Alapon

আমার বন্ধু আরিফ...



১.
সকাল থেকে আমার ভিষণ মন খারাপ। কোন কিছুই ভালো লাগছেনা। পাকা আমের মিষ্টি গন্ধে আজ আর আমার মন ভোরছে না। কদমের ডালের তাঁরার মেলা দেখে ও চোখ দুটি আজ তৃপ্ত হচ্ছে না। পুকুর ঘাটের সানের উপর রাখা আচারের পাত্র গুলো দেখেও আজ আর জ্বিভে জ্বল আসছে না। সকাল থেকে একের পর এক কার্বন বাতাস বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে চলছে। আজ আর স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে দলবল বেধে পুকুরে নেমে সাঁতার কাটা হলো না। আসাদদের বাড়ি কাঁঠাল খাওয়ার দাওয়াত ছিলো, তা আর খাওয়া হলো না।এক বুক কষ্ট নিয়ে হিজল তলায় বসে আছি।

এমন সময় আরিফ এসে আমার পাশে বসলো। কাধে হাত রেখে সালাম দিলো। ওর কন্ঠটা ভারি মিষ্টি। সালামের ধ্বনি গুলো ওর কন্ঠে মধু মাখা লাগে।পুরো নাম আরাফাত আরিফ।আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু। মাদ্রাসার ছাত্র। ইসলাম সম্পর্কে বেশ ভালোই জানে। ওর শুভ্র মুখের দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিলাম।আবার মুখ নামিয়ে গোমরা মুখে বসে রইলাম। আমার মনখারাপ দেখে আরিফ প্রশ্ন করলো," কি হয়েছে?" আমি ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "আব্বু আমাকে মেরেছে।প্রচুর বকা দিয়েছে। বাড়ি থেকে তাই বেড় হয়ে এসেছি। " আরিফ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো," কেন মেরেছে?" আমি খানিকটা ভাঙ্গা গলায় জবাব দিলাম,"ফজরের নামাজ পরিনাই। তাই প্রচুর মেরেছে। বলেছে নামাজ না পড়লে তেজ্যপুত্র করে দিবে।কি এমন করেছি আমি? এরকম করার কোনো মানে হয়।আমি আর বাড়িতে জাবোনা। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।"কথা গুলোর মধ্যে ছিল খানিকটা আক্ষেপ আর চাপা কষ্ট।আরিফ আমার দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

২.
হিজলতলা থেকে বাসার গেইটটা দেখা যাচ্ছে। পাশে রয়েছে সানবাধানো পুকুরের ঘাট। আরিফকে খুব অন্যরকম লাগছে এখন।আমার জবাব শুনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চুপ করে রয়েছে।হঠাৎ কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,"তুইকি চাস তোর বাবা তোর কোনো ভুলের জন্য জাহান্নামের আগুনে পুরুক?" আমি বিষ্ফরিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,"কিভাবে? আমি কি এমন করলাম যার জন্য আব্বু জান্নামে যাবে?" প্রশ্ন সুচক দৃষ্টিতে আরিফের দিকে তাকালাম। আরিফ আমার দিকে সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো," শোন তাহলে।তোকে, আমাকে, তোর আব্বুকে সহ বিশ্বের সবকিছু মহাপরাক্রমশালী দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টি।তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদাতের জন্য।যারা ইবাদত করবে, সৎ পথে চলবে, সত্য কথা বলবে, ইসলামের হুকুম আহকাম মানবে ও আল্লাহকে ভালোবাসবে।

তাদেরকে আল্লাহ পাক জান্নাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আর যারা মিথ্যা কথা বলবে, অসৎ পথে চলবে, ইবাদত থেকে বিরত থাকবে। তাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করবেন।এবার আসাযাক তোর ব্যপারে।তুই সালাত আদায় করিসনি। সালাত হলো আল্লাহর ইবাদত।তার মানে তুই ইবাদ থেকে বিরত ছিলি। তাহলে কি দারালো। তোর কাজে জাহান্নামীদের বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছে।আর তোর কাজের জন্য কেবল তুই না তোর আব্বুকেও আল্লাহ পাকরাও করবেন।কেননা আল্লাহ পাক মানুষদেরকে তাদের অধিনস্তদের কার্যকালাপের জন্য জবাবদিহি করবেন।বুঝলি?" আমি অনুতপ্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।আরিফ আবার বলতে শুরু করলো,"তোর আব্বুর ব্যবহারে হয়ত তুই কষ্ট পাচ্ছিস। কিন্তু তুই কি ভেবে দেখেছিস কেন তোর আব্বু তোর সাথে কঠর আচরন করলেন?তোকে তোর আব্বু ভালোবাসেন বলেই এমন করেছেন তিনি। তিনি কি জেনে শুনে তার সন্তানকে জাহান্নামী বানাবেন। তাইতো এত কঠোর হয়েছেন। তোর আব্বুর ঐ রাগি মুখের আরালেও একটা সুন্দর হাসি খুশি মন রয়েছে। তিনিও একজন মানুষ। তিনিও কষ্ট অনুভব করেন,দুঃখ পান।তার হৃদয়ও আমদের মতো কাঁদে।কিন্তু তিনি আমাদের মতো তার নরম রূপটা দেখাতে পারেন না।পৃথিবীর প্রতিটি বাবই কঠর চরিত্রের অভিনয় করে যান,নিরবে নিভৃতিতে দৃষ্টিরি আরালে চোখের জ্বল ফেলেন। কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। বাবাদের কষ্ট কি আমরা কখনো বুঝবো?"

৩.
আরিফের কথাগুলো আজও কানে বাঁজছে বলে মনে হয়। ২০ টি বছর দেখতে দেখতে চলে গেছে৷ বয়সটা আজ ৩৩ হলো। আমি আজ গ্রমের বাড়িতে এসেছি। প্রথমেই তাই চলে এলাম প্রিয় বন্ধুটির কাছে। কালোমাটির নিচে শুয়ে আছে সেই উজ্জ্বল দিপ্তিময় ছেলেটি।মাত্র ১৩ বছর বয়সেই হাশরের প্রথম ঘাটিতে চলেগেছে। ওর কবরের সামনে দাড়িয়ে এতক্ষন মুগ্ধ করা স্মৃতি গুলো ভাবছিলাম। হ্যা, আরিফ আজ আর এই পৃথিবিতে নেই।

কিন্তু রয়েগেছে আমার সাথে আরিফের কিছু জীবন্ত স্মৃতি। আরিফের সেই হৃদয়ে ঝর তোলা কথা গুলো সেদিন আমার জীবন পাল্টে দিয়েছিল।আজ আমি সফল।আল্লাহর প্রতি তৈরি হয়েছে প্রবল ভালোবাসা।কবর জিয়ারত করে দোয়া করলাম প্রিয় বন্ধুটার জন্য। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া অারিফকে যেন জান্নাতেও বন্ধু হিসেবে পাই।

হাজারো স্মৃতির মাজে কিছু স্মৃতি অমর হয়ে থেকে যায়। আরিফও তেমনি এক জীবন্ত স্মৃতি আমার জীবনের।

- তারিকুল ইসলাম শান্ত

পঠিত : ৩৭২ বার

মন্তব্য: ০