Alapon

মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকারের সমন্বিত এক গল্প!



আমার দাদা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন, স্থান দিতেন। আমাদের গ্রামে আমার দাদার নাম বললে এক নামে মানুষ তাঁকে চিনে। আমি আমার দাদার নাতি হিসেবে আমার দেহে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার রক্ত প্রবাহিত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অতিরঞ্জন ও অতি রাজনীতি আমাকে এর প্রতি বিরূপ আর সংশয়ী করে তোলে।

আমার ভেতর প্রথম প্রশ্ন তৈরি হয় কথিত ত্রিশ লাখ শহীদের বানোয়াট বক্তব্যটি। আমি আমার গ্রাম আশপাশের গ্রামে খোঁজ নিয়েও দু'চারটা মুক্তিযুদ্ধের নিহত হওয়ার খবর পাই না। বরঞ্চ কোনো ক্ষেত্রে উল্টোটা দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক রাজাকার নিহত , যারা দেশের অখন্ডতার পক্ষে ছিলো, তারাই বরং বিচ্ছিন্নতাবাদিদের হাতে অনেক জায়গায় অনেক গ্রামে শহীদ হয়।


আমার আব্বা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোটো ছিলেন। তবে খুব বেশি ছোটো না। অনেক কিছু মনে আছে তাঁর। কিন্তু ভালো খারাপ কিছুই তাঁর মুখে তেমন একটা শুনিনি। কিন্তু আমার আম্মা রাজাকার কাকে বলে, মুক্তিযুদ্ধ কাকে বলে এর কিছুই জানেন না। তো সে হিসেবে বাপ মায়ের কাছে সেগুলোর উত্তর-তথ্য কিছুই পাইনি।

হুট করেই একদিন আব্বা একটা বিষয় বলে বসেন, সেটা হচ্ছে সেদিন, যেদিন সম্ভবত শাপলা চত্বরে হেফাজতের কর্মীদের খুন করে কিংবা আল্লামা সাঈদীর ফাঁসির আদেশ দেয়, সেদিন। মুক্তিযোদ্ধারা যে অনেক নিরিহ মানুষ খুন করেছেন সেটার ব্যাপারে আব্বার কথা শুনে সেদিন বিষয়টা আরো ভালো করে টের পাই।

আব্বা সেদিন কান্না কান্না চোখে বলছেন তাদের একজন উস্তাদ ছিলো। মাদ্রাসার মুহতামিম। আসরের নামাজের অজু করতেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের পোলাপান আর মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকরা এসে তাঁকে অজু অবস্থায় খুন করে। আব্বা বলেছেন গুলিতে ওই আলিমে দ্বীন উস্তাদ সাথে সাথে শাহাদাত বরণ করেন।

দাদার কাছে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের গল্প শুনলেও নানার কাছে কখনো শুনিনি। তিনি অনেক হাস্যরস মজাদার গল্প বললেও কৌতূহলী হয়ে কখনো তাঁর কাছে কিছু জিগ্যেস করা বা জানতে চাওয়ার সাহস হতো না। কারণ তাঁর আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব ছিলো। তাঁকে ভয়ও পেতাম। তাই অনেক কৌতূহল থাকলেও তাঁকে কখনো জিজ্ঞেস করিনি কিছু।

কিন্তু একদিন নানুর কাছে মুক্তিযুদ্ধের গপ্পো শোনবার আবদার করি। নানু যা জানালেন, তাতে ভীষণ আঁতকে উঠি আমি। আমি যেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভক্ত বা শ্রদ্ধাশীল দাদার কাছ থেকে পেয়ে হলাম, এখানে হুট করে একটা ছেঁদ ঘটলো।

কাহিনীটা হচ্ছে নানুর একজন বোনের ছেলে, মানে ভাগিনা। আমার মা-খালা-মামাদের খালাতো ভাই। দেখতে ভীষণ হ্যান্ডসাম আর সু-পুরুষ একজন মানুষ তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও পরহেজগার আর ভালো মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা এই মানুষটিকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে ঝুলিয়ে শহীদ করে ফেলে। মুখের ভেতর লুঙি-গামছা গুজে দিয়ে মেরে ফেলে রাতে। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারাই ওনাকে খুন করে। কতো অনুনয় বিনয় তাদের কাছে করা হয়েছে, তবুও তারা তাঁকে খুন করে।

শুধু খুন করেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ঘরের দামি দামি আসবাবপত্র সব লুটপাট করে নিয়ে যায়। আমার সেই নানু (নানুর বোন) সব স্বর্ণ-গয়না জিনিসপত্র সবকিছুর বিনিময়েও কান্না করে করে তাঁর ছেলের জান ভিক্ষা চাইছেন, বলছেন সব নিয়ে গেছো নিয়ে যাও, তবুও আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। কিন্তু তাঁদের দিলে দয়া হয়নি । তাঁরা এই নিরিহ মানুষটাকে খুন করে। উনি একজন আলিমও ছিলেন। এভাবে সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় বা মুক্তিযুদ্ধের পরে অজস্র সাধারণ আর নিরিহ মানুষকে নির্বিচারে মুক্তিযোদ্ধারাও খুন করেছে। যে গল্পগুলো অজানা। রয়ে গেছে আড়ালে। অন্ধাকারে। আর সেই অন্ধকার আজো আমাদেরকে গিলে গিলে খাচ্ছে

পঠিত : ৫৩২ বার

মন্তব্য: ০