Alapon

মউলিদ বা মিলাদুন্নবী



মউলিদ
বা মিলাদুন্নবী
""'''''''''''''""""""""""""""

১.
হিজরী ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস; রবিউল আওয়ালের ১২ তারিখে নবী মুহাম্মাদ (সা) এর জন্মদিবস ‎উদযাপনকে মউলিদ বা ঈদে মিলাদুন্নাবী বলা হয়।
দশম শতকের আগে মউলিদ বা মিলাদুন্নবী শব্দটির সাথে মুসলমানরা পরিচিত ছিলো না। সে সময় রাসুল সা এর জন্ম বা ওফাৎ দিবস উপলক্ষে কোন কর্মসূচী পালন করার সুযোগ ছিলো না।
মউলিদ বা মিলাদুন্নবী পালন শুরু করেন আল আজহারের গোড়া পত্তনকারী শিয়া ফাতেমিরা (৯০৯-১১৭১)। সুন্নিদের মধ্যে এ ধারা শুরু হয় তেরশ শতকে ইরাকের ইরবিল প্রদেশের গভর্নর নীল ভল্লুক খ্যাত মুজাফ্ফর আদ-দ্বীন গোকবরি বা কুকুবরি (১১৫৪-১২৩৩)। তিনিই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেন। সেটা ছিলো ১২০৭ সাল। তখন এ বঙ্গে বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে ইসলামের গোড়া পত্তন কেবল শুরু হয়েছিল। কুকুবরি ছিলেন জেরুজালেম বিজয়ী বীর গাজি সালাউদ্দিন আইউবীর একজন কমান্ডার ও শ্যালক।
তিনি এই দিন উৎযাপনের জন্য একহাজার পশু জবাই ও তিন লাখ দিরহাম দান করেন। এতে রাসুল সা এর মউলুদ পালনের চেয়ে ও ব্যক্তিগত অভিলাষ ও শাসনতান্ত্রিক রাজনীতি ছিলো মূখ্য।
তখন মুসলিম বিজিত অঞ্চলে খৃষ্টানরা প্রতিবছর যীশুর জন্মদিন পালন করতো, এতে হাল আমলের 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার' মনে করে অনেক মুসলমান ও অংশ গ্রহণ করতো, তাই দেখে মুসলমানরাও অনুকরণ করে রাসুল সা এর জন্মদিনের উৎসব বা মউলিদ পালন করা শুরু করলো। পরবর্তীতে সুফিবাদ মউলিদ বিস্তারে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন।
১৫৮৮ সালে সর্বপ্রথম সরকারীভাবে অটোম্যান সম্রাটরা এদিনটিকে ছুটি ঘোষণা করে।

২.
কারা পক্ষে বলেছেন?
মিশরীয় ইসলামী স্কলার সা'ফি মাজহাবের অনুসারি ইবনে হাজার আল আসক্কালানি (১৩৭২-১৪৪৮), ইবনে রজব আল হাম্বেলি (১৩৩৫-১৩৯৩) দুজনেই এভাবে মতামত প্রদান করেন যে, রাসুল সা যেহেতু মুসলমানদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনন্য উপহার তাই আল্লাহ কে তার প্রতিদান দেয়া দরকার। সে লক্ষে তারা মউলিদকে সমর্থন জানান তবে এটাকে 'বেদায়া হাসানা' হিসেবে বর্ণনা করেন। তারা এ দিন কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, গরীব-দুস্থদের মাঝে দান ও খাবার বিতরণ ইত্যাদি কাজ গুলোকে করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন।
তাফসীরে জালালাইনের কো রাইটার, ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা মিশরীয় থিওলজিস্ট, সা'ফি মাজহাবের অনুসারী আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (১৪৪৫-১৫০৫) ও একই মত পোষণ করেছেন।
এই রূপ মত পোষণকারী আরো স্কলাররা হলেন- সা'ফি অনুসারী সিরিয় অধিবাসী আবু সামা আর মাকদিসি (১২০৩-১২৬৮), মরোক্কোর মালিকি অনুসারী ইবনে আল হাজ আল ফাচি (১২৫০-১৩৩৬), ইবনে হাজার আল হাইতামি (১৫০৩-১৫৫৬) প্রমুখ।
বর্তমান সময়ের বিখ্যাৎ ইসলামী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আলাউয়ি আল মালিকি (১৯৪৪-২০০৪), ইউসুফ আল কারদাভি (১৯২৬-২০২২), পাকিস্থানী কানডিয়ান তাহির আল কাদরি (১৯৫২-) প্রমুখরা মাউলুদ বা মিলাদুন্নবিকে এই অর্থে সমর্থন করেছেন।


৩.
কারা বিপক্ষে বলেছেন?

বিখ্যাৎ হাম্বেলি স্কলার ইমাম ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮) মউলিদ উদযাপনকে খৃষ্টানদের অন্ধ অনুকরণ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন এটা মাকরুহ। মিশরীয় মালিকী স্কলার আল ফাকিহানি এটাকে নিন্দনীয় আবিষ্কার হিসেবে অভিহিত করে মউলিদ কে হারাম সাব্যস্থ করেছেন। তিনি বলেন, রাসুল সা এর জন্ম ও ওফাৎ দিবস একই তারিখে হয়েছে তাই বেদনাময় একটি দিনে জন্মের উৎসবে মতোয়ারা হওয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

মরক্বোর অধিবাসী মালিকি মতের অনুসারী ইবনে আল হাজ আল আবদারি (১২৫০-১৩৩৬) এবং গ্রানাডার মালিকি স্কলার আবু ইসহাক আল সাতিবি (১৩২০-১৩৮৮) মউলিদকে হারাম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আন্দালুসিয়ান স্কলার আবু আব্দুল্লাহ আল ফাসর (মৃত্যু ১৪০৮), সাবেক সৌদি গ্রান্ড মূফতি যিনি অন্ধ ইমাম হিসেবে পরিচিত শেখ আব্দুল আজিজ ইবনে বাজ (১৯১২-৯৯) আব্দুল্লাহ আল তোয়াইজিরি (মৃত্যু ১৯৯২) প্রমুখ স্কলারদের মতে রাসুল সা এর জন্মদিন উদযাপন দ্বীনের নব আবিষ্কার, শরিয়তের রীতি বিরুদ্ধ কাজ। রাসুল সা এর জীবদ্দশায় অনেক স্মরণীয় ঘটনা ছিলো যা উদযাপনের সুযোগ ছিলো যা তিনি করেননি এবং কাউকে উৎসাহিত ও করেননি যেমন- প্রথম অহি যেদিন এলো, মেরাজের দিন, হিজরতের দিন ইত্যাদি।

হিজরি সাল প্রবর্তনের সময় রাসুল সা এর জন্মসাল কে ভিত্তি হিসেবে ধরার জন্য প্রস্তাব করা হলে হযরত ওমর রা সেটা খৃষ্টাব্দের সাথে মিলে যাবে সে জন্য তা নিতে তিনি অস্বীকার করেন এবং রাসুল সা এর হিজরতের বছরকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। এটা দ্বারা বুঝা যায়, খৃষ্টানদের অনুকরণে রাসুল সা এর জন্মদিন পালন করা শরিয়তেরে মূলনীতি পরিপন্থী ও মাকরুহ।


৪.
হাল আমলে মিলাদুন্নবী পালনের জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে সেটা উপরের পক্ষ-বিপক্ষ মতামত প্রদারকারী কারোরই সমর্থন পাচ্ছে না। তারা নামাজ পড়া, রোজা রাখা, ওয়াজ আলোচনা, তেলাওয়াৎ, আবৃতি গরীব দুস্থদের মাঝে দান খয়রাত ও খাবার বিতরণ ইত্যাদি কাজ গুলোকে করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন।

এখন আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা নিতান্তই শো-ডাউন, জন নিপীড়ন ও অর্থের অপচয় যা ইসলাম ও রাসুল সা এর শিক্ষার পরিপন্থী। এতে করে 'সুকৃতির পরিবর্তে বিকৃতি' এবং সার্বজনীনতার পরিবর্তে ব্যক্তিগত প্রদর্শনেচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে যার নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে ইসলাম ও রাসুল সা সার্বজনীন শিক্ষা ও সৌন্দর্য।

যে পদ্ধতিতে মাসব্যাপী দেশে লালন উৎসব হয়, সনাতনধর্মীরা জন্মাষ্টমী পালন করেন, দেশে দেশে জাতীয় কবি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে নানান কর্মকান্ড চলে, মুসলমানরা ও কি ধীরে ধীরে মৌলিক ইবাদত বাদ দিয়ে বিকৃতির সে বৃত্তে প্রবেশ করছে?
এব্যাপারে সবারই সতর্ক আত্মসমালোচনা করা উচিত।

খুলশী, চট্টগ্রাম।
৯/১০/২০২২ ইং।

পঠিত : ২৭৪ বার

মন্তব্য: ০