Alapon

মীলাদুন্নবী | সীরাতুন্নবী



আমাদের দেশে যেকোনো পজেটিভ উদ্যোগ সফলতা পেলেই সেটাকে চূড়ান্ত নেগেটিভ ও পতিত না-করা পর্যন্ত আমরা থামি না। মাল্টি পারপাস, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, এমএলএম মার্কেটিং এবং বিভিন্ন চলতি পণ্যের নকল পণ্য বাজারজাত করার প্রবণতা—আমাদের এই মানসিকতার সহজ উদাহরণ। যেকোনো আপাত নিরীহ ও জায়েজ বিষয়কে আমরা প্রান্তিক উদারতা ও প্রান্তিক কঠোরতার জালে আটকে হারামের স্তরে নিয়ে যাই। দেখা গেল কোনো একজন আলেম মনীষী একটা মুবাহ, জায়েজ বা মুস্তাহাব নিজে ব্যক্তিগতভাবে আমল করতেন। তার অনুসারীরা সেইটা আমল করছেন। এইটুকু সুন্দর। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যাবে এই নিখাদ আমলটির সঙ্গে নানা অনুষঙ্গ যুক্ত হবে, যুক্ত হবে অগণিত অসুন্দর কিছু বিদআত। দিন যেতে থাকবে, আর সেই অসুন্দরগুলো হারামে পরিণত হবে। বিদআতগুলো লোকদের শিরকের দিকে নিয়ে যাবে। যেমন : এই দেশে যেই সুফি-দরবেশগণ ইসলাম নিয়ে এসে মানুষদের মুক্তি দিয়ে ইসলামের ভিত গড়েছিলেন; সেই শাহজালাল ইয়েমেনি, শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমি, শাহ মাখদুম ও শাহ পরান রাহি. প্রমুখের কবরগুলো হারাম, বিদআত ও শিরকের আখড়ায় পরিণত করেছে এই দেশের মানুষেরা।


এই যে দ্বীনের দাঈগণের কবর-খানকা, আজকে বদদ্বীনির কেন্দ্রে পরিণত হলো, এর পেছনের কারণ ও ইতিহাসটা আসলে কী? এসব জায়গায় প্রভাবশালী, ক্ষমতা, প্রশাসন কেন সব সময়ই সেই অসুন্দর আর বিদআত শিরকের পক্ষ নেয়? কেন শুধু বদদ্বীনির অধিকার রক্ষার প্রশ্ন আসে? দ্বীনদারের দ্বীনদারির কোনো অধিকার কি নেই? ইসলামের কি কোনো কাঠামো নেই? ইসলাম কি অপূর্ণ? ইসলামবিষয়ক প্রচার, সিদ্ধান্তের কি কোনো অথরিটি নেই? সেই অথরিটি কোনটা ইসলাম এবং কোনটা ইসলাম না—সেটা বলার অধিকার রাখেন না? ইসলামের নামে চলা ইসলামহীনতাকে প্রতিহত করার অধিকার কাদের ইশারায় ক্ষুণ্ন হয়? এইসব কি শুধুই কয়েকটা রিচুয়াল, শব্দ, সুর, গান-কবিতা? নাকি ইসলাম ও মুসলমানদেরকে কালচারাল ওয়ারের মাধ্যমে ঈমান ও রুহানিয়ত শূন্য করার শয়তানি পলিটিক্স?


ইসলামি ব্যাংকিং বা ইসলামি পরিভাষার কোনো বাণিজ্যিক সফলতা আসলেই সবাই সেই সফলতার ফল ভোগ করতে উঠে-পড়ে লাগে। তৈরি করে অগণিত সন্দেহ আর অভিযোগ। গত কিছুদিন ধরে ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একজনের লেখা এক বইয়ের কাউন্টার দিচ্ছে পুরো ইসলামি ব্যাংকিং কমিউনিটি। ইসলামি ব্যাংকিং বিরোধী এই বই লেখার অগণিত কারণ থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো—সুদী ব্যংকগুলোর ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো খোলা; লাভের ফল ভোগ করার মানসে।
ব্যাবসাবাণিজ্যের মতোই ইসলাহি, ইলমি ও দাওয়াতি কাজের পদ্ধতিতেও এইরকম ফল ভোগের জন্য একদল মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। দিনে দিনে অগ্রজগণের ইলম, রুহানিয়ত, তাজকিয়া ও হিকমত অনুজদের মধ্যে কমতে থাকে। ফলে অগ্রজগণের মতো গুরুত্ব পাওয়ার জন্য অনুজরা তাদের নিরেট ও নিখাদ আমলগুলোকে বরবাদ করতে থাকে নিজেরদের মনচাহি ভাবনার অনুপ্রবেশ করিয়ে। আর সেই অনুপ্রবেশ সংকটের কারণেই এই দেশে মৌলিক শুদ্ধ সিলসিলার উত্তরাধিকার হয়েও বিদআত ও শিরকি সিলসিলা শুরু করেছে অনেক খানকা ও পির বংশ।


এইসব সংকটের সঙ্গে আরও কিছু সংকট এই অঞ্চলের মানুষের বিবাদকে তীব্রভাবে উসকে দিয়েছে, সেটি হলো দাওয়াতি ভাষা প্রয়োগ না-করা। ইখতেলাফের উসুল না-মানা। দ্বিমতের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে না-পারা। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সৌধ নির্মাণ করতে না-পারা। আর যারা এই সবগুলো কাজ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের যোগ্যতা ও সক্ষমতা রাখেন, তাদেরকে দল-গোষ্ঠী-ঘরগত পলিটিক্সের মাধ্যমে কাজ করতে দিইনি আমরা। এই দেশের সাধারণ মানুষজন ইলমি ও দরদি মানুষগুলোকে অসামাজিক জ্ঞান করে এবং সময়ের জন্য অনুপযুক্ত মনে করে। আর বাকপটু, বিতার্কিক, বাচিক শিল্পী, সুরেলা কথক আর এটেনশন সিকারদেরকে নিজেদের ত্রাতা হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে বিরোধ ও বিভাজন ক্রমে বাড়তে থাকে।

এইরকম একটা প্রেক্ষাপট থেকেই মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবীবিষয়ক কনফ্লিক্টের শুরু সম্ভবত। সম্ভবত কেন বললাম? কারণ, এই দুই পরিভাষাগত বিরোধটা মূলত দুইটা ইলমি ও তাসাউফি সিলসিলার মধ্যকার বিরোধ। যাদের বিরোধের মৌলিক উৎস হচ্ছে—কুরআন ও সুন্নাহের বোধ ও সমঝকে কেন্দ্র করে। মোটাদাগে দেওবন্দি ও বেরেলভি বা কথিত সুন্নি ও ওয়াহাবি মতাদর্শের মধ্যকার বিরোধ থেকে এই মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবী পরিভাষাগত বিরোধের শুরু।


মীলাদুন্নবী:

এই বিষয়ক শরয়ি আলোচনা প্রায় সবাই আমরা কম বেশি শুনেছি। ভাষাগত আলোচনায় মীলাদ শব্দের অর্থ—জন্ম। মীলাদুন্নবী অর্থ হয়—নবীজির জন্মবৃত্তান্ত। মানে, নবীজির জন্মসংক্রান্ত আলোচনা। এইরকম একটা বিষয় কোনোভাবেই বর্জনযোগ্য হতে পারে না। যখন মীলাদুন্নবী উদ্‌যাপন ও পালন করতে চাওয়া হয়, তখন থেকেই ভিন্ন মতের শুরু হয়।
সেইসব মত ভিন্নতার মধ্যে আছে—‘নবীজি যেদিন এসেছেন সেই দিনই ইন্তেকাল করেছেন’, ‘জন্ম তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও মৃত্যু তারিখ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই’, ‘নবীজির জন্ম উম্মতের জন্য আবশ্যকীয় কোনো বিষয় নয়। কেননা নবুয়ত প্রাপ্তির পর থেকে নবীজির জীবনী উম্মতের জন্য পালনীয়’, ‘নবীজি ও সাহাবিগণ মীলাদুন্নবী পালন করেননি’ ইত্যাদি। মীলাদুন্নবী-পন্থিরা তাদের বিপক্ষে যায় বলে এসবের জবাব দেন। কিছু জবাব এমন—‘শোক তিন দিন। আনন্দ আজীবন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের জন্মদিনে কেন আমরা খুশি হব না!’



সীরাতুন্নবী:


সীরাত হলো—জীবনী। ফলে সীরাতুন্নবী হলো—নবীজির জীবনী। যারা সীরাতুন্নবীর কথা বলছেন, তাদের কথা হলো—সীরাতের ভেতরে মীলাদ আছে। কিন্তু মীলাদের ভেতরে সীরাত তো নেই। অপর দিকে ইসলাম কোনো দিবসকেন্দ্রিক দ্বীনের নাম নয়। নবীজির পূর্ণ জীবন আমাদের জন্য আদর্শ। তাহলে কেন শুধু শুধু মীলাদুন্নবী বলব আর একদিনের জন্য খুশি হব? নবীজির উম্মত হতে পারায় আমরা সারা জীবন খুশি। প্রতিদিন নবীজিকে অনুসরণ করব। নবীজির আনুগত্য করব।

কথা এই পর্যন্ত থাকলে সমস্যা ও বিভাজন এতটা তীব্র হতো না। কথা যেতে যেতে তাকফির (কাফের বলা) পর্যন্ত পৌঁছেছে। একদল আরেকদলকে নানানরকম মন্দ নামে ডাকতে শুরু করেছে। কেউ বলছেন—ওয়াহাবি, জাহান্নামি, নবীজির দুশমন। কেউ বলছেন—আহলে সিন্নি, বিদআতি মাজারপূজারি। ফলে সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়েছে। বিরোধ তীব্র হয়েছে। ঐক্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে।

এখানে মীলাদুন্নী একটি নিখাদ জায়েজ ধীরে ধীরে, কিয়ামের আবশ্যকতা, নবীজির হাজিরনাজির, জশনে জুলুস, আলোকসজ্জার অপচয়, দিবসকেন্দ্রিক খ্রিষ্টীয় কালচার ও এইসব পছন্দ না-করা বা এইভাবে পালন না-করাকে দোষনীয় মনে করা; যারা পালন করেন না, তাদের কাফির মনে করা ও নবীজির দুশমন মনে করা-সহ এই নির্দোষ অনুভূতি একটি পরিপূর্ণ দ্বীনহীন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।


একটা নিজস্ব অভিজ্ঞতা:


তখন শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছি। সুনামগঞ্জের বিশম্ভরপুর উপজেলায় আব্বার চাকরির সুবাদে পড়তে গেছি। লজিংবাড়ির অদূরে এক রাতে শুনি মিলাদ মাহফিল। রাত গভীর হলো। মাইকের শব্দে বারবার ঘুম ভাঙছে। হঠাৎই শুনি বক্তা বলছেন—‘যারা দেওবন্দি, যারা দেওবন্দির লগে আত্মীয়তা করে, যারা দেওবন্দিদের ঘরে খায়, দেওবন্দি মারা গেলে তার কবরের ঘাস যে গাইয়ে (গাভি) খায়, সেই গাইয়ের দুধ যে খায়, সেও কাফির।’ হয়রান হয়ে পরের দিন আব্বার কাছে এসে ঘটনা বললাম। আব্বা বললেন—এইসব শুনলি কেন? এইগুলো ফিতনা। আবার কোনো দিন এইরকম হলে রাতে আমার কাছে চলে আসবি। একটা জায়েজ ও মুস্তাহাব খুশি প্রকাশ না-করার কারণে যখন কাউকে কাফির বলা হয়, তাও যার নির্দিষ্ট দিনটি নিয়ে মতভেদ আছে, তখন এ-বিষয়ক সংকটের গভীরতা কতটা তীব্র, তা সহজেই অনুমেয়।

ওদিকে সীরাতুন্নবী এখনো পর্যন্ত নির্দোষ পরিভাষা। তবে কোথাও কোথাও মীলাদুন্নবীকে কাউন্টার দিতে সীরাতুন্নবীকেও দিবসকেন্দ্রিক বৃত্তে আটকানোর চেষ্টা চলমান। আশা করি সীরাতুন্নবী সীরাতের পদাঙ্কে চলতে থাকবে হকের ঝান্ডাবাহী হয়ে।

ওদিকে এই দুটি পরিভাষাই সম্মানিত। শুধু পালনকেন্দ্রিক বিরোধের কারণে অনেকেই না বুঝে মারাত্মক ভুল করছেন। কেউ মীলাদুন্নবীকে নিয়ে রম্য ও ট্রলে মেতে উঠছেন। কেউ আবার মীলাদুন্নবী জিন্দাবাদ বলে সীরাতুন্নবী ছুড়ে ফেলতে চান। দিন শেষে দুই দলই চরম প্রান্তিকতায় আক্রান্ত। আশা করি আগামীতে সবাই সংযত হবেন। আদাবুল ইখতেলাফ ও ইহতেসাব মেনে কথা বলবেন। নবীজিসংক্রান্ত শব্দগুলোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকবেন।
এই মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবীর পলিটিক্স শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে সীরাতুন্নবী লেখার সুযোগ নেই। অবশ্যই মীলাদুন্নবী লিখতে হবে। জমিয়তুল মুদাররেসীন নামক একটি শিক্ষক সংগঠনের দুইজন বাহাউদ্দীন ও শাব্বির আহমদ মোমতাজী মীলাদুন্নবীর পক্ষে রিট করেন। সেই রিটে ইনকিলাবের তৎকালীন সম্পাদক আব্দুল মান্নান সাহেবের তৎপরতায় সীরাতুন্নবীর বিপক্ষে এবং মীলাদুন্নবীর পক্ষে রায় আসে। [বহু আগে কিশোরকালের ঘটনা। স্মৃতি থেকে লেখা। ঘটনা একটু এদিক-সেদিক হতে পারে। পরবর্তী সময়ে যথাযথ যাচাই করে বিস্তারিত লিখব।] দীর্ঘদিন সেই রায় আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বাংলাদেশ গেজেটে মন্ত্রীপরিষদ ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’-কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ফলে ১২ রবিউল আওয়াল নবীজির জন্মদিনে সীরাতুন্নবী লেখা ও পালন করা কার্যত বেআইনি ঘোষিত হলো।
অবশ্য এই রায়বিষয়ক একটা জটালতা মনে আছে এখনো। আমি আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহে তখন অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি। রবিউল আউয়ালে ‘সীরাতুন্নবী’ লেখার কারণে দণ্ড হিসেবে কলেজের প্রোগ্রাম করতে পারেননি প্রিন্সিপাল স্যার ও ইসলামিক স্টাডিজের বিভাগীয় প্রধান স্যার। ফলে নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলাম ও বিজ্ঞান সেমিনার’ শিরোনামে অনুষ্ঠান করা হয়েছিল।

ভাষা-শব্দ ও পরিভাষার এই যে নানা রকম নাটকীয়তা। ভিন্ন ভিন্ন সংকট। বহুমুখী অভিমুখ। বহুধারার পলিটিক্সের পলিটিক্যাল এন্ট্রি। এইসব কিছুর পেছনে মৌলিক খেলাটা হচ্ছে—মুসলমানদের বৈশ্বিক উম্মা,হ চেতনায় জাগতে না-দেওয়ার খেলা। যদিও আমাদের একই আল্লাহ, একই নবী, একই কুরআন এবং একই নবীজির সুন্নাহ তারপরেও শতদলে বিভক্ত হই আমরা। কারণ, শয়তান পেছনে লেগে থাকে আমাদের। কিন্তু একবার যদি ‘শয়তানের কৌশল খুবই দুর্বল’—আল্লাহর এই মহান বাণী হৃদয়ে ধারণ করে ‘এক হয়ে নেক হয়ে’ বৈশ্বিক উম্মা,হ চৈতন্যে জাগতে পারি, তাহলে এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধ এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।

ভাষারাজনীতির পেছনের এই অবদমনের রাজনীতি যত তাড়াতাড়ি আমরা ধরতে পারব, ততই দ্রুত আমরা বিপর্যস্ত পৃথিবীর জন্য শান্তির পয়গাম নিয়ে আসতে পারব। ইনসাফের নতুন স্রোতে মানুষের জন্য নির্মাণ করতে পারব জানান্নাতের পথ। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।


সাইফ সিরাজ
কবি ও বিশ্লেষক

পঠিত : ৮৫৭ বার

মন্তব্য: ০