Alapon

|পৌরুষ - এক হারানো জহরত |



আজ কথা বলব সমাজের খুব সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন নিয়ে, যেটা রীতিমতো দুশ্চিন্তার এবং এখনই পরিবর্তনের চেষ্টা না করলে হয়তো খুব দেরী হয়ে যাবে।

খুব বেশিদিন হয়নি, এই আট দশ বছর আগের কথা। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আব্বু আম্মু আমি, ছোট ভাই সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করতে করতে নানুবাড়ি বেড়াতে যেতাম। প্রায়ই দেখতাম আব্বু প্রায় পুরোটা পথ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো কোন মহিলা বসার জায়গা পাচ্ছে না, বা কোন পঞ্চাশ বা ষাটোর্ধ বৃদ্ধ দাড়িয়ে আছে, বা কোন মহিলার কোলে বাচ্চা। শুধু আব্বু একা নয়, বাসের যে কোন পুরুষকেই তখন এই উদারতা করতে দেখতাম, এটা ছিল খুবই কমন একটা দৃশ্য, বরং এর ব্যত্যয় যে হতে পারে সেটাই ছিল অস্বাভাবিক। আর যদি সে বছর পঁচিশ এর যুবক হয়, তাহলে তো কথায় নেই- আশেপাশের যে কোন মানুষের যে কোন সমস্যায় নিজে স্যাক্রিফাইস করা যেন তাদের জন্য একরকম ফরজ ছিল তখন। মনে হতো এই যুবক গুলো অল্প বয়স্ক বলে যেন সারাটা পথ জনসেবা করার চাকরি নিয়েছে। তাদের শক্তি আছে, সামর্থ্য আছে, বিবেক আছে- ওই যে "আঠারো বছর বয়স" কবিতাটা পড়েছিলাম না?
.
.
আমি জানিনা এই দৃশ্য কিভাবে দুর্লভ হয়ে গেল আমাদের সমাজে। আমি জানিনা মানবতা আজ ধামাচাপা পড়ল কোন উন্নতির গলিত স্তুপে। আমি সত্যিই জানিনা সমাজের পুরুষরা তাদের পৌরুষ হারালো কোন মায়াবিনীর হাতছানিতে৷ ওই দৃশ্যগুলো মিস করছি বেশ ক'বছর ধরে। এই গতকালও পূজোর ছুটিতে ট্রেনে পা ফেলার জায়গা ছিল না, লোকাল ট্রেনের তিন সিটের জায়গাগুলোতে যেখানে প্রয়োজনে চারজন বসা খুবই স্বাভাবিক বিষয় সেখানে পঞ্চাশোর্ধ এক অসুস্থ মহিলাকে দাড়িয়ে যেতে হলো। এক বছর পঁচিশ এর যুবক তার স্ত্রী আর বছর দু'য়ের বাচ্চা নিয়ে ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছিল হয়তো। ছেলেটা কোনভাবে মহিলাকে বসতে তো দিলই না, উচ্চস্বরে অসুস্থ মানুষটার সাথে যতক্ষণ তর্ক করল, সে দৃশ্য দেখা যায় না। আরো অবাক করা বিষয় হলো, আশে পাশের একটা পুরুষ একটা প্রতিবাদ করল না। পুরুষ কি শুধু গায়ে গতরে? আমার কাছে মনে হয় একটা পুরুষের জন্মই হয় নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তার স্ত্রী, সন্তান, মা, বোন সবার জন্য সে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিতে পারলেই না তার পুরুষ হবার স্বার্থকতা!

ট্রেন থেকে নেমে খানিকটা পথ বাসে যেতে হয়। ওই যে, বাসেও ছিলো উপচে পড়া ভীড়। আমিসহ আমার সামনে পিছনে তিনচারজন মহিলা কত কষ্টে দাঁড়িয়ে আছি তা সীটে বসা নানা বয়সের সুঠাম দেহের পুরুষরা স্বচক্ষে উপভোগ করছিল। ঠিক আমার কোলের ভিতরের সীটটা খালি হলো। আমাকে জাস্ট হতভম্ব করে দিয়ে পিছন থেকে এক লোক আমি জানিনা কিভাবে, উড়ে এসে নাকি লাফিয়ে এসে সীটটায় বসে পড়ল। তার বয়স ৩৫ হবে। আমার বোরখা পরে এভাবে ঝুলে ঝুলে যেতে কষ্ট হচ্ছে, আমার সামনের আন্টিও পর্দানশীল এবং তার বয়স পঞ্চাশ হবে হয়তো। থাক! আমরাই দাঁড়িয়ে যাই। কী আর করা। পুরুষের তো এই সমাজে আজ বড় অভাব।
.
.
এ দৃশ্য দেখবো নাই বা কেন? আজকালকার বছর কুড়ির যুবকেরা তো মোবাইল গেইম খেলেই কুল পায় না, দায়িত্ব কাকে বলে তা কি বাবা মায়েরা জানতে দিচ্ছে? যখন যে গ্যাজেট চাই, সাথে সাথে হাতে দিয়ে দাও। আমি কষ্ট করে মানুষ হয়েছি, আমার ছেলেকে কষ্ট করতে তো দিবনা। পৌরুষের ঝলকানি যে সেই সমাজে বাঘের দুধ হবে, তা আর বলতে!

হ্যা, আমি এই সমাজের নামেমাত্র পুরুষদের গায়ে লাগানোর জন্যই বলছি। লজ্জা করুন। এই সমাজ থেকে একজন উমার এর আশা কী করে করব আমরা? আর বোনেরা, নিজের স্বামীর মধ্যে পুরুষত্বের এই গুণগুলো আছে কিনা খেয়াল করুন। না থাকলে ইন্সপায়ার করুন। আপনিই পারবেন। আর সন্তান? গড়ে তুলুন সেইভাবে, হয়ে উঠুন এক একজন সালাউদ্দিন আইয়ুবির জননী। আপনার বছর চারের ছেলে বাচ্চাটা যেন স্কুলে যাবার পথে তার বছর তিনের ছোট বোনের স্কুল ব্যাগ ক্যারি করতে স্বউদ্যোগী হয়। বাসায় গেস্ট আসলে মায়ের পর্দা রক্ষায় ওইটুকু বাচ্চা যেন সবার আগে এসে আপনার বেডরুমের দরজা চেপে দিয়ে যায়। কী? পারবেন না? পারবেন না এমন সুপুরুষের জননী হতে?


| পৌরুষ - এক হারানো জহরত|
-ফৌজিয়া তাবাসসুম মিম্মা

পঠিত : ১৪৯৪ বার

মন্তব্য: ০