Alapon

ধীর-স্থিরতা হলো আল্লাহর পক্ষ হতে আর তাড়াহুড়া হলো শয়তানের পক্ষ হতে...



আমরা অনেকেই নামাজের রুকু, রুকু থেকে উঠা, সিজদা, দুই সিজদার মাঝে বসা ইত্যাদি কাজে তাড়াতাড়ি করি। এদিকেও আপনি স্থির নন। এক কাজের পর আপনার শরীরকে তার সমস্ত অঙ্গকে স্থির ও স্বাভাবিক হতে দেওয়ার পূর্বেই আরেক কাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে আপনি নামাজের ভেতরেও অস্থির। কমপক্ষে তিনবার তাসবিহ পাঠ করা তো দূরে, রুকু বা সিজদায় যেতে যেতে একবার, মাঝে একবার আবার উঠতে না উঠতেই আরেকবার! ব্যস, শেষ! তাও আবার একটি তাসবিহকে সুন্দর মতো, ধীরভাবে, অন্তরের গহীন থেকে, পাঠের সৌন্দর্য না মেনেই!

এইযে এভাবে নামাজ পড়লেন, আসলে আপনার নামাজের কোন জিনিসটা আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী হলো? আল্লাহর নিয়মে নামাজ না পড়ে নিজেদের নিয়মে নামাজ পড়ে আবার আল্লাহপ্রদত্ত খুশু ও প্রশান্তি কিভাবে চান?

আপনার একটি কাজ পরিপূর্ণ করতে লাগবে ২ থেকে ৩ ঘন্টার মতো, আপনি ৪ মিনিট সময় দিয়ে চলে আসলেন, তাহলে আপনার কাজটি পূর্ণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি? না। তাহলে আপনি যে নামাজের সুন্নাহ অনুযায়ী ঠিকঠাক সময় দিচ্ছেন না, তাহলে আপনার এমন দ্রুত ও অস্থির নামাজের অবস্থা কেমন হবে আল্লাহর নিকটে যখন হাশরের ময়দানে হিসেবের সময় আপনার এ অস্থির নামাজকে উপস্থিত করা হবে? এমন তাড়াহুড়ো করা নামাজীদেরকে আল্লাহর রাসূল ﷺ চোর বলেছেন। একে তো আপনার নামাজ হয় নি, খুশু তো পাওয়ার কথাই না, এর ওপর আপনি আরেকটি অপরাধও করে ফেলেছেন, সমাজ যেটি খুবই মারাত্মক অপরাধ হিসেবে দেখে - চুরি। আপনি আল্লাহর দৃষ্টিতেও অপরাধী।
আবু কাতাদা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেছেন,
«أسوأ الناس سرقة الذي يسرق من صلاته، قال يا رسول الله: كيف يسرق صلاته؟، قال: لا يتم ركوعها ولا سجودها».
“চুরির বিবেচনায় সবচেয়ে খারাপ চোর সে, যে তার সালাত থেকে চুরি করে। আবু কাতাদা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, সালাতে কিভাবে চুরি করে? তিনি বললেন, তার রুকু ও সিজদা পূর্ণ করে না (তাড়াহুড়ো করে, দ্রুত করে, দু’আ গুলো ঠিকঠাক উচ্চারণ করে না)। [মুসনাদে আহমাদ, আল-মুস্তাদরাক ১/২২৯]

আপনি কোনো টাকা চুরি করেন নি, কোনো সম্পদ চুরি করেন নি। কিন্তু আল্লাহ এবং তার রাসূল ﷺ যেই নির্দিষ্ট সুন্নাহর নিয়মাবলি দিয়েছেন সেগুলো থেকে কাট-ছাট করেছেন, সেই আদেশগুলো থেকে মানুষের ভয়ে যেমন চোর দ্রুত ও শর্ট-কাট পন্থা খুঁজে তেমনি আপনিও নামাজে দ্রুত করে নামাজকে নিজের মতো করে শর্ট-কাট করে চুরি করে নিয়েছেন এর অংশবিশেষ। সাওয়াব আর প্রশান্তি তো দূরে থাক, এখন আপনি নিজেই চোর হিসেবে সাব্যস্ত। কারণ আপনি আল্লাহর দেওয়া নামাজে রাসূলের সুন্নাহর তোয়াক্কা করেননি, নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছেন আপনার নামাজ।

রাসূলুল্লাহ ﷺ সালাতের প্রতিটি রুকনে এমনভাবে স্থির হতেন যে, তার শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ স্বস্ব স্থানে ফিরে আসত। [সহিহ ইবনে খুযাইমা, ফাতহুল বারিঃ ২/৩০৮]

আপনি ক্রমাগত উঠবস করলে কি শরীর স্থির হয়? নাকি একটা জিনিস স্থির হওয়ার জন্য সময় দিতে হয়? অবশ্যই সময় দিতে হয়। কারণ স্থিরতার একটা নিয়ম আছে, সেই নিয়মে নির্দিষ্ট সময় না দিলে তো আপনি নিয়ম ভঙ্গ করলেন। আপনি নিয়ম (সুন্নাহ) ভঙ্গ করে কিভাবে নিয়মের (সুন্নাহর) ফল (সাওয়াব) চান? বরং এভাবে সুন্নাহ ভঙ্গ করার কারণে তো মূল কাজটিই হলো না, হলেও যেখানে পূর্ণ হওয়ার কথা সেখানে সামান্যই হলো যা আদতে মৌলিক উদ্দেশ্য পূর্ণ করে না, ক্ষেত্রবিশেষে অপূর্ণতার কারণে ক্ষতিও করে।
রাসূল ﷺ নামাজে ভুলকারীকে স্থির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
«لا تتم صلاة أحدكم حتى يفعل ذلك».
“তোমাদের কারো সালাত পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ না সে তা স্থিরতাসহ তা আদায় করবে।” [সুনানে আবু দাউদ: ১/৫৩৬]

আবু আব্দুল্লাহ আশ‘আরি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী ﷺ বলেছেন,
«مثل الذي لا يتمّ ركوعه، وينقر في سجوده، مثل الجائع يأكل التمرة والتمرتين، لا يغنيان عنه شيئا».
“যে তার সালাতের রুকু পূর্ণ করে না, আর সিজদায় গিয়ে ঠোকর মারে, তার উদাহরণ ঐ ক্ষুধার্তের ন্যায় যে একটি ও দু’টি খেজুর খায়, যা তার কোনো কাজে আসে না।” [ইমাম তাবরানি, আল-মুজাম আল-কাবিরঃ ৪/১১৫]

আপনার পূর্ণ ক্ষুধা পেয়েছে অথচ আপনি অল্প একটু খেলেন, তখন আপনার কেমন লাগবে? আপনার ক্ষুধাই তো নিবারণ হলো না, বরং অল্প কিছু নেওয়ার কারণে ক্ষুধা আরো বেশি অনুভব করবেন না? আপনি নামাজেও সুন্নাহ মতো কাজ না করে যখন চুরি করেন, তখন এটা আপনার কাজে দেওয়ার চেয়ে উল্টো বিপদ ডেকে আনে। অথচ আমরা তাড়াতাড়ি করে যেই সময় নিয়ে নামাজ পড়ি এরচেয়ে মাত্র কিছু সময় বেশী দিলেই সবকিছু ঠিকঠাক করে পড়তে পারি। আল্লাহ আমাদের জন্য এমন কিছু দেন নি যা আমাদের সাধ্যের বাইরে। [সূরা বাকারাহঃ ২৮৬]

যে ব্যক্তি সালাতের একেকটা রুকনে রুকনে স্থির হয় না তার সালাতে খুশু অর্জন হয় না। কারণ দ্রুততা সালাতের খুশু নষ্ট করে, শরীরে অস্থিরতা তৈরি করে আর কাকের ঠোকরের মতো সিজদাহ তার সাওয়াব নষ্ট করে।

এবার নিন্মের হাদীসটি দেখুন, “এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ পড়লো। রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন মসজিদের এক পাশে অবস্থান করছিলেন। সে এসে তাঁকে সালাম দিলো। তিনি বলেন: তোমার প্রতিও সালাম, তুমি ফিরে যাও, আবার নামাজ পড়, কেননা তুমি নামাজ পড়ো নি। সে ফিরে গিয়ে নামাজ পড়লো, তারপর এসে নাবী ﷺ কে সালাম দিলো। তিনি বলেন: তোমার প্রতিও সালাম, তুমি ফিরে যাও এবং নামাজ পড়, কেননা তুমি নামাজ পড়ো নি। তৃতীয়বারে সে বললো, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! (আমি এর চেয়ে ভালো করে আর পারি না) আমাকে (শুদ্ধভাবে নামাজ) শিখিয়ে দিন।

তখন নবী ﷺ বলেন: তুমি নামাজ পড়ার ইচ্ছা করলে উত্তমরূপে ওযু করো, তারপর কিবলামুখী হয়ে তাকবীর (তাহরীমা) বলো, এরপর কুর’আনের যে অংশ তোমার কাছে সহজ হয় সেখান থেকে কিরাআত পাঠ করো, তারপর ধীরস্থিরভাবে রুকু করো, অতঃপর রুকু থেকে দাঁড়িয়ে সোজা হও, তারপর ধীরস্থিরভাবে সিজদাহ করো, অতঃপর মাথা তুলে সোজা হয়ে বসো। তুমি তোমার গোটা সালাত এভাবে পড়ো”। [সুনানে ইবনে মাজাহঃ ১০৬০]

অর্থাৎ নামাজে সকল জায়গায় সুন্দর করে করা, প্রত্যেকটি ভিন্ন অবস্থায় যাওয়ার আগে-পরে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন আবশ্যক (ফরজ) হওয়ায় সেগুলো অবশ্যই সেভাবেই করতে হবে। তাহলে নামাজও আদায় হবে আবার খুশু ও প্রশান্তিও আসবে। অথচ এই সাহাবী তাড়াহুড়ো করার কারণে তার নামাজই হয় নি, কারণ ধীর-স্থিরতার ফরজ রুকনগুলো বাদ গিয়েছিলো। এই হাদীসের প্রতিটি বাক্য তীক্ষ্ণভাবে দেখুন, ভাবুন ও আপনার বর্তমান নামাজের সাথে তুলনা করুন।

এবার নিম্নোক্ত বর্ণনাটি দেখুন, সাহাবারাও ঠিক সেটাই মনে করতেন যে, নামাজে তাড়াহুড়ো করা নামাজ বাতিল, না পড়ার শামিল।
حَدَّثَنَا حَفْصُ بْنُ عُمَرَ، قَالَ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ سُلَيْمَانَ، قَالَ سَمِعْتُ زَيْدَ بْنَ وَهْبٍ، قَالَ رَأَى حُذَيْفَةُ رَجُلاً لاَ يُتِمُّ الرُّكُوعَ وَالسُّجُودَ قَالَ مَا صَلَّيْتَ، وَلَوْ مُتَّ مُتَّ عَلَى غَيْرِ الْفِطْرَةِ الَّتِي فَطَرَ اللَّهُ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم‏
যায়িদ ইবনু ওয়াহব (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযাইফা (রাঃ) এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, সে রুকু’ ও সিজদা ঠিকমত আদায় করছে না। তিনি তাকে বললেন, তোমার নামাজ হয় নি। যদি তুমি (এই অবস্থায়) মারা যাও, তাহলে আল্লাহ্ কর্তৃক মুহাম্মদ ﷺ কে প্রদত্ত আদর্শ হতে বিচ্যুত অবস্থায় তুমি মারা যাবে। [সহীহ বুখারী, ফতহুল বারীঃ ২/২৭৪]
সাহাবারা এমন নামাজকে নামাজরূপেই গণ্য করতেন না, অধিকন্তু সেটা দ্বীনের সাথে মশকরা করার দরুণ হিসেবে দেখতো! এর কারণ কি? কারণ, এটা আল্লাহপ্রদত্ত নবীকে দেওয়া সুন্নাহসম্মত নামাজ নয়, আর তাড়াতাড়ি করা শয়তানের কাজ, যা আমাদের দ্বীন নয়।

“ধীর-স্থিরতা হলো আল্লাহর পক্ষ হতে আর তাড়াহুড়া হলো শয়তানের পক্ষ হতে।” [বায়হাকী, সুনানুল কুবরাঃ ১০/১০৪]

এবার চিন্তা করুন আপনি সালাতে সাওয়াব, প্রশান্তি ও স্থিরতা এগুলো সব নেবেন, নাকি পথভ্রষ্ট শয়তানের ধর্মে যাবেন, যেখানে সবই হারানোর।

- মিশারী আল-খারাজ

পঠিত : ১২০৩ বার

মন্তব্য: ০