Alapon

তাকওয়ার জাগরণ নাকি জ্ঞানের জাগরণ : কোনটা বেশি প্রয়োজন?




পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ রব্বুল আলামিন মুমিনদের একটা বিষয়েই খুব জোর দিয়েছেন, একটা বিষয়ই ভালো করে অর্জন করার কথা বলেছেন, সেটা হচ্ছে তাকওয়া। একটা জিনিস না হয়ে মৃত্যু বরণ করতে নিষেধ করেছেন, সেটা হলো মুসলিম হওয়া।

পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে কতো কিছুরই তো প্রয়োজন। শিক্ষা প্রয়োজন, চিকিৎসা প্রয়োজন, নেতা ও নেতৃত্ব প্রয়োজন, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক প্রয়োজন, শিক্ষক, সেবক, গবেষক, আলিম, উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী ইত্যাদি সবকিছুই প্রয়োজন।

কিন্তু আল্লাহ এগুলোর কোনোটাকেই অর্জন করে বা না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না, এটা বলেনি। শুধু একটা বিষয় নিয়েই বলেছেন, সেটা হচ্ছে মুসলিম না হয়ে আল্লাহর ভয় হৃদয় ধারণ না করে মৃত্যু বরণ করতে নিষেধ করেছেন। কুরআনের আয়াতটা খেয়াল করুন, আল্লাহ বলেন,

" হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যেভাবে করা ভয় করা উচিৎ। আর মুসলমান না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না।"
পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম যে আয়াতটি নাজিল হয়েছে, সেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা পড়ার তাকিদ দিয়েছেন ঠিক, কিন্তু কোন ধরনের পড়া পড়তে হবে, কীভাবে পড়তে হবে, সেটাও বলে দিয়েছেন। আল্লাহ রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিখিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি যেন পড়ে তার প্রভুর নামে।

এখন চারদিকে চেয়ে দেখুন, মানুষ আল্লাহকে কতোটুকু ভয় করে? মানুষ কয়জন সত্যিকারের মুসলিম? যারা টুকটাক ইসলাম প্র‍্যাক্টিস করে, তারা কতোটুকু তাকওয়া হৃদয়ে ধারণ করে?

আল্লাহকে ভালোবেসে, তার নিষেধ করা কাজগুলো থেকে নিজেকে ফিরিয়ে রাখে কয়জন?

যারা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা কি আদৌ দ্বিধাহীনভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে? তাকওয়াকে প্রাধান্য দেয়? নাকি ফাঁক-ফোকর খুঁজে বেড়ায়?

অবশ্যই দেখবেন বেশিরভাগ লোকজনই ফাঁক ফোকর খুঁজে বের করে। দেখবেন মানুষ সুদ-ঘুস খায়, কিন্তু এই সুদ-ঘুসকে কীভাবে জায়েজ করা যায় সেটার মাসায়েল খোঁজে। আবার মেয়েদের দিকে যদি তাকান, দেখবেন তারা কীভাবে পর্দার ভেতর থেকে বের হওয়া যায়, সেইটার ফাঁক ফোকর খুঁজে, কীভাবে নিকাব না দিয়ে থাকা যায়, জিলবাব বা বোরকা না পরে চলা যায়, কীভাবে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে জীবন চালানো যায়, কীভাবে ছেলে বন্ধুদের সাথে রাস্তাঘাটে, ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করা যায়, সেটার অজুহাত খোঁজে, এরজন্য কোথাও কোনো ইসলামিক স্কলার কেউ এই মতের পক্ষে একটা ফতোয়া দিয়েছেন কিনা সেটা অনুসদ্ধান করে। বাসা থেকে মুখ ঢাকা অবস্থায় বা নিকাব করা অবস্থায় বের হয় ঠিকই, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে, গাড়িতে গিয়ে টুপ করে নিকাবটাকে সরিয়ে ফেলে। হেসেখেলেই অযথা অপ্রয়োজনীয় কোনো দরকার ছাড়া, কোনো কারণ ছাড়াই ছেলেদের সাথে আড্ডা মারে। নিষ্প্রয়োজনীয় কথা বলে।

আবার ছেলেদের দিকে দেখুন, তারাও কীভাবে গোড়ালির নিচে প্যান্ট পরা যায়, কীভাবে দাড়ি না রেখে থাকা যায়, কীভাবে সুদী ব্যাংকে চাকরিটা জায়েজ করা যায়, সেই চিন্তায় মশগুল থাকে। স্বয়ং রাসুলই (স.) প্রয়োজনীয় কথা বলেছেন নারীদের সাথে, এর বাহিরে অতিরিক্ত কথা বলেননি। কিন্তু এরা জ্ঞানের নাম করে, নোট শীট দেওয়া নেওয়ার নাম করে অযথাই মেয়েদের সাথে আড্ডা দেয়, গল্প করে, রেস্টুরেন্টে বসে বসে নিরিবিলি সময় কাটায়, ইসলামি বইমেলার মতো জায়গায় মেয়ে নিয়ে ঘোরাফেরা করে, অযথা বিনা কারণে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করতে করতে দিন কাটায়।

এগুলো করতে করতে এক সময় তার কাছে আলেমদের মাসায়লা বা ফতোয়া বিরক্তিকর লাগে। দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা কঠিন মনে হয়। আর তখন বিশ্বের কোন চিপা গলিতে কোন শায়খ কী বলেছেন সেটা খোঁযে, আর তাদের করা এসব দ্বীন এবং দ্বীনি চেতনা বহির্ভূত কাজকে জাস্টিফাই করে।

আবার মিউজিক, বাদ্যযন্ত্র, ঢোল-তবলার দিকে দেখুন, এরা নিজের নফসের গোলামী করতে করতে কত দূর চলে যায় যে, সেটার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা খুঁজে বের করে। যেই মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট ভাঙ্গার জন্য আল্লাহর রাসুল এসেছেন, সেটাকে জায়েজ করার জন্য নানান যুক্তি খোঁজে। কোনো জায়গায় কোনো একজন আলেম এটার পক্ষে বলছে কিনা সেটা দেখে। হাজারো ওলামাদের মতামত বা জমহুর মতকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একজন বা সামান্য কিছু আলেমের মতকে অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। অথচ তাকওয়ার দাবি হলো কেবল সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকেও দূরে থাকা।

এখন যে বা যারা জ্ঞানের জাগরণ চাবে, তাদের জ্ঞানের জাগরণ বা ইসলামের পূনর্জাগরণে তো মানুষের আরো ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিম হবার কথা। আল্লাহ ভীতির কাজকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা। তাহাজ্জুদ গুজার হবার কথা। কিন্তু হচ্ছে কী? নাকি আগে যা ছিলো এখন সেটাও হারিয়ে ফেলেছে! আপনি আপনার আশেপাশে তাকালে এই বিষয়টা অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারবেন।

আসলে মানুষ এখন অনেক জানে, অনেক জ্ঞানের চর্চা করে। কিন্তু তাকওয়ার চর্চা করে না। আল্লাহ ভীতিকে ধারণ করে না। কিন্তু অপরদিকে আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদের দিকে তাকান, তারা অধিকাংশই খুব বেশি পড়াশোনা জানতো না। যারা জানতেন, তারাও একটা মাত্র সোর্স থেকেই জ্ঞান অর্জন করেছেন- সেটা হচ্ছে আল-কুরআন। কিন্তু দেখুন, তাঁদের হৃদয় আল্লাহ ভীতিতে কীরূপ মশগুল ছিলো! তাঁদের মধ্যে যারা বেশি শিক্ষিত বা বেশি জ্ঞানী ছিলো, তারাই সবচেয়ে বেশি আল্লাহ ভীতির অধিকারী ছিলো। হারাম কাজ থেকে তো বেঁচে থাকতোই, বরঞ্চ হারাম হবার সন্দেহ আছে, এমন কাজ থেকেও দূরে সরে থাকতো। অথচ, আজকে আমরা জ্ঞানের চর্চা করি, জ্ঞানের জাগরণ করি, আবার ঠিকই দ্বীনি চেতনা বহির্ভূত কাজগুলোও করে যাই। ইয়া বড় বড় বই পড়ি ঠিকই, কিন্তু নিজেকে খাঁটি মুসলমানের কাতারে নেওয়ার চেষ্টা করিনা। বই পড়ি ঠিকই, কিন্তু ফাহেশা কথা, বাজে কাজ বর্জন করিনা। অন্যের উপর জুলুমও করি। মিথ্যা কথাও বলি। কারো কোন বক্তব্য আমাদের ইনস্টিটিউট বা আমাদের সংগঠন অথবা আমাদের পছন্দের মানুষের কর্মপন্থার বিরুদ্ধে গেলে, উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াই। প্রপাগাণ্ডা রটাই। জ্ঞানার্জন করি, জ্ঞানের জাগরণ ঘটাই, কিন্তু সেই জ্ঞানের বাস্তব কোনো প্রতিফলন জীবনের মধ্যে নেই। অপর দিকে সাহাবায়ে আজমাইন মাত্র একটা আয়াত পড়তেন, আর সেটারই বাস্তব সাক্ষ্য হয়ে যেতেন তাঁরা। যার কারণেই তাদের দ্বারা ইসলামের বিজয় সাধিত হয়েছে।

সুতরাং ইসলামের বিজয়ের জন্য, খেলাফত কায়েমের জন্য জ্ঞানবাজীর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু তাকওয়ার জাগরণ। তাকওয়াপূর্ণ জীবনের অধিকারী শুধু দু'একটা আরবি পরিভাষা ইউজ করলেই হওয়া যায় না, আবার অনেক বইও পড়া লাগে না। শুধু কুরআনিক মানদণ্ড অনুযায়ী পড়াশোনা করা আর সাহাবিদের জীবনী সামনে রাখাটাই যথেষ্ট!

মুসলমানদের জন্য এখন হাবিজাবি যতো জাগরণ আছে, সেসব জাগরণের তুলনায় এমনকি জ্ঞানের জাগরণের তুলনায়ও বেশি প্রয়োজন তাকওয়ার জাগরণই।

তাকওয়া থাকলে, সত্যিকারের মুসলিম হবার প্রেরণা হৃদয়ে রাখলে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঠিকই দূর হয়ে যাবে। ঠিকই আল্লাহ এমন মানুষদের দ্বারাই ইসলামকে বিজয়ী করবেন। আর ইসলাম সামগ্রিকভাবে বিজয়ী না হলেও ব্যক্তি তার পরকালীন জীবনে সফল হবে।

আজকের দুনিয়ায় মুসলমানদের জ্ঞান আছে, সম্পদ আছে, অর্থবিত্ত সবই আছে, নেই শুধু তাকওয়া। সে বই লেখতে চায়, গবেষণা করতে চায়, চিন্তক হতে চায়, কিন্তু একজন মুসলিম হয়ে মৃত্যু বরণ করতে চায় না। এমন মুসলিম হতে চায় না, যে মুসলিম পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে তার রবের কাছে।

এই যে মুসলমানদের এমন সংকট, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে তাকওয়ার জাগরণের জন্যই কাজ করা উচিৎ। এরজন্যই তালিম তারবিয়াত চালানো ও সাহিত্য সাধনা করা উচিৎ। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃত সাধনা কিংবা জ্ঞানের জাগরণের মাধ্যমে যদি উৎকৃষ্ট আমল থেকে, তাকওয়াপূর্ণ অবস্থান থেকে দূরে সরে যায় মানুষ, মানুষ আদর্শ মুসলিমদের উস্তাদ হিসেবে গ্রহণ না করে যদি জিন্স পরিহিতা আলিম বিদ্বেষী কোনো নারীকে উস্তাযা, বানায়; তাহলে সেই ধরনের জ্ঞান অর্জন কিংবা সেই ধরনের জ্ঞানের জাগরণ কিছুরই প্রয়োজন নেই।

~ রোহান আব্দুল্লাহ

পঠিত : ৩০৬ বার

মন্তব্য: ০