Alapon

রাজাধিরাজের দরবারে



আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কথা। মাদায়েন শহরের একটি কূপকে ঘিরে রেখেছে কিছু রাখাল। পশুপালকে পানি পান করাচ্ছে। রিতীমত প্রতিযোগীতা। সবাই যেন চেষ্টা করছে কিভাবে নিজের পশুদের পানি পান করানো যায়, কূপের অদূরে পশুপাল নিয়ে দাড়িয়ে আছে সাফুরা ও সাগূরা। মনে হচ্ছে অভিযাত ঘরের মেয়ে তাঁরা। রাখালদের কাছে যেতে ইতস্তত করছেন।
দূর থেকে আসা একজন আগন্তুক ঘটনাটি লক্ষ্য করলেন। আগন্তুক দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত। কিন্ত মজার ব্যাপার আগন্তুকের কাছে সফরের কোন পাথেয় নেই। মনে হচ্ছে পরনের পোষাকই যেন তাঁর একমাত্র সম্বল। সম্ভবত কোন প্রস্ততি ছাড়াই যাত্রা করেছে।
আগন্তুকের নাম মূসা। হ্যাঁ, তিনি বনী ইসরাইলের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর রাসূল মূসা আলাইহিস সালাম। তিনি তখনো নবুয়ত লাভ করেন নি। সদ্য যুবক। মাদায়েনে পৌঁছার কিছুদিন আগের ঘটনা। মূসা আলাইহিস সালাম দেখলেন শহরের প্রান্তরে দুজন লোক ঝগড়া করছে। একজন তাঁর গোত্র বনী ইসরাইলের অন্য জন শাসক ফিরাউনের গোত্র কিবতীর। মিশরের ফারাও সম্রাটদের ফিরাউন বলা হয়। মূসা আলাইহিস সালাম যখন তাদের কাছে পৌঁছলেন তখন তাঁর গোত্রের লোকটি সাহায্য চাইল। একপর্যায়ে মূসা আলাইহিস সালাম কিবতী লোকটিকে একটি ঘুষি মারলেন। কিন্তু বিষ্ময়কর ভাবে লোকটি মারা গেল। মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন।
না, ঘটনাটি এখানে শেষ নয়। পরদিন মূসা আলাইহিস সালাম জানতে পারলেন তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী এখবর দেন, তিনি শহর দ্রুত শহর ত্যাগের পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী মূসা আলাইহিস সালাম সাথে সাথেই মিসর ত্যাগ করেন। রওনা হন মাদায়েনের দিকে।[১]
মাদায়েন পৌঁছে তিনি কূপ ও মেয়েদের ব্যাপারটি লক্ষ্য করলেন। তিনি ভাবলেন নিশ্চই তাদের কোন সমস্যা হয়েছে, যার কারনে কূপের কাছে যেতে পারছে না। মূসা আলাইহিস সালাম মেয়েদের কাছে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমাদের সমস্যা কি?”
তারা বলল, “আমরা আমাদের পশুদের পানি পান করাতে পারি না, যে পর্যন্ত রাখালরা তাদের পশুদের নিয়ে সরে না যায়। আর আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ।“[২]
মূসা আলাইহিস সালাম বুঝলেন তাদের পরিবারে কাজ করার মত আর কেউ নেই। অতএব তাঁদের সাহায্য প্রয়োজন। তিনি সদ্য যুবক। পানি পান করানো তার জন্য কঠিন কিছু না। পরের ঘটনাটি আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন,
অতঃপর মূসা তাদের পশুদের পানি পান করালেন। অতঃপর তিনি ছায়ার দিকে সরে গেলেন এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছ, আমি তার মুখাপেক্ষী।[৩]
প্রিয় পাঠক খেয়াল করুন মূসা আলাইহিস সালাম মেয়েদের সাহায্য করার পর আল্লাহর সাথে কথা বলার জন্য একান্তে চলে গেলেন। এমন অবস্থার এ তাদের সাহায্য করলেন যখন তিনি একজন পলাতক আসামী, আইনের চোখে অপরাধী আর তাঁর সাথে সম্পদ বলতে শুধুমাত্র পরনের কাপড়। তিনি তো মেয়েদের বলতে পারতেন তাঁর অবস্থার কথা। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। এমনকি কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ধন্যবাদটুকুও নিলেন না। আসলে মেয়েদেরকে কথা বলার কোন সুযোগও তিনি দেন নি।
কেন দেন নি? কারন তিনি কাজ করেছেন শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, ধন্যবাদ পাওয়া তাঁর উদ্দেশ্য নয়! পাঠক দুয়াটি আবার লক্ষ্য করুন, মূসা আলাইহিস সালাম বলছেন,
হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছ, আমি তার মুখাপেক্ষী।
সুবহানাল্লাহ! কী শক্তিশালী দুয়া। এটি ছিল মূসা আলাইহিস সালামের অন্তর থেকে উচ্চারিত একটি কথা, একান্তে চাওয়া বিষয়। তিনি একাকি গাছ তলায় বসে দুয়াটি করছেন, তাঁর পিছনে লোকের ভীড় নেই, সমস্বরে আমীন বলার মত কেউ নেই। তাঁর অবস্থার কথা মনে আছে তো। এখানে ‘অনুগ্রহ করেছ’ অতীত কাল বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ আল্লাহ অতীতে যা দিয়েছেন তার জন্য শুকরিয়া করছেন। দেখুন কী ব্যাতিক্রমি চিন্তা। তিনি শুধু ভাবছেন তাঁর কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
চলুন দেখি নিকট অতীতে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি কি কি পেয়েছেন। প্রথমত তিনি ছিলেন আইনের চোখে একজন অপরাধী।পুলিশ তাঁকে খুজছে মৃত্যদন্ড দেয়ার জন্য। এ অবস্থা থেকে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি মিশর থেকে মাদায়েন পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করেছেন নিরাপদে। খাদ্য-পানীয়হীন অবস্থার মারা যেতে পারতেন। আল্লাহ রক্ষা করেছেন। তৃতীয়ত, তিনি দুজন অসহায় মেয়েকে সাহায্য করতে পেরেছেন। চতুর্থত, বিশ্রামের জন্য তিনি গাছের ছায়া পেয়েছেন।
হ্যাঁ, একজন মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া এ জিনিসগুলিই যথেষ্ঠ। সে জানে আল্লাহ সবসময় তার ভালই চান। তাঁর পরিকল্পনাই মুমিনের জীবনের জন্য সর্বত্তম।
এখানে আরো একটি শিক্ষা আছে। কী শিক্ষা? আপনি যদি কোন ভুল করেই ফেলেন তাহলে আপনাকে মরিয়া হয়ে খুঁজতে হবে কত ভাবে আপনি মানুষকে সাহায্য করতে পারেন। মূসা আলাইহিস সালাম ছিলেন দীর্ঘ পথ ভ্রমনের পর পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত আর পিপাশার্ত। কিন্তু যখন তিনি কোন সাহায্য প্রত্যাশীকে দেখলেন তখন ভাবেন নি তিনি পরিশ্রান্ত, তাঁর বিশ্রাম দরকার। বরং তারা সাহায্য চায় নি, তিনি নিজেই এ সুযোগ করে নিয়েছেন। আবার পরবর্তীতে একাজের জন্য শুকরিয়া করছেন। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে পথ সামনে আসছে তিনি তাই লুফে নিচ্ছেন! সুবহানাল্লাহ!
এবার চলুন পরবর্তী অংশে যাই। আল্লাহ বলছেন,
সুতরাং, বালিকাদ্বয়ের একজন লজ্জাজড়িত পদক্ষেপে তাঁর কাছে আগমন করল। বলল, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যাতে আপনি যে আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময়ে পুরস্কার প্রদান করেন। অতঃপর মূসা যখন তাঁর কাছে গেলেন এবং সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন, তখন তিনি বললেন, ভয় করো না, তুমি জালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছ।[৪]
এখানে সুতরাং শব্দটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। খেয়াল করে দেখুন মূসা আলাইহিস সালাম কারো কাছেই কিছু চান নি। শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে একান্তে দুয়াটি করেছেন, বলেছেন আপনি যা দিয়েছেন আমার জন্য তাই যথেষ্ঠ।
আচ্ছা এর পর কি হল? একটা মেয়ে ফেরত আসল এবং বলল, ‘আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যাতে আপনি যে আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময়ে পুরস্কার প্রদান করেন।‘ মূসা আলাইহিস সালাম কি মেয়েটিকে বললেন যে ‘না, আপু! আমি কাজটি আল্লাহর ওয়াস্তে করেছি, কারো কাছে কিছু চাই না।‘ না , বরং তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিলেন এটি তাঁর দুয়ার জবাব! তাই তিনি অহেতুক কোন লজ্জা পেলেন না, বললেন না, ‘না, না ধন্যবাদ। এসবের কি দরকার ছিল?’ তিনি চলে গেলেন আর বর্ণনা করলেন নিজের অবস্থা। কারন তিনি বুঝে ফেলেছিলেন এটি তাঁর দুয়ার ফলাফল।
অতঃপর সাফূরা ও সাগূরার সাথে তাঁদের পিতা শুয়াইব আলাইহিস সালাম মূসা আলাইহিস সালামের বিয়ে দেন।
এভাবে মূসা আলাইহিস সালামের থাকার ব্যবস্থা হয়, পরবর্তী আট বছরের জন্য চাকরির ব্যবস্থা হয়। এভাবেই শেষ হয় তাঁর যাযাবর জীবন। পরবর্তীতে তিনি মিসরে ফিরে আসেন। আসার পথে নবুয়ত লাভ করেন। তারপর আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে ফিরাউনকে পরাজিত করেন, মিশরের বুক থেকে মুছে ফেলেন মানবরচিত আইন।
তো প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, মূসা আলাইহিস সালামের মত যদি আমরা আল্লাহকে ডাকতে পারি তবে তিনি কখনোই আমাদেরকে ফিরিয়ে দিবেন না। এখান থেকে আমরা শিখলাম বিপদ-আপদ থেকে শুরু করে যে কোন অবস্থার আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হয়, ধৈর্য ধরতে হয়, তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে হয়। হ্যাঁ, আমরা যদি এভাবে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন করি তাহলে কখনোই আমাদের দুয়া ব্যর্থ হবে না ইনশাআল্লাহ।
আসুন আমরা সূরা যুমারের ১০ নম্বর আয়াতটি পড়ে শেষ করি,
“হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়াতে সৎ কাজ করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। নিশ্চই ধৈর্য্যশীলদেরকে তো অফুরন্ত পুরস্কার দেয়া হবে।“


তথ্যসুত্রঃ
1. সূরা কাসাস, ২৮: ১৫-২১
2. সূরা কাসাস, ২৮: ২৩
3. সূরা কাসাস, ২৮: ২৪
4. সূরা কাসাস, ২৮: ২৫

#al_chemy_ii

পঠিত : ১০৪১ বার

মন্তব্য: ০