Alapon

আইয়ুব আলাইহিস সালামের ধৈর্য এবং কিছু কথা...




আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া কুরআনে উল্লেখ করেন- نَحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡکَ اَحۡسَنَ الۡقَصَصِ - "আমি তোমার কাছে সর্বোত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি...।" (১২:৩) তাই, কুরআনের প্রতিটি কাহিনী প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ, নৈতিক শিক্ষায় পরিপূর্ণ এবং উপদেশে পরিপূর্ণ। আজকের সংক্ষিপ্ত খুৎবায় আমি আমাদের সবাইকে কুরআনের এমন একটি কাহিনী স্মরণ করিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছি। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যে ঘটনা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আমাদেরকে চিন্তা করতে বলেছেন।

আর সে ঘটনাটি হলো আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যখন বলেছেন- وَ اذۡکُرۡ عَبۡدَنَاۤ اَیُّوۡبَ - “স্মরণ কর আমার বান্দা আইয়ূবের কথা” (৩৮:৪১) আমার বান্দা আইয়ুবের ঘটনা মনে করো এবং চিন্তা করো। আল্লাহ্‌ আজ্জা ওয়া জাল্লা আইয়ুব (আ) কে 'নি'মাল আবদ' হিসেবে অভিহিত করেছেন। "সে কতই না উত্তম বান্দা!" ইন্নাহু আওয়াব। তিনি বার বার আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অভিমুখী হতেন।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার ঘটনা উল্লেখ করলেন। এরপর তিনি বললেন- এই ঘটনায় 'জিকরা লি উলিল আলবা-ব'। এই ঘটনায় বুদ্ধিমান মানুষের জন্য প্রজ্ঞা এবং উপকার রয়েছে।

তো, আইয়ুব (আ) এর ঘটনাটা কী? আর আমরা কীভাবে সেই ঘটনা থেকে উপকার আহরণ করবো? নবী আইয়ুব, ইংরেজিতে উনাকে জোব বলা হয়। তিনি ছিলেন ইসহাক (আ) এর বংশধর। তাঁকে এডোমাইট নামক এক দল মানুষের নিকট প্রেরণ করা হয়। এরা ছিল সেমেটিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এদের বাস ছিল আজকের জর্ডানে। তাঁর সম্প্রদায় তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল।

নবুয়ত দেয়ার পাশাপাশি আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁকে অঢেল সম্পত্তি দান করেন। সকল নবীরা সম্পদশালী ছিলেন না। সকল নবীকে এই দুনিয়া প্রদান করা হয়নি। আইয়ুব (আ) কে এই দুনিয়াও প্রদান করা হয়েছিল নবুয়ত দেওয়ার পাশাপাশি। যত ধরণের নেয়ামতের কথা আপনার মাথায় আসতে পারে অর্থ, স্বর্ণ, রৌপ্য, প্রচুর জায়গা-জমি, গবাদি পশু। এই সবকিছুর সাথে তাঁর স্ত্রী ছিলেন ইউসুফ (আ) এর বংশধর। তিনি ছিলেন খুবই ধার্মিক একজন নারী। কারো কারো অভিমতে, তাঁর স্ত্রী তাঁকে ডজন খানেক সন্তান উপহার দেন। তাহলে তাঁর দ্বীন এবং দুনিয়া উভয় ছিল।

শহরের মানুষজন তাঁর দিকে তাকিয়ে বলতো- "আল্লাহ্‌র কি চমৎকার এক বান্দা আপনি!" তিনি ছিলেন একাধারে একজন নবী, একজন ইবাদাতকারি আবার তাঁর রয়েছে অঢেল সম্পদ। আল্লাহর কি চমৎকার এক বান্দা!

কিন্তু, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আইয়ুব (আ) কে পরীক্ষা করতে চাইলেন, তাঁর মর্যাদা আরও উন্নত করতে চাইলেন এবং ইতিহাস জুড়ে এই ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় করে রাখলেন।

অতপর, আইয়ুব (আ) সবধরনের রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হলেন। কেউ বলে কুষ্ঠ রোগ, কেউ বলে চর্ম রোগ— বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলেন। এতে তাঁর চামড়ার রং পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাঁর সমগ্র শরীর গুটি ফোস্কায় ছেয়ে যায়। অবস্থা এমন হয়ে পড়ে যে, তাঁর দিকে তাকাতেও মানুষের কষ্ট হতো। এর সাথে সাথে তাঁর সহায়-সম্পদ এবং জমি-জমার উপরেও বিপদ নেমে আসে। এক রাতের মধ্যে ধ্বংসাত্মক এক রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর সকল গবাদি পশুর মৃত্যু ঘটে। এরপর আগুনে পুড়ে তাঁর সকল ফসল ছাই হয়ে যায়, শূন্য হয়ে যায়। এরপর আল্লাহ্‌ সুবহানাহাহু ওয়া তায়ালা তাঁকে পরীক্ষা করলেন তাঁর সকল সন্তান-সন্ততির মৃত্যু ঘটিয়ে।

সুতরাং, অল্প সময়ের মধ্যে আইয়ুব (আ) সম্পদশালী এবং স্বাস্থ্যবান মানুষ থেকে, দ্বীন দুনিয়া উভয়ের মালিক হওয়া থেকে নিঃস্ব মানুষে পরিণত হলেন। তাঁর দুনিয়া কেড়ে নেওয়া হয়। শুধু দ্বীনটা বাকি থাকলো।

শহরের লোকজন কানাঘুষা করতে লাগলো। কিছু মানুষের অবস্থা এমনি। কানাঘুষা করা ছাড়া এদের খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই। তারা বলতে লাগল- "আইয়ুব কি এক জঘন্য ব্যক্তি! নিশ্চয় তিনি বড় ধরণের কোনো পাপ করেছেন। যার কারণে আল্লাহ্‌ তাঁর সকল সম্পদ এবং ছেলেমেয়ে কেড়ে নিয়েছেন। খুবই খারাপ মানুষ আইয়ুব। অন্যথায় কেন তার উপর এতো বিপদ নেমে আসল।"

ফলে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে পরিত্যাগ করলো, কলিগরা ছেড়ে পালাল। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার পর এখন সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়লেন।

অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে উপনীত হলো যে তাঁর সকল টাকা-পয়সা নিঃশেষ হতে শুরু করলো। তাঁর স্ত্রীকে চাকরানীর কাজ খুঁজতে হলো— বুয়ার কাজ, মানুষের বাড়ি পরিষ্কারের কাজ যেন তিনি আইয়ুব (আ) কে কিছু আহার করাতে পারেন। একদিন তাঁর স্ত্রী ঘরে আসলেন...এ অবস্থায় দিন শেষে মাস গড়িয়ে পড়লো, মাস শেষে বছর।

একদিন তাঁর স্ত্রী কাছে এসে বললেন— "ও আল্লাহ্‌র বান্দা! আপনি হলেন আল্লাহর নবী। আপনি কেন আল্লাহর কাছে দুআ করছেন না যেন এই সমস্যাগুলো দূর হয়ে যায়? আমাদেরকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিন। আপনি শুধু সারাদিন জিকির করছেন। কেন আল্লাহর কাছে দুআ করছেন না?" কারণ, আইয়ুব (আ) সবসময় আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকতেন। আল্লাহ্‌ যেমন বলেছেন, "ইন্নাহু আওয়াব।" সে সবসময় আল্লাহর অভিমুখী হতো। আল্লাহর কাছে ফিরে আসতো। তাঁর জিহ্বা সবসময় বলত— সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ্‌, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার। তাঁর স্ত্রী বললেন— শুধু জিকির না করে আপনার যা প্রয়োজন আল্লাহ্‌র কাছে চান।

এর উত্তরে আইয়ুব বললেন— "ও আল্লাহর দাসী! আমাকে বল, কত বছর আমরা শান্তি, সম্পদ এবং প্রচুর নেয়ামতের মধ্যে কাটিয়েছি? কত বছর যাবত আমরা আশীর্বাদপুষ্ট এবং ভাগ্যবান ছিলাম?" তিনি বললেন, সত্তর বছর।" তাহলে সত্তর বছর যাবত আইয়ুব প্রচুর নেয়ামতের মধ্যে জীবন যাপন করেছিলেন। সুতরাং, আইয়ুব বললেন— "ও আল্লাহর দাসী! সত্তর বছর যাবত তুমি তো একবারও আল্লাহ্‌র আশীর্বাদ নিয়ে কোনো অভিযোগ করনি? আর এখন অল্প কয়েক বছর ধরে আমরা বিপদ এবং পরীক্ষার মধ্যে আছি আর তুমি অভিযোগ করতে চাও? সত্তর বছর ধরে তুমি সুখী ছিলে এবং আল্লাহর কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলে।

এখন যেহেতু আল্লাহ্‌ কয়েক বছরের জন্য আমাদের পরীক্ষা করছেন আমাদের কি সেই সত্তর বছরের জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয়? আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে যে অতি চমৎকার এক জীবন দিয়েছিলেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করো। কেন তুমি এখন অভিযোগ করছ যখন আল্লাহ্‌ আমাদেরকে এতকাল যাবত ভালো রেখেছিলেন। এখন যদিও সমস্যায় আছি। এটা ঠিকাছে, আল্লাহ্‌ আমাদের পরীক্ষা করছেন।

সুতরাং, এভাবে তিনি তাঁর স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিলেন। কিন্তু এ অবস্থার যেন কোনো শেষ নেই। বছরের পর বছর এভাবেই চলতে লাগলো। কেউ কেউ বলেন, হয়তো এভাবে দশ বছর পার হয়ে গেছে। এরপর কিছু একটা ঘটে। হাদিসের বই, সিরাতের বই, তাফসীরের বই কোথাও এর উল্লেখ নেই যে কী ঘটেছে। কিন্তু কিছু একটা ঘটেছিল। আল্লাহ্‌ ভালো জানেন। কিন্তু মনে হয়, সম্ভবত শয়তান (কোনো বেশ ধারণ করে) আইয়ুবের স্ত্রীর নিকট এসে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল। "তুমি যদি আমার জন্য কিছু করো, যদি আমার ইবাদাত করো, যদি আমার প্রশংসা করো তাহলে আমি আইয়ুবকে সুস্থ করে দিবো।" সম্ভবত এরকম কিছু একটা ঘটেছিল। ভুল কিছু একটা। শয়তান আইয়ুব (আ) এর স্ত্রীকে প্ররোচিত করতে চেয়েছিল যে, তুমি যদি আমার ইবাদাত করো তাহলে আমি আইয়ুবকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনব।
তাই, তিনি হয়তো তাঁর স্বামীর কাছে গিয়ে এই প্রস্তাব তুলে ধরেন। " চলেন এটা করি। আমরা এই কাজ করলে হয়তো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবো।" এতে আইয়ুব (আ) তাঁর স্ত্রীর প্রতি রাগান্বিত হয়ে উঠেন। তাঁর নড়াচড়া করার সামর্থ্য ছিল না, বিছানায় পড়ে আছেন। তিনি বললেন— "আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি!" তিনি আল্লাহ্‌র নামে শপথ করলেন। "আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি ও নারী! আমি যদি কোনোদিন সুস্থ হই তবে তোমাকে ১০০ বার বেত্রাঘাত করা হবে। কোন সাহসে তুমি আমাকে শয়তানের কাছে যেতে বল, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদাত করার পর।" তো, তিনি একটি প্রতিজ্ঞা করলেন। কসম করলেন। আর আল্লাহর একজন নবী যদি কোনো কসম করেন এটা ছোটো কোনো ব্যাপার নয়।

------------------- * --------------------
[ টীকা: পরবর্তীতে উনি সুস্থ হওয়ার পর আল্লাহ্‌ তাঁর জন্য এই প্রতিজ্ঞা পালন সহজ করে দেন। আল্লাহ্‌ বলেন— "(আমি তাকে বললাম) কিছু ঘাস লও আর তা দিয়ে আঘাত কর, শপথ ভঙ্গ করো না। আমি তাকে পেয়েছিলাম পূর্ণ ধৈর্যশীল, কতই না উত্তম বান্দাহ, প্রকৃতই (আল্লাহ) অভিমুখী। (৩৮ঃ৪৪)"
একশোটা ঘাস নিয়ে তাকে মৃদু আঘাত করো। আর আমি এটাকে তোমার প্রতিজ্ঞা পূরণ হিসেবে গ্রহণ করে নিবো। এখানে, মূল পয়েন্ট হলো আল্লাহ্‌ আইয়ুবের স্ত্রীকে রক্ষা করলেন। তাঁর জন্য এই শাস্তি শোভা পায় না। তিনি হয়তো একটা ভুল করে ফেলেছেন এবং তিনি এর জন্য দুঃখিত হয়েছেন। তাই, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আইয়ুবকে শিখিয়ে দিলেন কীভাবে এই শপথ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। এখানে শিক্ষা হলো আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সেই স্বামী স্ত্রীদের প্রতি রহম করবেন যারা সুখে দুঃখে সবসময় একসাথে থাকেন। ]
------------------- * --------------------
এভাবে বছরগুলো পার হতে থাকলো। তাদের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে লাগলো। এক পর্যায়ে এসে তাঁর শরীর থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগলো। ফলে, শহরের লোকজন তাঁকে শহর ছাড়া করলো। তাদেরকে শহরের বাইরের একটি তাঁবুতে চলে যেতে হল। কোনো খাদ্য নেই, পানীয় নেই, পরিবার নেই। বিশাল ম্যানশনে বাস করার পর, সকল নেয়ামত ভোগ করার পর এখন তিনি তাঁর নিজ সম্প্রদায় কর্তৃকও পরিত্যক্ত হলেন। তাই, তাঁর স্ত্রী তাঁর জন্য ছোট্ট একটি কুটির তৈরি করলেন। তিনি পরিচারিকার কাজ করে যা পেতেন আইয়ুবকে তা থেকে আহার করাতেন।

এরপর শহরের লোকজন এমনকি তাঁর প্রতি আরও বিরক্ত হয়ে উঠলো। তারা বলতে লাগলো— "আইয়ুব হলো কুলক্ষণ। আমরা তাকে আর আমাদের আশে পাশেও চাই না।" তারা সবকিছুর জন্য আইয়ুবকে দোষ দিতো। যদিও মুসলিম হিসেবে আমরা তো কুলক্ষণে বিশ্বাস করি না। তারা বলল— "আইয়ুব একটা কুলক্ষণ। তাকে আমরা আর কিছুই দিবো না।" তারা এমনিতেই তাকে কিছু দিতো না। তাঁর আয়ের উৎস কী ছিল? তাঁর স্ত্রীর পরিচারিকার কাজ। কিন্তু এখন, শহরের লোকজন একমত হলো যে তারা আইয়ুবের স্ত্রীকে আর কোনো কাজ দিবে না। দিনের পর দিন তিনি কোনো কাজ খুঁজে পেলেন না। জমানো খাবার যা ছিল সব শেষ হয়ে গেলো।

এরপর হঠাৎ করে একদিন তিনি প্রচুর খাদ্য নিয়ে উপস্থিত হলেন। আইয়ুব (আ) তো সবকিছু জানেন যে তিনি কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। একদিন তিনি প্রচুর খাদ্য নিয়ে উপস্থিত হলেন। ফল, সবজি এবং গোশত। আইয়ুব বললেন— "তুমি টাকা পেয়েছ কোথায়?" তিনি বললেন— "চিন্তা করো না। আহার করো।" তো, এই খাবারে তাঁদের কয়েকদিন চলে গেল। এরপর এই খাদ্যও শেষ হয়ে গেল।

আবার কিছু সময় অনাহারে কাটানোর পর হঠাৎ করে একদিন আবার তিনি অনেকগুলো খাবার নিয়ে উপস্থিত হলেন। এবার আইয়ুব বললেন— আল্লাহর শপথ! তোমাকে বলতেই হবে এ খাবার তুমি কোথা থেকে পাচ্ছ? টাকা পেয়েছ কোথায়? আমি জানি তারা তোমাকে কাজ দিচ্ছে না।

ফলে, তিনি তাঁর মাথার হিজাব সরিয়ে ফেললেন। আর তিনি ছিলেন ইউসুফ (আ) এর বংশধর এবং পুণ্যবান একজন নারী। তাঁকে তাঁর চুল কামিয়ে ফেলতে হয়েছিলো। তিনি তাঁর চুলের একটি অংশ বিক্রি করে প্রথমবার খাবার এনেছিলেন এবং দ্বিতীয়বার খাবার এনেছিলেন চুলের অবশিষ্ট অংশ বিক্রি করে। এখন তাঁর মাথায় আর কোনো চুল অবশিষ্ট নেই। তো, তিনি তাঁর নিজের চুল বিক্রি করে স্বামীর সেবা করে গেলেন। তিনি ছিলেন পুণ্যবান এবং ধৈর্যশীল এক নারী। এতোটা বছর ধরে তিনি তাঁর স্বামীকে সেবা দিয়ে গেলেন।

আইয়ুব যখন দেখলেন তাঁর স্ত্রীকে এমনকি তাঁর নিজের চুল পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে, ঠিক সেই সময় আইয়ুব আল্লাহর নিকট দুআ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সুবহানাল্লাহ! একজন পুরুষ তার শরীরে অনেক কিছু নিতে পারে, একজন পুরুষ নিজে নিজে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে পারে। কিন্তু যখন সে দেখে তার পরিবারকে ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে, যখন সে দেখে এটা তার স্ত্রী-সন্তান, তখন ব্যাপারটা মানুষটাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে তিনি নিজের জন্য আল্লাহ্‌র নিকট দুআ করতে অনুপ্রাণিত হলেন। তো, তিনি তাঁর হাত উত্তোলন করলেন। কুরআনে বর্ণিত খুবই বিখ্যাত একটি দুআ। তিনি বললেন- ربي أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ - (রাব্বি ইন্নি মাসসানিয়াদ দূর, ওয়া আনতা আরহামুর র-হিমিন।) ইয়া রব! ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছি। আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু’।

আমার প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, এই দুআটি হলো সবচেয়ে অলঙ্কারপূর্ণ; ঈমান, তাওয়াক্কুল ও ইয়াকিনের একেবারে সর্বোচ্চ চূড়া। এমনকি দুআর ভেতরেও কোনো অভিযোগ নেই। আইয়ুব বলছেন না যে আমি আপনার কাছ থেকে অমুক জিনিস চাই ও আল্লাহ্‌। তিনি শুধু বলছেন ইয়া আল্লাহ্‌! একটা কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে। আরবি 'মাচ' মানে স্পর্শ করা। কিন্তু, অসুখ তো শুধু স্পর্শ করেনি বরং সমগ্র শরীর ছেয়ে গিয়েছিল। "ইয়া রব! আমি কিছুটা অসুবিধায় আছি।" এটা তো সামান্য অসুবিধা ছিল না। যে কারো কল্পনায় এর চেয়ে মন্দ কোনো অবস্থা হতে পারে না। তাঁর স্বাস্থ্য, তাঁর ছেলেমেয়ে, তাঁর সম্পদ সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

কিন্তু, আল্লাহর প্রতি আদব এবং সম্মান দেখিয়ে তিনি এভাবে দুআ করেন। ইয়া রব! আমি সামান্য একটু সমস্যায় আছি। আর আপনি ইয়া রব! আরহামুর রাহিমিন। এটাই দুআর সবটুকু। তিনি সবকিছু আল্লাহর দয়ার উপর ছেড়ে দিলেন। আমি এটা আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছি, আপনি দয়াবান, ও আল্লাহ্‌। আপনি আমার অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন। ইয়া রব! ইন্নি মাসসানিয়াদ দূর, ওয়া আনতা আরহামুর র-হিমিন।

প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, এই দুআটি মুখস্ত করুন। ইয়া রব! ইন্নি মাসসানিয়াদ দূর, ওয়া আনতা আরহামুর র-হিমিন। তৎক্ষণাৎ, তাঁর দুআ করার সাথে সাথে, ফাস্তাজাবনালাহু। আল্লাহ্‌ বললেন, আমি তাঁর জবাব দিলাম। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আইয়ুবকে বললেন- اُرۡکُضۡ بِرِجۡلِکَ ۚ هٰذَا مُغۡتَسَلٌۢ بَارِدٌ وَّ شَرَابٌ - "(আমি তাকে নির্দেশ দিলাম) তুমি তোমার পা দিয়ে যমীনে আঘাত কর, এই তো ঠান্ডা পানি, গোসলের জন্য আর পান করার জন্য।" (৩৮:৪২) এই সময়ে আইয়ুব হাঁটতে পারতেন না, দাঁড়াতে পারতেন না। তাঁর সারা শরীর গুটি ফোস্কায় ছেয়ে আছে। তাঁর দিকে তাকাতেও কষ্ট হয়।

তাই, আল্লাহ্‌ তাঁকে বললেন, তোমার পা দিয়ে আঘাত কর। যেভাবে আল্লাহ্‌ ইসমাইলকে বলেছিলেন, যেভাবে আল্লাহ্‌ ঈসা (আ) এর মাকে বলেছিলেন সামান্য একটু করো। কারণ, এমনকি মিরাকল পেতে হলেও আপনাকে চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ্‌ এমনিতেই পাঠান না, আপনাকে কিছু একটা করতে হবে। এমনকি মিরাকলও আমরা কিছু করলে তারপর ঘটে। এরপর আল্লাহ্‌ মিরাকল নিয়ে আসেন। তুমি তোমার পা দিয়ে যমীনে আঘাত কর, এই তো ঠান্ডা পানি, গোসলের জন্য আর পান করার জন্য। এই পানি পান করার সাথে সাথে তাঁর শরীরের ভেতরের সমস্ত অসুখ দূর হয়ে গেলো। আর গোসল করার সাথে সাথে শরীরের চামড়া থেকে সকল গুটি ফোস্কা দূর হয়ে গেলো।

আল্লাহ্‌ তাঁকে এমনভাবে সুস্থ করে দিলেন যে, তাঁর স্ত্রী বাহির থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসে দেখতে পেলেন এক হ্যান্ডসাম যুবক ছেলে বসে আছে। তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ও আল্লাহর বান্দা! তুমি কি জানো অসুস্থ লোকটা যাকে আল্লাহ্‌ অসুখ দিয়ে পরীক্ষা করছেন কোথায় গেলো? আমি তাঁকে খুঁজছি। সে কোথায় গেলো? তুমি কি তাঁকে দেখেছো 'মুবতালা' যাকে আল্লাহ্‌ পরীক্ষা করছেন। তখন তিনি বললেন- ও আল্লাহর দাসী! আমি-ই আইয়ুব। তখন তিনি তাঁর দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলেন এটা তাঁর যুবক স্বামী।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁদের প্রতি আবার আশীর্বাদ করেন। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন- وَ وَهَبۡنَا لَهٗۤ اَهۡلَهٗ وَ مِثۡلَهُمۡ مَّعَهُمۡ رَحۡمَۃً مِّنَّا وَ ذِکۡرٰی لِاُولِی الۡاَلۡبَابِ - আমি তাঁকে তাঁর সমগ্র পরিবার ফেরত দিলাম এবং এটার ডাবল দিলাম। আমার পক্ষ থেকে একটি দয়া স্বরূপ।

সুবহানাল্লাহ! তাফসীরের বইগুলোতে এসেছে- আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁদেরকে আবার যুবক-যুবতী বানিয়ে দেন; তাঁরা বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর। তাই, তাঁরা আগের বারের চেয়ে দুইগুণ বেশি নেয়ামত নিয়ে তাঁদের জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁরা তাঁদের সম্পদ ফিরে ফেলেন এবং এটার ডাবল। তাঁরা তাঁদের সকল সন্তান ফিরে পেলেন এবং এর দুইগুণ পরিমান। এরপর তাঁরা আগের উন্নত জীবনের চেয়ে আরও উন্নত জীবন লাভ করেন।

— ড. ইয়াসির ক্বাদী

পঠিত : ৮৫৯ বার

মন্তব্য: ০