Alapon

ফাহমুস সালাফ ও মাকাসিদে শরীয়া



সালাফদের মুতাওয়ারিস ফাহম ও মানহাজকে পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে অনেকেই ফিকহের ইজতিহাদি কিছু মূলনীতির আশ্রয় নেন। যেমন মাকাসিদে শরিয়াহ ও মাসলাহাতকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে শরিয়াতের স্বতসিদ্ধ, প্রসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত ব্যাখ্যাকে পরিবর্তন করার দাবি তোলেন। আমরা এখন এই দুটি বিষয়ের সংশয় নিয়ে আলোচনা করব।

সংশয় : এ যুগের নামধারী কিছু আলেমরা বলে বেড়ায় যে, মাকাসিদ হলো মূল। ইসলাম এসেছেই মাকাসিদে শরিয়াহ বাস্তবায়নের জন্য। সুতরাং মাকাসিদে শরিয়াহর আলোকে সালাফদের সিদ্ধান্তগুলো আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং উম্মাহর কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে আমাদেরকে বর্তমান যুগের সাথে মানানসই ফিকহ আবিষ্কার করতে হবে।
নিরসন :

ইসলামি শরিয়াহর উসুলের দুটি দিক আছে। একটি মৌলিক দিক, অপরটি ইজতিহাদি দিক। মৌলিক উসুলগুলো হলো—কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মাহর ইজমা। আর ইজতিহাদি দিক হলো—কিয়াস, মাকাসিদে শরিয়াহ, মাসলাহাত ইত্যাদি। যে বিধানগুলো মৌলিক উসুল দ্বারা প্রমাণিত হয়ে আছে, সেখানে ইজতিহাদি মূলনীতি দিয়ে কোনো প্রকার পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন করা যাবে না।

এর থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মাকাসিদে শরিয়াহ কোথায় কার্যকর হবে।
কালের আবর্তনে যখন নতুন কোনো বিষয় আমাদের সামনে আসে এবং কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার কোনো বক্তব্য পাওয়া না যায়, তখন নতুন আপতিত বিষয়ের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য কিয়াস ও মাকাসিদের আলোকে গবেষণা করতে হয়। এটা হলো মাকাসিদে শরিয়াহর কর্মসীমা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আধুনিক কিছু স্কলার ও মুসলিম মাকাসিদে শরিয়াহর দোহাই দিয়ে ইসলামি শরিয়াহর মানসুস (নস দ্বারা প্রমাণিত), মুসতামবাত (উম্মাহর মুজতাহিদে কেরামের গবেষণা দ্বারা উন্মোচিত) ও স্বীকৃত অনেক মাসায়েলে পরিবর্তন সাধন করছে।

শরিয়াতের মাকাসিদ হলো উবুদিয়্যাত, তথা আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের মাধ্যমে তাঁর ইবাদত করা। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাতে নিয়োজিত থাকে, সে মাকাসিদে শরিয়াহ পুরোপুরি অর্জন করতে সক্ষম। উবুদিয়্যাত ব্যতীত কেবলই মাসলাহাত মাকাসিদের শরিয়াহর উদ্দেশ্য নয়। তথাপি আলেমগণ জাগতিক দিক থেকে ইসলামি শরিয়াহর মৌলিক পাঁচটি মাকসাদ বর্ণনা করেছেন—

১. দীনের সংরক্ষণ

২. জীবনের নিরাপত্তা

৩. মানসম্মানের হেফাজত

৪. বিবেক-বুদ্ধির সুরক্ষা

৫. সহায় সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ

ইসলামি শরিয়াহর প্রতিটি বিধানের পেছনে এই মাকসাদগুলো সংরক্ষিত হয়। যদি শরিয়াহর বিধানগুলো বাস্তবায়িত হয়, তবে মৌলিকভাবে এই মাকসাদগুলোও পাওয়া যাবে। আর যদি শরিয়াহর বিধান বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে এই মাকসাদগুলোও পাওয়া যাবে না। এটাই হলো মাকাসিদের পেছনে প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি।

কিন্তু আমাদের আধুনিকমনা ভাইয়েরা শরিয়াহর মানসুস ও স্বীকৃত বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে মাকসাদগুলো সামনে রেখে ইসলামি শরিয়াহর স্বীকৃত বিধান পরিবর্তন করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। আল্লামা তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহর ভাষায় তাদের যুক্তি হলো, ‘নসগুলো মূলত এ সকল মাকাসিদ অর্জনের জন্যেই এসেছে। ফলে যখন আহকামসমূহের আপাত ফলাফল মাকাসিদের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হবে, তখন আমরা বাহ্যিক নসের ওপর আমল না করে উল্লিখিত মাকসাদগুলো অর্জনের চেষ্টা করব।’ এ ধরনের যুক্তি-কাঠামো মূলত পুরো শরিয়াতকেই নাকচ করে দেয় এবং অনুমাননির্ভর ও আপেক্ষিক মাকাসিদের ভিত্তিতে আবদিয়্যাতের রশ্মিকেই নিভিয়ে দেয়।

সত্য কথা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য দীনের যেসব বিধিবিধান দান করেছেন, তা কোনো না কোনো উপকারী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই দিয়েছেন। তিনি কোনো ক্ষতিকর বা উপকারহীন অপ্রয়োজনীয় বিধান আমাদের দেননি। কিন্তু মাকাসিদ ও মাসালিহ কথাগুলো খুবই আপেক্ষিক। একজন মানুষ যেটাকে মাসলাহাত (কল্যাণকর) মনে করছে, অন্যজন সেটাকে নিজের জন্য মাসলাহাত ও মাকসাদ নাও মনে করতে পারে। এজন্য ওহির সূত্র ছাড়া মানবীয় আকল এমন কোনো সার্বজনীন মানদণ্ডে পৌঁছতে পারবে না, যেটা দিয়ে মাকাসিদ ও মাসালিহ চিহ্নিত করা যাবে।

তা ছাড়া শরিয়াহর মাধ্যমে চিহ্নিত মাকসাদগুলোও চিরন্তন ও শাশ্বত না। এগুলোর কিছু নির্দিষ্ট সীমা ও নীতিমালা আছে। উদাহরণস্বরূপ প্রাণ রক্ষার কথাই ধরা যাক। নিশ্চয় এটা শরিয়াহর গুরুত্বপূর্ণ মাকাসিদের অংশ। কিন্তু একজন খুনি জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে মাকাসিদের কথা বলে তার জীবন ভিক্ষা পাবে না। এ কথা সকল মাকাসিদে শরিয়াহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখন মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, এ সকল মাকাসিদ নির্ধারণ কে করবে? এবং সে অনুযায়ী প্রায়োগিক শর্ত ও সীমাগুলো কে নির্ধারণ করবে?

আমরা যদি এই নির্ধারণ-ক্ষমতাকে কেবল মানবীয় আকলের ওপর ন্যস্ত করে দিই, তাহলে বড় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। শরিয়াত অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছে, যা কেবল যৌক্তিকতা দিয়ে বোঝা সম্ভব না। যদি মানবীয় প্রজ্ঞা এ সকল বিষয় সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হতো, তাহলে রাসুল ও ওহি প্রেরণের কোনো দরকার ছিল না। সত্য হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহকে এড়িয়ে এ সকল মাকাসিদ নির্ধারণের কোনো উপায় নেই। তাই কোনোভাবেই এসব আপেক্ষিক ও দ্ব্যর্থবোধক মাকাসিদকে আমরা কোনো পরিচ্ছন্ন আহকামের ওপর প্রাধান্য দিতে পারি না, চাই সেই আহকাম কুরআন থেকে আহরিত হোক অথবা সুন্নাহ থেকে। আমাদের এই অধিকার নেই যে, আমরা এ সকল মাকাসিদ ও মাসালিহকে শরিয়াহর মৌলিক উৎস হিসেবে গ্রহণ করব এবং এগুলোর ভিত্তিতে শরিয়াহর নুসুসকে ছুঁড়ে ফেলব।
মাকাসিদে শরিয়াহর ওপর আলোচনা ও পর্যালোনাকারী কিছু মহলের দৃশ্য হলো এমন যে, তারা যেকোনো প্রকার মুনাসাবাতের কারণেই কোনো বিষয়কে মাকাসিদ সাব্যস্ত করে বসে এবং এর বিপরীত প্রমানিত শত মাসআলা ও বিধানে সংস্কারের শোরগোল শুরু করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কুরআন-সুন্নাহতে কোনো বিষয়ের হুকুম দেওয়া হয়েছে, কিংবা কোনো বিষয় থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আর উক্ত বিষয়ে ঘটনাক্রমে কোনো বাহ্যিক কল্যাণকর অথবা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এখন উক্ত কল্যাণকে অর্জন কিংবা উক্ত ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকাকে মাকসাদ বানিয়ে এর ভিত্তিতে সমাধান ও সংস্কারের কাজ শুরু করে দেওয়া হচ্ছে।
সাধারণত দেখা যায়, মাকাসিদে শরিয়াহর নামে এখানে কেবল গাইরে মানসুস (সুস্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত নয়) মাসায়েলেই বিধান জারি করা হচ্ছে না; বরং মানসুস (সুস্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত) মাসায়েলকেও বলির পাঠা বানানো হচ্ছে। যেখানেই কোনো মাসআলা উক্ত ধারণাকৃত মাকসাদের বিপরীত মনে হচ্ছে, সেখানেই পরিবর্তন বা সংস্কারের আওয়াজ তোলা হচ্ছে। চাই সেই মাসআলা মানসুস অথবা মুত্তাফাক আলাইহি (সর্বসম্মত) হোক না কেন?

উদাহরণস্বরূপ, শান্তি, নিরাপত্তা সংক্রান্ত নুসুসগুলো দেখে ধরে নেওয়া হলো—শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবতার মাঝে স্বাধীনতা ও সমতা বজায় রাখা মাকসাদে শরিয়াহ। এখন মুরতাদ হত্যার বিধান, জিহাদের বিধান, জিম্মির বিধান, কাফেরদের সাথে আন্তরিক ভালোবাসা ও সম্পর্কের নিষেধাজ্ঞা, পুরুষের তুলনায় মহিলাদের সাক্ষী, দিয়্যাত ও মিরাসের অংশ কম হওয়া ইত্যাদি মাসআলা যেহেতু উক্ত ধারণাপ্রসূত মাকসাদের মানদণ্ডে পরিপূর্ণ উত্তীর্ণ হয় না, এজন্য এখন উক্ত মাকসাদের সীমা নির্ধারণ ও তাতে পুনর্বিবেচনা না করার পরিবর্তে মানসুস মাসায়েলকেই পরিবর্তন করতে শুরু করে। এর জন্য তাবিল ও তাহরিফের নতুন নতুন এমন পন্থা বের করা হয়, যেন কোনোভাবেই এই মাসআলা ধারণাপ্রসূত মাকসাদের বিরুদ্ধে না যায়।

অথচ মাকাসিদের ইমামদের উসুল হলো, মাকাসিদের ভিত্তিতে উসুল তো দূরের বিষয়, কোনো শাখাগত বিধানকেও বাতিল বা পরিবর্তন করা যাবে না; বরং তা আলাদা মূলনীতির আলোকে নিয়ে আসতে হবে। ইমাম শাতেবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি শরিয়াতের মৌলিক বিষয় উপেক্ষা করে শাখাগত বিষয় গ্রহণ করবে, সে যেমন ভুল কাজ করবে; তেমনিভাবে যে ব্যক্তি শাখাগত বিষয় বর্জন করে কেবলই মৌলিক বিষয়গুলো আমলে নেবে, সেও ভুল কাজ করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ অনুসন্ধানের পর যখন কোনো একটি সাধারণ মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, অতঃপর শরিয়াতের অন্য কোনো নসের বিধান কোনোভাবে সে মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তখন উভয়টির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা আবশ্যক। কারণ শরিয়াহ প্রবর্তক সাধারণ মূলনীতিসমূহের প্রতি সচেতন থেকেই শাখাগত এই বিধান প্রদান করেছেন।’

শুধু তাই নয়, যদি সাধারণ মূলনীতি আর শাখাগত বিধানে সমন্বয় সাধন সম্ভব না হয়, তাহলে শাখাগত বিধানকে বাতিলকে করা যাবে না; বরং তখন সেই শাখাগত বিধানই স্বতন্ত্র মূলনীতির স্থান লাভ করবে।

যেমন আধুনিক কিছু স্কলার মুরতাদের হদকে অস্বীকার করেন এই যুক্তিতে যে, এই বিধান শাখাগত একটি বিধান। যা শরিয়াহর মৌলিক মাকাসিদ তথা রহমত, কারও ওপর দীনের ব্যাপারে জোরাজুরি করা যাবে না—এ ধরনের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে। সুতরাং মাকাসিদের আলোকে এই বিধান প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এমনিভাবে কেউ কেউ সদাচারকে শরিয়াহর একটি মাকসাদ বানিয়ে অমুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছাপ্রদান হারাম হওয়ার ইজমাকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। একই যুক্তি জিযিয়ার ক্ষেত্রেও দেখানো হচ্ছে। অথচ এই বিধানগুলো শরিয়াহর পৃথক নস ও মূলনীতি দ্বারা প্রমাণিত। আর নিয়ম হলো, প্রমাণিত কোনো বিধানকে মাকাসিদের দোহাই দিয়ে পরিবর্তন করা যাবে না।
মূলত মাসালিহ ও মাকাসিদ কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহ থেকেই আহরিত হবে। তাই আল্লাহ এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেটিকে কল্যাণ বলেছেন, সেটিই একমাত্র কল্যাণ হিসেবে বিবেচিত হবে। নিজেদের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির খাহেশ অনুযায়ী কল্যাণ নির্ধারিত হবে না। মাকাসিদুশ শরিয়াহ বিষয়ক সকল আলেম, যেমন ইমাম শাতেবি, ইমাম গাজালি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ সকলেই একমত যে, কোনো হুকুম নির্ভর করে তার নিজস্ব ইল্লতের (কারণের) ওপর, নিছক হিকমত বা প্রজ্ঞার ওপর নয়। তারা এ ব্যাপারেও একমত যে, যেসব মাকাসিদ নুসুসের সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলো কুরআনিক পরিভাষায় কেবল খাহেশাত ছাড়া আর কিছুই না।

মাকাসিদ বর্ণনাকারীদের অগ্রদূত আল্লামা শাতেবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘শরিয়াহ এসেছে মানুষকে তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রকৃত গোলামে পরিণত করার জন্য। এই মূলনীতি যখন প্রতিষ্ঠিত তখন এ কথা বলা যায় না— শরিয়াহ সর্বদা মানুষের খাহেশাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবেই বিধানগুলি তাদের জন্য উপকারী হবে। আল্লাহ পাক সত্যিই বলেছেন, ‘যদি হক তাদের খাহেশাতের অনুসরণ করত, তাহলে আকাশ ও পৃথিবী এবং তার মাঝে যা আছে সবকিছুতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে মাকাসিদ শরিয়াহর সাধারণ কোনো মূলনীতি বা কোনো বিধানকে আঘাত করে, সেটা প্রকৃতপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো মাকাসিদের পর্যায়ে পড়ে না।’
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ পাক যে বিধান দিয়েছেন, সেটা উপেক্ষা করে যদি কোনো ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশিমতো কোনো কিছুকে ন্যায় ও সঠিক মনে করে এবং সে অনুযায়ী মানুষের মাঝে ফায়সালা করাকে বৈধ বলে বিশ্বাস করে, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।’

অনেক আলেমই শরিয়াহর বিধানসমূহের উপকারিতা (মাসালিহ) এবং তার উদ্দেশ্য (মাকাসিদ) নিয়ে কিতাব রচনা করেছেন। তাদের এসব আলোচনার উদ্দেশ্য কখনো এটি ছিল না যে, শরিয়াহর বিধানগুলো কেবল এসব উপকারিতা ও উদ্দেশ্যের মাঝে সীমাবদ্ধ, কিংবা এসব উপকারিতা অর্জন হওয়াই শরিয়াতের মূল লক্ষ্য, শরয়ি নসের কোনো ধর্তব্য নেই। প্রকৃতপক্ষে তাদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল এ কথা বোঝানো যে, শরিয়াহর এমন কোনো বিধান নেই, যা দীন অথবা দুনিয়ার উপকারিতা থেকে শূন্য। পাশাপাশি যেসকল ক্ষেত্রে শরয়ি নস (ট্যাক্সট) অনুপস্থিত ও যেসকল বিষয় মুবাহ পর্যায়ের, সে ক্ষেত্রে এ সকল মাসালিহ (কল্যাণ) ও মাকাসিদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টি রাখা। তবে কোন বিষয়টা মাসলাহাত, তা নির্ণয় করবে একমাত্র শরিয়াহ ও তার নসসমূহ। কোনো মানুষের অধিকার নেই যে, সে নিজের যৌক্তিকতাবোধ ও খেয়ালখুশির ভিত্তিতে মাসলাহাত নির্ধারণ করবে। কারণ এসব মাকাসিদ (যেমন জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষার মূলনীতি) চূড়ান্ত না বা সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না; বরং মূল কথা হলো ইমাম শাতেবি রহিমাহুল্লাহ যা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘উপকার ও ক্ষতি চিরন্তন না; বরং আপেক্ষিক। এ ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতার অর্থ হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন স্থান-কাল-পাত্রের জন্য উপকার ও ক্ষতি ভিন্ন ভিন্ন।’

শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যেভাবে কোনো সুন্নাহর ওপর ইজমা হয়ে গেলে তাঁর ওপর আমল ওয়াজিব হয়ে যায়, ঠিক সেভাবে কোনো বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ জারি করে এমন ওহিই সেই আদেশ-নিষেধের ওপর আনুগত্য বাধ্যতামূলক হওয়ার জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে যায়। এর ভিত্তিতেই (আল্লাহর) অনুগতদের পুরস্কৃত করা হবে, অবাধ্যদের লাঞ্ছিত করা হবে। সুন্নাহ এটিও আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করে যে, যখন কোনো হুকুম নুসুসের দ্বারা প্রমাণিত হয় এবং বর্ণনার সনদও বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়ে যায়, তখন আমলের ক্ষেত্রে এ সকল মাকাসিদের ওপর নির্ভর করা আমাদের জন্য আর বৈধ থাকে না।’
আল্লামা শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি রহিমাহুল্লাহ তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ-তে শরয়ি আহকামের যেসব ব্যাখ্যা ও কল্যাণের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোও সর্বোচ্চ রহস্য ও হিকমত হিসেবে এনেছেন। যার ওপরে কখনো শরয়ি হুকুমের ভিত্তি রাখা যায় না। ফলে তাঁর সমকালীন আলেমরা এবং তাঁর পরবর্তী মুসতানিদ আহলে ইলমগণও এই কিতাবকে সর্বদা উক্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। এমনকি তার নিকটস্থ সন্তান, নাতি, প্রিয়জন ও ছাত্রদের কর্মপদ্ধতি এমনই ছিল। তাদের কাছে শরয়ি আহকামের মাকাসিদ ও নানাবিধ কল্যাণের ভাণ্ডার ছিল। কিন্তু আমল, ফতোয়া ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা সর্বদা উসুলবিদ ও ফুকাহায়ে কেরামের মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেছেন এবং মাকাসিদে শরিয়াহর নামে মানসুস ও মুত্তাফাক আলাইহি মাসআলায় কখনো সংস্কার ও পরিবর্তনের দুঃসাহস দেখাননি। বিশেষত শাহ ওয়ালি উল্লাহর সুযোগ্য সন্তান সিরাজুল হিন্দ শাহ আবদুল আজিজ রহিমাহুল্লাহ, যাঁকে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য গুণাবলি আর বিশেষত্ব দিয়ে ধন্য করেছেন, তাঁর কর্মপদ্ধতিও অনুরূপ ছিল। তাঁর ফতোয়া ও লেখাসমূহ থেকে খুব সহজেই বিষয়টি বোঝা যায়।

সুতরাং মাকাসিদে শরিয়াহর আলোকে কখনোই শরিয়াহর মানসুস, ফকিহদের মুসতামবাত ও স্বীকৃত বিধানকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা ছুড়ে ফেলা যায় না। মাসলাহাতের দোহাই দিয়ে আমাদের সালাফদের ফিকহের ভাণ্ডারকে পশ্চিমা সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত সমাজের সাথে মিলানোর জন্য কাটছাট করা শরিয়াহকে বিকৃত করার নামান্তর।
ইসলামি শরিয়াহর মাকাসিদ ও কল্যাণের ব্যাপারে সালাফদের চেয়ে বেশি কেউ অবগত ছিলেন না। যখন কেউ মাকাসিদ ও মাসালিহের দোহাই দিয়ে সালাফদের ফিকহি সিদ্ধান্তকে ছুড়ে ফেলে, কিংবা শরিয়াহর উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে, তখন সে মূলত সালাফদের ওপর অজ্ঞতার অপবাদ দিচ্ছে; যা থেকে তারা মুক্ত।
সালাফদের বক্তব্যসমূহ মাকাসিদে শরিয়াহকে যথার্থভাবে অনুসরণ করার মাধ্যম। কারণ ইসলামি শরিয়াহ সম্পর্কে তারাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং শরিয়াহর বিধানসমূহের ব্যাপারে তারাই ছিলেন গভীর বুঝের অধিকারী। নিঃসন্দেহে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়িদের মতো সালাফে সালেহিনরাই কুরআন, তার ইলম ও তার ভেতর গচ্ছিত রহস্যের ব্যাপারে অধিক জ্ঞানী ছিলেন।

তথ্যসূত্রঃ
১। উসুলুল ইফতা, পৃষ্ঠা ২৪৫-২৪৮
২। মুফতি উবায়দুর রহমান পাকিস্তানিকৃত "মাকাসিদে শরিয়ত কি আহমিয়্যাত আওর উসকে হুদুদ ওয়া জাওয়াবেত" নামক উর্দু মাকালা।
৩। আল মুওয়াফাকাত লিল ইমাম আশ শাতেবি রহিমাহুল্লাহ
৪। মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাওইয়্যাহ লি ইবনি তাইমিয়া
৫। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা ৩২-৩৩
৬। আত তাসলিম লিন নাসসিশ শরইয়্যি, ফাহাদ বিন সালিহ আল আজলান।
বইঃ ফাহমুস সালাফ: দ্বীন বোঝার কষ্টিপাথর, পৃষ্ঠা ১২৪-১৩২

পঠিত : ৪৩২ বার

মন্তব্য: ০