Alapon

"আজ ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ দিবস"




আজ ১৬-ই অক্টোবর। একশত সতেরো বছর পূর্বে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর আজকের এই দিনে বঙ্গভঙ্গের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের মানুষকেও এই অঞ্চলের রাজনীতিকে বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বঙ্গভঙ্গকে সঠিকভাবে বোঝা ও উপলব্ধি করা দরকার। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমেই মুশরিক জমিদারদের মুখ-মুখোশ আলগা হয়ে গিয়েছিলো। যে রবি ঠাকুরকে আজকের বাংলাদেশিরা বন্ধনা করে, সেই রবি ঠাকুর ছিলো এই বঙ্গভঙ্গের হার্ডকোর বিরোধী। আজকে আমরা যে জাতীয় সংগীত গাই, এটাও রবি ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য লেখেন, অথচ এই গান এখন আমাদের স্বাধীন বঙ্গদেশ তথা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বঙ্গভঙ্গের পরেই হিন্দু জমিদাররা রাগ-ক্ষোভ-হতাশায় ও দুঃখে মুষড়ে পড়ে। রাজনৈতিক ময়দানে এক ভয়াবহ অস্থিরতা সৃষ্টি করে এই হিন্দু জমিদারগণই।

মূলত ইংরেজরা তাদের প্রসাশনিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বঙ্গ বিভাগের প্রস্তাব প্রচার করা হয় ১৯০৫ সালের ৫ জুলাই। ১ সেপ্টেম্বর নতুন প্রদেশ গঠনের সরকারি ঘোষণা প্রকাশ করা হয়। ১৯০৫ সালের ১ অক্টোবর ভারত সচিব নতুন প্রদেশের নাম ‘পূর্ববাংলা ও আসাম’ রাখার পরামর্শ দিয়ে বার্তা পাঠান। অবশেষে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে প্রবল উত্তাপ আর উত্তেজনার মধ্যে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ জন্ম লাভ করে। বা বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়।

নতুন প্রদশের প্রথম গভর্নর হলেন আসামের চীফ কমিশনার ব্যামফিল্ড ফুলার। এর মাধ্যমে প্রায় পৌনে দু’শ বছরের ব্যবধানে ঢাকা আবার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।

লেখক গবেষক ও ঐতিহাসিক ড. আব্দুল মান্নান তাঁর “আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা” বইতে লেখেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কলকাতার বর্ণহিন্দুরা দেড়শ’ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাদের ভাগ্য-বিধাতাদের ‘বয়কট’ করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। তারা সবখানে সন্ত্রাসের আগুন ছড়িয়ে দেয়। সে আগুলে পুড়ে ছাই হয় গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জনের রাজনৈতিক ভবিষ্যত। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনাপ্রবাহের অভিঘাতে নিদারুণ মর্ম-যাতনা নিয়ে অপরিণত বয়সে ইনতেকাল করেন ঢাকার নওয়াব সলীমুল্লাহ। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলিম লীগ নামে উপমহাদেশের মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক মঞ্চের প্রতিষ্ঠা ঘটে। মুসলমানদের এই স্বতন্ত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি তাদেরকে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা অর্জনের সংগ্রামে পরিচালিত করে।

ইংরেজ শাসকরা তাদের প্রশাসনিক প্রয়োজনে বঙ্গভঙ্গ করেছিলো। এটিকে তারা দেখেছিল একটি বলিষ্ঠ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তরূপে। পূর্ববাংলার ভাগ্য-বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বঙ্গ বিভাগকে দেখেছিলো তাদের ‘ভাগ্যোদয়ের প্রথম প্রভাত’-রূপে। অন্যদিকে ইংরেজদের সম্পূরক শক্তিরূপে পূর্ণতাপ্রাপ্ত কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা এ ঘটনাকে মূল্যায়ন করেছে তাদের দেড়শ’ বছরে গড়ে তোলা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিভূমির ওপর একটি কঠিন আঘাতরূপে। তাদের ভাষায় এ ঘটনা ছিল ‘এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয়’। বঙ্গভঙ্গের ঘটনায় ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম মধ্যশ্রেণী ছিল আনন্দিত এবং এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রামরত। আর কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণীর ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ছিলো। বঙ্গভঙ্গকে বর্ণহিন্দুরা চিহ্নিত করেছে ‘বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ” রূপে।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা আন্দোলনকে হিন্দু জমিদাররা ‘স্বদেশী আন্দোলন' নামে নামকরণ করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা সর্বপ্রথম বৃটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। নানান জায়গায় সভাসমাবেশ করে তারা বিলাতি পণ্য পোড়ানেরও আহ্বান জানায় এই হিন্দু জমিদারগণ।

বঙ্গভঙ্গ নিয়ে হিন্দু জমিদারদের দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ এরকম নানানমুখী আন্দলনের ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। পুনরায় বঙ্গ আবার একত্রিত হয়। এরই সাথে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।


~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৩৭২ বার

মন্তব্য: ০