Alapon

পৃথিবী:এক অনিন্দ্য সৃষ্টি



ভোর ৫টা। শহরতলীর সড়কগুলোতে লোকজন নেই বললেই চলে। সড়ক বাতিগুলো কিছুক্ষন আগে বন্ধ হয়েছে। ফজরের নামাজ পড়ে রাস্তায় হাটতে শুরু করল দুই কিশোর। একজন ইউসুফ আহমেদ, অন্যজন আব্দুল্লাহ যুবায়ের। ইউসুফ দশম শ্রেনি ও যুবায়ের সপ্তম শ্রেনির ছাত্র। দুজন প্রতিবেশি। ফজর নামাজের পর ভোরের পরিবেশে হাটা ও প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্য নিয়ে আলোচনা করা ওদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। হাটতে হাটতে ওরা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের পাশে চলে আসল। জনমানবহীন মাঠটিকে দেখতে অপরূপ লাগছিল। যেন পৃথিবীর বুকে একটি সবুজ কার্পেট!
“ভাইয়া আজকে পৃথিবীর এই সবুজ রূপ সম্পর্কে বল। কীভাবে এল এই অপরূপ পরিবেশ?” যুবায়ের ইউসুফকে প্রশ্ন করল।
“যুবায়ের, পৃথিবীর এই সবুজাভ রূপ এক বিষ্ময়। এর পিছনে আছে পৃথিবীর উপাদান সমূহের উথান-পতনের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষেপে তোমাকে বলার চেষ্টা করব।“
ইউসুফ আবার বলতে শুরু করল, “আমরা আজকে পৃথিবীকে যেভাবে দেখছি, সৃষ্টির শুরুতে এটি মোটেও এমন ছিল না।“
“তাহলে কেমন ছিল এর প্রাথমিক পরিবেশ?” যুবায়েরের প্রশ্ন।
“শুরুতে পৃথিবী ছিল তরল অবস্থায় আর পরিবেশ ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত।“
“পরিবেশ উত্তপ্ত থাকার কারন কী?”
“বলছি, তার আগে বল দেখি, পৃথিবীর কেন্দ্রে কি কি উপাদান আছে?”
“লোহা আর নিকেল।“
“এ দুটোর পাশাপাশি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কেন্দ্রে আর দুটি উপাদান খুঁজে পান। একটি টাংস্টেন-১৮২ অন্যটি হাফনিয়াম-১৮২। হাফনিয়ামের পারমানবিক সংখ্যা ৭২ এবং টাংস্টেনের ৭৪। শুরুর দিকে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এই হাফনিয়াম-১৮২ তেজষ্ক্রিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে টাংস্টেন-১৮২ তে পরিনত হয়েছিল। আর এই পরিবর্তনের সময়কাল ছিল ১০ কোটি বছর!
এবার তোমার প্রশ্নে আসা যাক। ভূতাত্বিকরা সেই সময়ে পৃথিবীর উত্তপ্ত থাকার পিছনে ৩টি সম্ভাব্য কারন শনাক্ত করেছেন।
প্রথমত, তেজষ্ক্রিয় বিক্রিয়া একটি স্বতস্ফুর্ত ও বিপুল পরিমানে তাপ উৎপন্নকারী বিক্রিয়া। এক্ষেত্রে হাফনিয়াম-১৮২ এর তেজষ্ক্রিয়তার কথা বলেছি। এটি একটি কারন।
দ্বিতীয়ত, ভারী ধাতু সমূহের তাপ নিঃসরন করে কেন্দ্রের দিকে যাওয়া।
তৃতীয়ত, পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এসে লেগে যাওয়া উল্কাপিন্ড ও গ্রহানুদের তাপ নিঃসরন।”
“ভারী ধাতু সমুহ কিভাবে কেন্দ্রে গেল? ভারী ধাতু তো ভূপৃষ্ঠেও পাওয়া যায়। আর টাংস্টেন বা হাফনিয়াম তো অনেক হালকা ধাতু। এরা কিভাবে কেন্দ্রে গেল?”
“ভারী ধাতু সমুহ যেমন, লোহা বা নিকেল উত্তপ্ত ও গলিত অবস্থায় কেন্দ্রের দিকে চলে যায়। ঐ সময় পৃথিবী তরল ও তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল। এখন একটু চিন্তা করে দেখ পানি যখন ফুটানো হয় তখন ফুটন্ত পানির নীচের দিকে থাকা জিনিস উপরে চলে আসে আর উপরের জিনিস নীচে চলে যায়। একে পরিচলন বলা হয়। পৃথিবীর ক্ষেত্রেও এমন ঘটেছিল। এজন্যই লোহা বা নিকেলের মত ভারী পদার্থের পাশাপাশি টাংস্টেন বা হাফনিয়ামের মত হালকা পদার্থও কিছু পরিমানে কেন্দ্রে চলে যায়। একইভাবে লোহা বা নিকেলের মত ভারী পদার্থ কিছু পরিমানে ভূপৃষ্ঠে থেকে যায়।”
“ভূপৃষ্ঠ তরল থেকে কঠিন হল কিভাবে আর এখানে পানি কিভাবে আসল?”
“পৃথিবী অনেক উত্তপ্ত থাকলেও তাপ বিকিরন করে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছিল। তুমি পর্যবেক্ষন করে দেখবে মোমবাতি জ্বালালে তা থেকে গলিত মোম কোথাও পড়ে ঠান্ডা হতে থাকলে প্রথমে উপরের অংশ ঠান্ডা ও কঠিন হয়, কিন্ত ভেতরটা ঠিকই উত্তপ্ত ও তরল থাকে। ঠিক এভাবেই ভূপৃষ্ঠ ঠান্ডা ও কঠিন হয়। পৃথিবীর কেন্দ্র এখন উত্তপ্ত ও তরল অবস্থায় আছে!
আর ঐ সময়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2), কার্বন মনো অক্সাইড(CO) ও জলীয়বাষ্পের আধিক্য ছিল। বিজ্ঞানীদের ধারনা, যখন তাপমাত্রা কমে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হয় তখন জলীয়বাষ্প পানিতে পরিনত হয়। আবার কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে সৌরজগৎ থেকে আসা বরফ মিশ্রিত গ্রহানু, ধুমকেতু, উল্কা ইত্যাদির মাধ্যমে পৃথিবীতে পানি এসেছে। এভাবেই তৈরি হয় সমুদ্র।”
“তাহলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান কমে গেল কিভাবে?”
“পৃথিবীতে তাপ ও সূর্যের আলো তো আগে থেকেই ছিল। এরপর যখন পানি এল তখন সালোক সংশ্লেষন উপযোগী উদ্ভিদ ‘সায়ানোব্যাকটেরিয়া’ বা ‘নীল-সবুজ শৈবাল’ এর আবির্ভাব ঘটল। এর প্রমান ৩৫০ কোটি বছর চুনাপাথরের অংশবিশেষ স্রোমাটোলাইটের আবিষ্কার। এসব উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষনের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান হ্রাস পায় বলে বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন। এখানে একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হল উদ্ভিদের শ্বশনের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। কিন্ত সে সময় অক্সিজেন ছিল না। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দুটি মত দিয়েছেন। এক, প্রাথমিক অবস্থায় উদ্ভিদের শ্বশন প্রক্রিয়া এখনকার মত ছিল না। তাই সালোক সংশ্লেষনের মাধ্যমে অক্সিজেন তৈরি হয়। দুই, সূর্যের ছোট তরঙ্গের অতিবেগুনী রশ্মির তেজষ্ক্রিয় শক্তির প্রভাবে জ়লীয়বাষ্প ভেঙ্গে হাইড্রোজেন(H) ও অক্সিজেন(O) তৈরি হয়।
এরপর বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমান বাড়তে বাড়তে ২১% এ গিয়ে পৌঁছল। নাইট্রোজেনের পরিমান হল ৭৮%। অন্যদিকে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান হ্রাস পেয়ে হল ০.০৩%। বর্তমানে এভাবেই বায়ুমন্ডল গঠিত, যা প্রাণির বসবাসের উপোযোগী।”
“তাহলে অন্যান্য গ্রহ সমূহে এমন হল না কেন? শুধু পৃথিবীই কেন এভাবে তৈরি হল?”
“জলীয়বাষ্পের কারনে। পৃথিবীতে জলীয়বাষ্প স্থায়ী হয়েছে, কিন্ত অন্যান্য গ্রহে তা হয় নি।”
“কেন হয়নি?”
“আগেই বলেছি, বিজ্ঞানীদের ধারনা ছোট তরঙ্গের অতিবেগুনী রশ্মির তেজষ্ক্রিয় শক্তির প্রভাবে জলীয়বাষ্প ভেঙ্গে হাইড্রোজেন(H) ও অক্সিজেন(O) তৈরি হয়েছে। সৌরজগতের প্রাথমিক অবস্থায় সূর্যের তীব্রতা ছিল সীমাহীন। এ সময় সূর্য থেকে তৈরি হত সৌরঝড়। এই সৌরঝড় তৈরি করত প্রচন্ড শক্তিশালী এক চৌম্বকক্ষেত্র, যা ছাপিয়ে যেত পুরো সৌরজগৎকে। এই চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে শুক্র এবং মঙ্গল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মত হালকা ভরের মৌল গুলো মহাশূন্যে হারিয়ে ফেলে। ফলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মত অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলের পরিমান বৃদ্ধি পায়। তাই শুক্র এবং মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ৯৬% হল কার্বন ডাই অক্সাইড। এ কারনে সেখানে প্রাণির বসবাসের উপোযোগী পরিবেশ তৈরি হয় নি।”
“পৃথিবী কিভাবে এই দানব চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে থেকে বেঁচে গেল?”
“আসলে পৃথিবীর উপরের আকাশটা পৃথিবীর জন্য ছাদ স্বরূপ। এই ছাদের জন্যই পৃথিবী টিকে আছে!”
“মানে?”
“পৃথিবীর চারদিকে এক প্রচন্ড শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে। এই চৌম্বকক্ষেত্র পুরো বায়ুমন্ডলকে পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপর ধরে রেখেছে। এজন্য সৌরঝড় থেকে সৃষ্ট চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের মত হালকা মৌল গুলো মহাশূন্যে হারিয়ে যায় নি। অন্যান্য গ্রহ, যেমন শুক্র বা মঙ্গলের এরকম শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র নেই। তাই তারা হালকা ভরের মৌল গুলো মহাশূন্যে হারিয়ে ফেলে।”
“এই চৌম্বকক্ষেত্র কিভাবে তৈরি হল?”
“এটা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে তাঁরা ধারনা করেন পৃথিবীর কেন্দ্রে লোহা, নিকেল বা যে চৌম্বক পদার্থ রয়েছে তাপমাত্রার সমতা সাধনের জন্য তাদের মধ্যে ঘূর্ণন প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণনের জন্যই চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়।
এছাড়া আরো কিছু কারনে পৃথিবীতে সজীবতা বিদ্যমান।”
“কী সেগুলো?”
“যেমন মেঘের কথা চিন্তা কর। সুর্যের তাপ ও আলোর প্রখরতা অনেক বেশি। মেঘ এদেরকে প্রতিফলিত করে ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত আসতে বাধা দেয়। ভূমির ১২-১৯ মাইল উচ্চতা জূরে আছে ওজন স্তর, যা সুর্যের অতিবেগুনী রশ্মিকে আটকে দেয়। এই রশ্মি যদি আসতে পারত তাহলে পূর্বের মত জলীয়বাষ্প ও পানি ভেঙ্গে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন তৈরি হত। আবার ভূপৃষ্ঠ হতে ৭২০০০ মাইল উপরে আছে প্লাজমাস্ফেয়ার। এই স্তর সূর্য থেকে আগত ‘কিলার ইলেকট্রন’ কে ভূমিতে আসতে বাধা দেয়। এসবের জন্যই পৃথিবী আজ এত সুন্দর!”
ততক্ষনে পুর্ব আকাশে সূর্য হাসতে শুরু করেছে। “সত্যিই পৃথিবী আল্লাহ তায়ালার এক অনিন্দ্য সৃষ্টি!” যুবায়ের ভাবল।
“জান যুবায়ের, আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রেরিত বই কুরআনে এই কথাগুলো অতি সংক্ষেপে বলেছেন!” ইউসুফ বলল।
“কি বলেছেন? কোথায় বলেছেন?”
“আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ২১ নং আয়াতে বলেছেন,
“তিনিই তো পৃথিবীকে তোমাদের জন্য আরামদায়ক ও আকাশকে এক ধরনের ছাদ হিসেবে গঠন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি পাঠিয়েছেন, তারপর ফল-ফসল উৎপন্ন করেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। সুতরাং তোমরা জেনে শুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে কর না”
(সূরা বাকারা,০২:২১)

#al_chemy_ii

পঠিত : ১১০৭ বার

মন্তব্য: ০