Alapon

আবরার হত্যা : ছাত্রলীগের দায় ছাত্ররাজনীতির



আজ ৬ অক্টোবর। ২০১৯ সালের এই দিনে বুয়েট ছাত্রলীগের নৃশংস নির্যাতনে নিহত হন বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যালের ২য় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ।

ফেনী নদী থেকে ভারতকে বিনা শর্তে পানি দেওয়ার যে অসম চুক্তি করেছে শেখ হাসিনা, আবরার ফাহাদ সেই চুক্তির বিরোধীতা করে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। এই অপরাধে তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে সারারাত নির্যাতন করে খুন করে ছাত্রলীগ। ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও তাদের পা-চাটা দালালদের বিরুদ্ধে কথা বলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তখন বাংলাদেশের অবৈধ প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চারদিনের ভারত সফরে ছিল। সেখানে সে কিছু চুক্তি করে ভারতের সাথে। যথারীতি চুক্তিগুলো ছিল অসম। এরই প্রেক্ষিতে বুয়েটের ইলেট্রিক্যাল বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ ফেসবুকে একটা পোস্ট দেন। তিনি লিখেছেন,

//১. ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।

হয়তো এসুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন-

“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”//

তার এই পোস্টে তিনি শেখ হাসিনার তিনটি চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেন, ভারতকে বিনা শুল্কে মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া, ফেনী নদী থেকে বিনা শর্তে পানি প্রত্যাহার করবে ভারত ও বাংলাদেশে গ্যাসের সংকট থাকা সত্ত্বেও ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি।

এই পোস্ট যখন দিয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন তার বাড়ি কুষ্টিয়াতে। এর পরপরই তিনি রওনা হয়ে বুয়েটের হলে চলে আসেন। এদিকে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত থাকা তার সহপাঠী ও সিনিয়র ছাত্ররা তার এই পোস্ট দেখে ক্ষিপ্ত হয়। আবরার সম্পর্কে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। সেখানে কেউ কেউ দাবি করে আবরার ‘শিবির’ করে। কারণ সে নামাজের জন্য ছাত্রদের ডাকে।

যেহেতু তারা ধারণা করতে পেরেছে সে শিবির তাই তাকে মারা তাদের জন্য জরুরি হয়ে গেছে। এভাবে তারা বহু ছাত্রকে পিটিয়েছে। আবরারের ঘটনার কিছুদিন আগে বুয়েট শিবিরের সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে একই কায়দায় দিনভর পিটিয়েছে। এরপর পুলিশ ডেকেছে।

এদেশ মগের মুল্লুক! যারা নির্দয়ভাবে পিটিয়ে সিরাজুল ইসলামকে আধমরা বানিয়েছে তাদের কিছুই বললো না, উল্টো দুই পা এক হাত ভাঙা এবং সারা শরীর থেঁতলানো সিরাজকে গ্রেপ্তার করেছে। সিরাজুল ইসলাম সেদিন তার থিসিস পেপার জমা দিতে গিয়েছিলেন বুয়েটে। যাই হোক এরকম একটি দুটি নয়, বহু ছাত্র নির্যাতন হয়েছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের দ্বারা।

যাই হোক, আবরারের পোস্টের প্রেক্ষিতে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের মেসেঞ্জার গ্রুপে আবরারকে মারার নির্দেশনা দেয়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা তাকে বাড়ি থেকে ফেরার অপেক্ষা করতে বলেন। আবরার যখন হলে ফিরে এলো তখন ৬ অক্টোবর রাতে আবরারকে তার দুটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপসহ ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আবরার শেরে বাংলা হলের ১০১১ কক্ষে থাকতেন।

বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর মোবাইল ফোন দুইটি চেক করে। একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মুনতাসির আল জেমি ল্যাপটপটি চেক করে। এসময় মেহেদী হাসান রবিন চড় মারতে থাকে আবরারকে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সামসুল আরেফিন রাফাত স্টাম্প এনে দিলে তা দিয়ে ইফতি মোশাররফ সকাল আঘাত করতে করতে স্টাম্পটি ভেঙে ফেলে।

পরবর্তীতে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র অনিক সরকার আরেকটি স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকে। এরপর ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিওন আবরারকে চড় এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে আঘাত করে।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে মারধরের ফলে অসুস্থ আবরার মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। ইফতি মোশাররফ সকাল ধমক দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে চড় দিতে থাকে। পরে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুর রহমান স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারতে থাকে। এরপর ইফতি মোশাররফ সকাল স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে মারে। খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর চড়-থাপ্পড় মারে আবরারকে। রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার গায়ের সব শক্তি প্রয়োগ করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে স্টাম্প দিয়ে আবরারকে আঘাত করতে থাকে। এরপর ১২ টার দিকে ক্লান্ত হয়ে সবাই রুম থেকে বের হয়ে যায়।

রাত দুইটার দিকে তারা আবার ফিরে আসে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বমি করেন আবরার। আবরারকে এরপর ২০০৫ নাম্বার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহা সবকিছু জানার চেষ্টা করেন, তাকে মেরে আরও তথ্য বের করার কথা বলে। সে আবরারের অবস্থা খারাপ জেনে তাকে হল থেকে বের করতে বলে। মেহেদী হাসান ও অনিক সরকার ২০০৫ নম্বর কক্ষে ঢুকে দেখে তার অবস্থা ঠিক আছে বলে চলে যান। এরপর আবরার আবারও বমি করেন।

মেহেদী হাসান তাকে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করার কথা বলছিল। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা তখন তাকে তোশকসহ নিচতলায় নামিয়ে রাখে। সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল তখন পুলিশের সাথে কথা বলছিলো। ইসমাইল ও মনির অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দিলে তা আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসককে নিয়ে আসেন। কিন্তু তার আগেই আবরার ফাহাদ শাহদাতবরণ করেন।

বুয়েটের শের-ই-বাংলা হলের নিচতলায় সোমবার ভোর তিনটায় পুলিশ আবরারের লাশ উদ্ধার করে। মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মাশুক এলাহী রাত ৩ টার দিকে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন। ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরাতে দেখা যায় রাত ৩টা বেজে ২৬ মিনিটে বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিষদের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান লাশ এর সামনে দাঁড়িয়ে হত্যাকারীদের সাথে আলোচনা করে চলে যান। পরের দিন তিনি দাবী করেন যে এই বিষয়ে সকাল হবার আগে তিনি কিছুই জানতেন না।

আবরারের মোবাইল ও ল্যাপটপ ছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে। তাই মৃত্যুর পরও তার পরিবারকে সহপাঠীদের কেউ ফোন দিতে পারছিলেন না। আবরারের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজকে পড়াতেন দিগন্ত নামে বুয়েটের এক শিক্ষার্থী। তার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফাইয়াজকে ফোন দেওয়া হয়। ফাইয়াজ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করে। এভাবে তার আত্মীয়-স্বজন জানতে পারে।

আবরার হত্যার পর শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে কেউ কাউকে খবর দিতে পারছিলেন না। ভয়ের কারণ, যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেখে ফেলে। এজন্য ১৭তম ব্যাচের কয়েকজন একত্রিত হয়ে একটি মেসেজ লেখেন। একই সময় সেই টেক্সটটি বুয়েটের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনসহ সব ক’টি ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপে তারা পোস্ট করেন। এরপর সবাই ধীরে ধীরে ঘটনাটি জানতে পারেন।

আবরার যখন মুমূর্ষু অবস্থায় তখন তাকে প্রথমে ‘শিবিরকর্মী’ হিসেবে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চান ছাত্রলীগের এসব নেতা। এজন্য ওইসময় ঘটনাস্থল থেকে ছাত্রলীগের এক নেতা চকবাজার থানার ডিউটি অফিসারের নম্বরে খবর দিয়ে বলেন, ‘এক শিবিরকর্মীকে আটক করা হয়েছে, তাকে নিয়ে যান।’ খবর পেয়ে চকবাজার থানা থেকে টহল পুলিশের একটি দলকে শেরেবাংলা হলে পাঠানো হয়।

এই হত্যার সাথে ২২ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জড়িত। হত্যার পরে মেহেদি হাসান রাসেল ও অনিক সরকারসহ খুনীরা লাশ গুম ও আবরারকে মাদক দিয়ে ‘গণপিটুনি’ বলে ফাঁসানোর চেষ্টা করতে থাকে। আবরারের যদি মৃত্যু না হতো তবে বরাবরের মতই কিছু হতো না। আবরারকে কারাগারে যেতে হতো। এভাবেই হয়ে আসছে।

আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

আসামিরা হলো মেহেদী হাসান রাসেল, (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ১৩ ব্যাচ), মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪ ব্যাচ, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ), অনীক সরকার (১৫ ব্যাচ), মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল বিভাগ, ১৫ ব্যাচ), ইফতি মোশারফ হোসেন (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬ ব্যাচ), মনিরুজ্জামান মনির (পানিসম্পদ বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫ ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), মোজাহিদুল (ইইই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), তানভীর আহম্মেদ (এমই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), আকাশ (সিই বিভাগ, ১৬ ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), শাদাত (এমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), তানীম (সিই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), মোর্শেদ (এমই বিভাগ, ১৭ ব্যাচ), মুয়াজ, মনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ)। পরে খুনীদের জবানবন্দী অনুযায়ী আরো ৬ জনকে আসামী করা হয়।

এই ঘটনাটি সারা পৃথিবীতে ভাইরাল হওয়ায় এর বিচার হয়। বিচারের রাখে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২৫ জন আসামীর মধ্যে ৩ জন পলাতক আছে।

ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে আবরার ফাহাদকে খুন করলেও এর দায় পড়ে ছাত্ররাজনীতির ওপর। বুয়েট প্রশাসন ছাত্রদের দাবীর মুখে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ না করে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে।

পঠিত : ৮৯০ বার

মন্তব্য: ০