Alapon

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও মিখাইল গর্বাচেভ



১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর মিখাইল গর্বাচেভ বিশ্বের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে উন্মুক্ত করেছিলেন। অনেকগুলা সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরেও মহাশক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঠেকাতে পারেননি। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও বড় দেশটির ভাঙনের কারণ হয়েছেন তিনি। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বেশ সমাদৃত হওয়ার পাশাপাশি নোবেল পুরস্কার পান।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজমের পতন হলে তিনি দেশটির প্রথম এবং একমাত্র প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি দেখলেন যে সমগ্র সোভিয়েত ব্যবস্থায় অন্তর্গত দুর্বলতা ও ব্যর্থতা পুরোদস্তুর অনাবৃত হয়ে গেছে এবং বিশেষ করে আর্থিকভাবে সোভিয়েত রাশিয়া প্রায় দেউলিয়ার পর্যায়ে নেমে এসেছে। এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে।

নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে গিয়ে সোভিয়েত অর্থনীতি একরকম মুখ-থুবড়ে পড়েছে, উৎপাদন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম এবং সার্বিক বিপর্যয় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। CPSU-এর নিয়ামক হিসেবে গরবাচভ সোভিয়েত অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে আমেরিকার সাথে চলতে থাকা দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধের আশু অবসান চেয়ে দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রের সম্পর্কে উষ্ণতা আনতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। আর এভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

এরিক হবসবম’র মতে, পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল কট্টরপন্থী ব্রেজনেভ-এর স্থলাভিষিক্ত, গরবাচভের পূর্বসূরি পার্টির সাধারণ সম্পাদক অসুস্থ ইউরি আন্দ্রোপভ (Yuri Andropov ১৯১৪-৮৪)-এর আমলে। সেই পরিবর্তনের প্রবাহে-শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট গতি দান করেছিলেন গর্বাচেভ। সোভিয়েত ব্যবস্থার অস্তিত্বের তাগিদেই। গর্বাচেভ প্রথম সুযোগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতার নীতি অনুসরণ করেন।

ব্রেজনেভ নীতি (Brezhnev Doctrine) অনুসারে উন্নয়নশীল বিশ্বে বিপ্লব-অভ্যুত্থানকে সমর্থন ও সাহায্য করার দরূন সোভিয়েত রাশিয়ার অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সেই শোচনীয় অবস্থা রাশিয়ার ইতিহাসে ‘স্থবিরতার যুগ’ ('Era of stagnation) বা জাসতোই (Zastoi') নামে পরিচিত ছিল। এই কঠিন সময়ে চূড়ান্ত পতনের হাত থেকে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে গর্বাচেভ কালবিলম্ব না করে একগুচ্ছ মৌলিক সংস্কারমূলক কর্মসূচির কথা ষোষণা করেন যা ‘গর্বাচেভ নীতি’ (Gorbachev Doctrine') বা গর্বাচেভের নতুন নীতি’ (New Policy') নামে পরিচিতি পেয়েছিল। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের রূপান্তর ঘটাতে তার এই নীতি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল।

‘গ্লাসনস্ত’ (Glasnost') ও ‘পেরেস্রোইকা’ (Perestroika)। গ্লাসনস্ত- অর্থ মুক্তচিন্তা ও মুক্ত পরিবেশ বা স্বচ্ছতা এবং পেরেস্ত্রইকা- বলতে পুনর্গঠন অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনকে বোঝায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে স্বাধীণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারগুলো প্রবর্তিত হলে সোভিয়েতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যথার্থতা বজায় থাকবে। সেই সাথে সামরিকীকরণের প্রক্রিয়ার সমাপ্তির ঘটবে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মানবিকীকরণ সম্ভব হবে।

১৯৮৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গর্বাচেভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় তার উদ্ভাবিত সংস্কার কর্মসূচি ‘গ্লাসনস্ত’, ‘পেরেস্রোইকা’ প্রস্তাব পেশ করলে তা দল কর্তৃক গৃহীত হয়। এরপর প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে গণমাধ্যমগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ‘প্রভদা’র মতো কমিউনিস্ট মুখপত্রেও ‘ব্রেজনেভ নীতি’র সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। বিদেশী টেলিভিশন সম্প্রচারে অনুমোদন দেওয়া হলে ব্যাপকহারে স্যাটেলাইট টিভি সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করে।

গ্লাসনস্ত নীতি
গ্লাসনস্ত অর্থাৎ মুক্তচিন্তা প্রবর্তন করে গর্বাচেভ চেয়েছিলেন-
১. রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক -সমস্ত ক্ষেত্রেই স্বাধীন ও মুক্ত আলোচনা। অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর এতদিন যেসব বাধা ছিল তার অপসারণ।

২. কমিউনিস্ট দলের একনায়কত্বের অবসানের সাথে সাথে নাগরিকদের ভোটাধিকার ও সমস্ত রাষ্ট্রীয় পদেই নিবার্চিত হওয়ার অধিকার।

৩. সোভিয়েত রাষ্ট্রে অ-কমিউনিস্ট দল গঠনের অধিকার।

৪. কমিউনিস্ট পার্টিকে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তিতে পরিচালনা। দলে বিতর্ককে গুরুত্ব দেওয়; কোনো ক্ষেত্রেই সংক্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো চাপিয়ে না দেওয়া।

পেরেস্ত্রইকা নীতি
গর্বাচেভের পেরেস্ত্রেইকার অর্থাৎ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মূল কথা ছিল-

১. পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচিত করা।

২. কম্যান্ড অর্থনীতির বদলে বাজার অর্থনীতি চালু করা। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি উভয় উৎপাদন ব্যবস্থারই সহাবস্থান।

৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলা।

গর্বাচেভের সংস্কার নীতি অনুমোদনের পর নানা সমস্যার জন্ম হতে শুরু করে। দলের অভ্যন্তরে তীব্র কন্দলের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে সংস্কারবিরোধীরা ইগর লিগাচেভ ও ভি আই ভোরেটনিকভ এর নেতৃত্বে জোট বাধে। দলের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ার জন্য গর্বাচেভকেই তারা দায়ী করেন।

এদিকে গর্বাচেভ বিরোধী প্রচার চালিয়ে ইয়েলৎসিন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কারণ গর্বাচেভ প্রবর্তিত সংস্কারগুলো বিশেষ সফল হয়নি। এই অবস্থায় গর্বাচেভ গণভোটের মাধ্যমে নয়টি প্রজাতন্ত্রকে আরও অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন (ইউনিয়ন চুক্তি ১৯৯১)। যদিও মোলডাভিয়া, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, লটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও কিরঘিজস্তান এই গণভোটে অংশ নেয়নি। নতুন ব্যবস্থায়, গর্বাচেভের হাতে থাকল কেবল অর্থ, প্রতিরক্ষা ও বিদেশ দপ্তর। আগস্টে ইউনিয়ন চুক্তি কার্যকর হয়। জুন মাসে ইয়েলৎসিন বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত শাখা বন্ধ করে দেন।

অন্যদিকে কট্টরপন্থীদের একটি পদক্ষেপ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে আরও ত্বরান্বিত করল। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা (KGB) সম্মিলিতভাবে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। তখন গর্বাচেভ ক্রিমিয়ায়। এই ঘটনায় কমিউনিস্ট পার্টি আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং প্রজাতন্ত্রগুলোর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আনুগত্য কার্যত বিলুপ্ত হয়। মর্মাহত গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।

ইয়েলৎসিন রাশিয়াকে কেন্দ্র করে পূর্বের প্রজাতন্ত্রগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র সমবায় গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম সোভিয়েতের কার্যভার রাশিয়ার পার্লামেন্টের উপর অর্পিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোর ধ্বংস সম্পূর্ণ হয়। এর সাথেই আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন ও পূর্বতন অঙ্গরাজ্যগুলোর রাষ্ট্র সমবায় Commonwealth of Independent States বা CIS (আলমা আটা চুক্তি)।

১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির দিন তিনি পদত্যাগ করেন। গর্বাচেভের পদত্যাগের মধ্য দিয়েই বিশ্বে চার দশক ধরে চলা স্নায়ুদ্ধের সমাপ্তি হয় এবং দীর্ঘ ৭৪ বছরের গৌরবময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।

পঠিত : ৩২৬ বার

মন্তব্য: ০