Alapon

ফররুখ আহমেদ : মজবুত মেরুদণ্ডের এক আদর্শিক কবি




সৈয়দ হাতেম আলী এবং বেগম রওশন আখতার দম্পতির সন্তান আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ফররুখ আহমদ। কবি ফররুখ ১৯৭৪ সালের আজকের এইদিনে মৃত্যু বরণ করেন। মানবতাবাদি কবি ফররুখ জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালের ১০-ই জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে।

তিনি মুসলিম রেনেসাঁ বা ইসলামি রেনেসাঁর কবি হিসেবেও সমধিক পরিচিত। কারণ তাঁর কবিতার মাধ্যমে তিনি বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজেকে পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গিয়েছেন আমৃত্যু । 

অসহায় মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহারে জীবনকে যাপন করা মানুষের করুণ পরিণতি, মানবিকতার সংকট, মানুষে মানুষে সংঘাত আর সংঘর্ষসহ ইত্যাদি সকল অসঙ্গতি-ই কবির সাহিত্য সাধনার অন্যতম প্রতিপাদ্য ছিলো ।

এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে ইসলাম ও ইসলামি মূল্যবোধের জাগরণ যাদের হাত ধরে, নিঃসন্দেহে ফররুখ সেসব অগ্রজদের প্রথম কাতারেরই একজন। দ্বীনি মূল্যবোধ সম্বলিত শব্দসম্ভারকে দিয়ে তিনি কোনো হীনমন্যতা ছাড়াই সাহিত্য সম্ভার গড়ে তুলেছেন। বলতে গেলে সাহিত্যের অঙ্গনে সে সময় তিনি একাই লড়াই চালিয়ে গেছেন।

তিনি নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই প্রাথিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে কোলকাতায় এসে তালতলা মডেল এম.ই স্কুলে ভর্তি হন।

প্রিয় কবি ফররুখ আহমেদের কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে কবি গোলাম মোস্তফার ব্যাপক উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায়। সেটা কীভাবে? তা হলো তিনি তালতলা মডেল এম.ই স্কুল থেকে গিয়ে ভর্তি হন কোলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে । বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

মুসলিম রেনেসাঁর এই কবি সারাজীবন নিজ আদর্শে অটুট থেকেছেন। কোনো অভাব অনটন তাকে আদর্শ থেকে টলাতে পারেনি। তিনি যা লিখেছেন তা-ই জীবনে বাস্তবে রূপায়ণ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

" তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের ওপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া "

ফররুখ আহমেদ ১৯৩৯ সালে কোলকাতার রিপন কলেজ হতে আই.এ পাস করার পরে কোলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে, প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজীতে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু পড়াশুনা আর শেষ করতে পারেন নি। জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে পড়েন তিনি। সে সংগ্রামী জিন্দেগি যাপন করেছেন কবি সারাজীবনই।

কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন একজন নির্ভীক এবং সক্রিয় ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার
“মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা”

গানটি তখন খুব জনপ্রিয় হয়। কিন্তু তবুও কবিকে কথিত সুশীল শ্রেণি যথাযথ মর্যাদা এবং প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেনি। কারণ তিনি একজন পাক্কা মুসলিম ছিলেন। ইসলামি আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মীও ছিলেন। তাঁর ভেতর সব সময় আকুলতা কাজ করতো কীভাবে নিষ্পেষিত নির্যাতিত পিছিয়ে পড়া থেকে মুসলমানদের জাগিয়ে তোলা যায়। তাই তিনি লিখেছেন,

“রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শুন্যতা ঘেরী।”


যাইহোক কবি ফররুখ আহমদকে জীবনের শেষ অবধিই চরম দারিদ্রের সাথে জীবন যাপন করতে হয়েছে। তবুও অর্থের প্রতি তাঁর সৃষ্টি হয়নি অবাঞ্চিত খায়েশ। ক্ষমতার প্রতিও কবির ছিলো না বিন্দুমাত্র মোহও। ক্ষমতাবানদের তোয়াজ করে মেরুদণ্ডহীন প্রাণিদের মতো নিজের শেকড় ভুলে যাননি। তিনি দারিদ্রতাকে অতি সাদরেই নিজের জীবনে গ্রহণ ও বরণ করে নিয়েছেন । অথচ ইচ্ছে করলেই তিনিও তাঁর কবিত্ব প্রতিভা দিয়ে পারতেন ভোগ বিলাসিতায় জীবনকে কানায় কানায় উপভোগ করতে। কিন্তু তিনি ভোগবাদিতাকে ঘৃণা করতেন। কবিতার সাথেই মিলেমিশে একাকার হয়েছিলো তাঁর জীবন।

তিনি ইসলামি আদর্শের একনিষ্ঠ অনুগামী হবার কারণেই ঢাকা বেতার থেকে হারাতে হয় চাকুরি। টাকার অভাবে তাঁর একজন মেধাবী ছেলে চিকিৎসক হওয়া থেকে বা ডাক্তারি পড়া থেকে বঞ্চিত হয়। এতোটাই কষ্টে দিন যাপন করতেন যে, কখনো কখনো তিনি খাবারের অভাবে রোজা রেখে দিন কাটাতেন। এমনকি তাঁর এক মেয়ে চিকিৎসার অভাবে না খেয়েই মারা যান। মৃত্যুর পর দাপনের জন্যেও পাননি উপযুক্ত জায়গাও। শত কষ্ট বা বঞ্চনার পরেও তিনি নিজ আদর্শ পরিত্যাগ করেননি। আল্লাহ এই ক্ষণজন্মা মনীষীকে জান্নাতের সর্বোচ্ছ মাকাম প্রদান করুন এবং তাঁর কাঙ্কেগুলোকেও কবুল করুন। আ-মী-ন!


~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৩০৭ বার

মন্তব্য: ০