিয়েছে এর তওবা সেখানেই কবুল হওয়ার মধ্য দিয়ে পবিত্র অবস্থায় তিনি দুনিয়ায় নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন।

আলোচ্য আলোচনার শিক্ষা :
১- দুনিয়ায় খিলাফতের দায়িত্ব পালনই মানুষের জন্য সর্বোচ্চ দায়িত্ব।
২- ইবলিশ মানুষের প্রকাশ্য শত্রু ।
৩- মানুষ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ভুলে ভবিষ্যতের সুখ শান্তির জন্য, ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার লক্ষ্যে কাজ করা এবং দুনিয়াবী উন্নতির রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর হওয়া মূলত ইবলিশের কুমন্ত্রণা।
৪- লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ইবলিশ তা ওপেন করে দিতে চায়। পর্দাহীনতা ইবলিশের দুর্দান্ত কৌশল।
৫- মানুষের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো যৌন আকাঙ্ক্ষা। তাই এই পথে হামলা করাই শয়তান সহজ মনে করে।
৬- ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা মানুষের পরিচায়ক নয় এটা শয়তানী বদভ্যাস।
৭- ইবলিশের শত্রুতা মোকাবেলা বড়ই কঠিন। বাঁচার উপায় ইখলাস। নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে চলার চেষ্টা যারা করে তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয় নেই।

প্রকৃত ঘটনা ও শিক্ষা মহান আল্লাহই ভালো জানেন। আমরা কেবল সীরাতুল মুস্তাকিমের অনুসন্ধান করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের পথে কবুল করুন। আমিন।

পঠিত : ৫০৪ বার

মন্তব্য: ০