Alapon

টুকু কার?



ইকবাল হোসেন মাহমুদ টুকু অনেকটা আকস্মিকভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের সর্বোচ্চ সাংগঠনিক স্তর, স্ট্যান্ডিং কমিটিতে প্রমোশন পেলে রাজনীতির খবরাখবর রাখেন এমন সকলেই অবাক হয়েছিলেন। টুকুর পিতা পাকিস্তানি আমলে মুসলিম লীগের মন্ত্রি থাকলেও টুকুকে সবাই শেখ কামালের বন্ধু হিসেবেই চিনতো। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বরের গভীর রাতে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে শেখ কামাল এবং তার বন্ধুরা এক রহস্যময় পরিস্থিতিতে টহল পুলিশের গুলির মুখে পড়েছিলেন। গোলাগুলিতে শেখ কামাল গুরুতর আহত হলেও তখনকার মত প্রাণে বেঁচে যান। অত রাতে সশস্ত্র অবস্থায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাংলাদেশের অতীব ক্ষমতাবান এবং প্রচন্ড বিতর্কিত তৎকালিন রাজপুত্র মতিঝিলে কি করছিলেন এ নিয়ে ব্যাংক ডাকাতি থেকে শুরু করে সিরাজ শিকদার গ্রুপকে ধাওয়ার মত নানা রকম কাহিনি প্রচলিত আছে। শেখ কামালের সে রাতের অভিযানের বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন আজকের বিএনপি’র অন্যতম শীর্ষ নেতা ইকবাল হাসান টুকু। স্বয়ং শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে তার ভাইকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য একাধিকবার এই টুকুকে সাক্ষী মেনেছেন। দুদিন আগেও মার্কিন প্রবাসী কনক সারওয়ারের ইউ টিউব চ্যানেলের অনুষ্ঠানে ড: তাজ হাশমী বলেছেন যে, সিঙ্গাপুরে তার সঙ্গে আলাপচারিতায় টুকুর সাথে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা নিজ মুখে জানিয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। মুজিব কন্যারা নাকি টুকুকে স্নেহ করে ভাসানী নামে ডেকে থাকেন। টুকুকে কেন ভাসানী নামে ডাকা হয় তা আমার জানা নাই। ড: তাজ হাশমীও টক শো’তে এই নামের কোন ব্যাখ্যা দেন নাই।

এতো গেল পুরনো বন্ধুত্বের সম্পর্কের ইতিহাস। এ ছাড়াও শেখ পরিবারের সাথে টুকুর অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাও রয়েছে। শেখ হাসিনার আপন মামাত ভাই এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিমের পুত্র শেখ ফজলে নাইমের সাথে বিয়ে হয়েছে টুকুর একমাত্র মেয়ে সারাহ হাসান মাহমুদের। এ ছাড়া টুকুর নিজের শ্বশুরের পরিবার সম্পর্কেও বিশেষ আওয়ামী ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা যায়। আমার এক লন্ডন প্রবাসী বন্ধু এ সম্পর্কে আমাকে নিশ্চিত করেছেন। অর্থাৎ টুকু বি এন পি’র সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকদের একজন হলেও তার ঘরের ভেতরের সবখানি আওয়ামী লীগের দখলে। আরও একটি বিষয় খোলাসা হওয়া আবশ্যক। আওয়ামী ঘনিষ্ঠতা থেকে টুকু কিন্তু, সরাসরি বিএনপির রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন নাই। ড: তাজ হাশমী প্রদত্ত তথ্য অনুসারে ইকবাল হাসান মাহমুদ এরশাদের জাতীয় পার্টি ঘুরে তবেই জাতীয়তাবাদি দলে পদার্পন করেছেন। তবে যেভাবেই তিনি জাতীয়তাবাদি দলে আসুন না কেন তার উত্থান বিস্ময়কর। এবার প্রসঙ্গক্রমে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদে আমি সেই সরকারে একেবারেই স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম। জাতীয়তাবাদি প্রকৌশলীদের সংগঠনের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত থাকার কারণে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান উভয়ই আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও পেশাজীবী জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেন। সেই একই মেয়াদে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রি কর্তৃক অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রির দায়িত্বে ছিলেন। আমরা তখন টুকুকে বিএনপির ভারতপন্থী গ্রুপের সদস্য হিসেবেই জানতাম। বেগম খালেদা জিয়া যে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রির কর্মকান্ডে খুব একটা প্রীত ছিলেন এমনটা সরকারে থাকাকালে আমার কাছে কখনও মনে হয় নাই। আওয়ামী লিগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রি ফারুক খানের পরিবারের মালিকানাধীন সামিট গ্রুপের এক ভারতীয় কোম্পানীর সাথে যৌথ বিনিয়োগে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে প্রতিমন্ত্রি টুকু অতি উৎসাহ দেখালে বেগম খালেদা জিয়া তার ওপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছিলেন। সেই একই সামিট গ্রুপ শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের চৌদ্দ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সেক্টরকে পথে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করে সেই দেশের অন্যতম ধনী পরিবারে পরিণত হয়েছে। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, শেখ পরিবারের সাথে পারিবারিক সম্পর্কের পাশাপাশি সম্ভবত: ইকবাল হাসান মাহমুদের আওয়ামী লীগ ও ভারতের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কও রয়েছে। এমন একজন রহস্যময় রাজনীতিবিদকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের ডিঙিয়ে একেবারে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে প্রমোশন দিলে অবাক হওয়ারই কথা। হয়ত তিনি দলের জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন যা আমাদের অজানা। তবে, বর্তমান ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট জামানায় অতি ভাগ্যবান টুকুকে যে কোনরকম হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে না সেটা দেশের জনগণ দেখতে পাচ্ছেন। বাংলাদেশে টুকুর মত এমন সৌভাগ্যবান প্রায় নাই বললেই চলে যে কিনা একাধারে শেখ পরিবার এবং জিয়া পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক রেখে প্রবল প্রতাপে রাজনীতি করতে পারে।

উপরোক্ত টুকু কয়েকদিন আগে ঢাকায় বিএনপির এক জনসভায় জামাতে ইসলামী সম্পর্কে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিতর্কিত মন্তব্য করে চলমান ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নতুন এক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শেখ হাসিনা সম্প্রতি বেশ বিপাকে পড়েছেন। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিও প্রচন্ড চাপের মুখে রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরেও জনগণ বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে ক্রমেই আন্দোলনমুখি হচ্ছে। চারদিক থেকে দাবী উঠছে যে, সকল বিরোধী দল যেন যুগপৎভাবে হাসিনার পতনের এক দফা দাবী নিয়ে রাজপথে নামে। বিএনপির মহাসচিবও বিভিন্ন বক্তৃতা এবং পত্রিকার সাক্ষাৎকারে দ্রুতই যুগপৎ আন্দোলন শুরু করার কথা বলছেন। রাজনীতির এমন সংবেদনশীল সময়ে টুকুর বিতর্কিত বক্তব্যকে কেবল রাজনৈতিক মূর্খতা ভাবার কোন সুযোগ নাই। এটা নয়া দিল্লির ‘হাসিনা রক্ষা’ প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অংশও হতে পারে। এই মুহূর্তে ডান-বাম নির্বিশেষে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল সরকারের পতনের এক দফা দাবীতে যুগপৎ আন্দোলনে নামলে জনসমর্থনহীন শেখ হাসিনার পক্ষে পুলিশ দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য হবে বলেই আমি মনে করি। কাজেই তিনি যে কোন মূল্যে সেই সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে চাইবেন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করতে বসলে তার বিভিন্ন দিক উম্মোচিত হবে। টুকু তার বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ এবং জামাতে ইসলামীর গোপন সম্পর্কের দাবী করেছেন। অপরদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন তত্ত্বও আলোচিত হচ্ছে যে, বিএনপির ভারতপন্থী অংশ শেখ হাসিনার অধীনেই ২০১৮ সালের মত নির্বাচনী তামাশায় অংশগ্রহণে আগ্রহী। এবার নাকি তাদেরকে বেশি আসন দেয়ার টোপ দেওয়াও হয়ে গেছে। আসন ভাগাভাগিতে প্রয়োজনে দিল্লির মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সম্মত হওয়ার গুজবও শোনা যায়। টুকু সেই প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত থাকতেও পারেন। সত্য যাই হোক না কেন, তার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য নি:সন্দেহে বিরোধী দলের ঐক্য প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। আমরা আশা করি, ঢাকা এবং লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব টুকুর বক্তব্য খন্ডন করে কোন সময়ক্ষেপন ব্যতিরেকে হাসিনা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে সকল স্বাধীনতাকামী বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করবার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। আর যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব একলা চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন সে ক্ষেত্রে টুকু হয়ত ঢাকার বক্তৃতায় দলের অবস্থানই ব্যক্ত করেছেন মাত্র।

-মাহমুদুর রহমান
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ

পঠিত : ১৬৩৪ বার

মন্তব্য: ০