Alapon

||রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর : কৈশোর স্মৃতিতে ভয়াল চিত্র||



ছোট্ট মানুষ। ক্লাস ফোর কী ফাইভ থেকে হাফেজি মাদরাসায় ভর্তি হলাম। মা-বাবা-নানার ইচ্ছে আমাকে হাফেজে কুরআন-আলিম বানাবেন। আমি আলকুরআন হিফয করি। সেদিন মাদরাসা থেকে বের হয়েছি কোনো একটা কারণে। দেখি, সবার ভেতর উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। টিভির সামনে মলিন বদনে চেয়ে আছে। কেউ কেউ হাহাকার করছে। আমি তো ছোট্ট মানুষ। অতো কিছু বুঝে ওঠতেও পারছি না। বাংলাভিশন না এন টিভিতে দেখলাম -একটা মানুষকে কিছু লোক শাপের মতো পিটিয়ে পিটিয়ে মারছে। সাপকেও তো এভাবে মারে না। আবার একটা ছেলেকে দেখলাম মৃত। নির্জীব। দেহের ভেতর রূহ নেই। প্রাণহীন। সেই প্রাণহীন মরা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে কিছু লোক উল্লাস করছে। নৃত্য করছে। আমি তো বিস্ময়ে বিমূঢ়! কীভাবে সম্ভব! এরা কি মানুষ! মানুষ হয়ে মানুষের লাশের ওপর কীভাবে নাচতে পারে! মগজ এতো বিকৃত ক্যান এদের! এরা কারা! এদের বাড়ি কোথায়! এদের বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই? পরে সব না জানলেও অতোটুকুন জানি— ওরা আর কেউ নয়।ওরা আওয়ামি লিগ! ওরা ছাত্র লিগ! ওরা জয় বাংলার লোক! ওরা স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বাবা তথা পিতা মনে করে।এবং তা ডাকেও....

কিছুদিন পরে দেখি, দেয়ালে দেয়ালে, গাছের ডালে ডালে রক্তাক্ত ছবিসমেত পোস্টার। পোস্টারের লেখা— "আওয়ামি জঙ্গীপনার রক্তাক্ত দলীল, আওয়ামি বর্বরতা" ইত্যাদি ইত্যাদি টাইটেলের পোস্টার। পোস্টারের মধ্যে আবার দেখতে সুদর্শন,চেহারায় ভদ্রতার চাপ -এমন কিছু তরুণের রক্তমাখা দেহ। নিথর হয়ে লুটিয়ে পড়া শরীর… বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠেছে। নিচে নাম দেখলাম বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবির।
সেদিন প্রথম সংগঠনটার পুরো নাম জানলাম। এর আগে শুধু শিবিরই জানতাম। তবে তা আতংক হিশেবে, ভয়ংকর হিশেবেই জানতাম তাদের।

নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, এরা এতো ভয়ংকর শুনলাম, আমিও ভয় পাই এদের। কিন্তু এদেরকে লগি বৈঠার আঘাতে, বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে; এরা কিচ্ছু করছে না ক্যান! আবার এদের চেহারায় ও আচরণে তো ভয় পাবার মতো কোনো চিহ্ন নেই। দেখলেই ভালোবাসতে মন চায়! চেহারার মাঝে এক ধরণের নূর আছে মনে হয়। প্রবল মায়াও আছে। এদের কীভাবে মারলো এরা? লগী-বৈঠা দিয়ে কীভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এদের মতো নিষ্পাপ তরুণদের হত্যা করতো পারলো…?
আমি উৎসুক মানুষ। বেশি কথা বলা মানুষ, কিংবা মুড অফ করে বসে থাকা মানুষ; পিচ্চিকাল থেকেই। আমি সেইদিন তথা আটাশে অক্টোবর নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাই। সেই ভিডিওগুলো আবার দেখি। এবার দেখে দেখে আমি ধুমিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করি। এতোটা পাষাণ্ড মানুষ কীভাবে হয়! একটা জীবন্ত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, তাঁকে কী করে চলন্ত অবস্থায় বিষাক্ত সাপের মতো পেটাচ্ছ! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! এমন শক্ত হৃদয়ের অধিকারী কম মানুষই আছেন পৃথিবীতে, যিনি সেই দৃশ্য দেখে কাঁদবেন না বা কাঁদেন নি.....]

আমি খেয়াল করে দেখলাম এখানেই আওয়ামি বর্বরতা থেমে নেই। এতোজন ইসলামি ছাত্র শিবির আর জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীকে হত্যা করেও তাদের মতলববাজী থামেনি। এখন শুরু করছে আরেক মতলববাজী, বর্বরতা! তারা একজন নিহত জামায়াত কর্মীকে আওয়ামি কর্মী প্রমাণের জন্য ( মানে জামায়াত তাদের কর্মী হত্যা করছে -এমনটা প্রমাণের জন্য জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমানকে প্রচার করা হচ্ছে আওয়ামি কর্মী!) ভয়ংকর নোংরা আর ঘৃণিত মিথ্যের আশ্রয় নেয় । একটা লোককে ভাড়া করে আনা হয়েছে হাবিবুর রহমানের বাপ সাজিয়ে! অথচ তার সন্তান ও স্ত্রী সাক্ষ্য দেয় যে, তার বাবা হাবিবুর রহমান জামায়াত কর্মী! যেই লোকটাকে হাবিবুর রহমানের ভাড়াটে বাপ সাজিয়ে আনা হয়েছে, সেদিনের পর থেকে আজ অবধি সেই লোকটার কোনো দেখা মেলেনি! আমার ছোট্ট একটা হৃদয়! সেই ছোট্ট হৃদয়টা আরো খান খান হয়ে যায় এসব নোংরা, বর্বর, পাষণ্ড কাজকারবার দেখে!

সেই আটাশে অক্টোবরে আওয়ামি তান্ডবের শিকার মেধাবী ছাত্র, শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম। মিরপুর বাসা। মিরপুরের ১০ নং ওয়ার্ডের শিবির সভাপতি। গ্রামের বাড়ি আমাদের-ই নোয়াখালী। চাটখিল থানায়। তাঁর সম্পর্কে তাঁর ‘মা’ মুহতারিমা মাহমুদা দেলওয়ার মুন্নি বলেন— “ যা কোন চোখ কোনদিন দেখেনি, কোন কান কোনদিন শোনেনি এবং কোন মানব হৃদয় তা কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। হাদিসের এই বাণী জান্নাতের বিবরণ। কিন্তু আমি অতি কাছ থেকে তাকে (মুজাহিদকে) দেখেছি। আমি দেখেছি জান্নাতি মুজাহিদ পেয়েছি জন্নাতের সুঘ্রান।

এভাবে সকলের সম্পর্কে কিছু কিছু জানতে পেরেছি, তাঁদের রক্তের ওপর গড়ে ওঠা সংগঠনের প্রতি কিছুটা ভালো লাগাও তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু পুরোনো ভয়, আতংক, অপবাদ-অপপ্রচার তো আর নিমিষেই মুছে যায় না। আমারও যায় নি! সে এক ভিন্ন কথা।

এরপর থেকে যখন আইয়ামে জাহিলিয়াত শব্টা শুনতাম, মনে মনে ভাবনায় এসে পড়তো, এবং পড়েও আওয়ামি তাণ্ডবলীলার সচিত্র প্রতিবেদন! হুজুররা যখন আইয়ামে জাহিলিয়াত নিয়ে আলোচনা করতো তখন ভাবতাম আওয়ামিদের কথা-ও বা বুঝি বলছেন তারা। তখন তো আর এতো কিছু জানতাম না, বুঝতাম ন। আবার হায়েনা শব্দটা শুনলেই আওয়ামি লিগের লাশের ওপর নাচানাচির কথা মনে পড়ে।
ক্যানো যেনো আমার কাছে এখন এই যুগে মোটামুটি রকমের বুঝ-জ্ঞান হওয়ার পরেও আইয়ামে জাহিলিয়াতকে আওয়ামি জাহিলিয়াতের চেয়ে খুব বেশি আলাদা মনে হয় না !

আমি এখন মনে করি যে, হুজুররা আইয়ামে জাহিলিয়াতের সাথে সাথে আওয়ামি জাহিলিয়াত নিয়েও কথা বলা খুব বেশি-ই দরকার। কারণ, এখন তো আওয়ামি লিগ প্রতিনিয়ত-ই হায়েনার মতো কাজ করে যায়! মানুষ খুন গুম ধর্ষণ করেই যায়!

আমি কোনোরকমেই বুঝতে পারছিনা— এরাই নাকি ৭১'এ সাধু ছিলো। কিন্তু কীভাবে সম্ভব! আমার তো শতোভাগ মনে হয় একাত্তরে ধর্ষক-খুনি ছিলো তারা, যারা আজকে গুম-খুন, ধর্ষণ-ডাকাতি করে যাচ্ছে! সে যাই হোক, আওয়ামি কর্মীরা সারাদেশজুড়ে এখন যতোই বর্বরতা করুক না ক্যান, আমার এখনো মনে পড়ে সেই দুঃসহ পল্টন! লাশের ওপর নৃত্য! কী এক ভয়ংকর পৈশাচিকতা! জাহিলিয়াতের বর্বরতাকেও যা হার মানায়! ছোট্ট সেই চোখদুটো আমার – যেই দৃশ্য আজো ভোলেনি!

||রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর : কৈশোর স্মৃতিতে ভয়াল চিত্র||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৯১৯ বার

মন্তব্য: ০