Alapon

|| ইসলামি সংস্কৃতি একজন বাঙালি মুসলিম তরুণের ভাবনা || .



শিরোনামে যে শব্দ ও বিন্যাসটি বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা গভীর মর্মবাহী। এতে চিন্তার সৌন্দর্য আছে, আছে বুদ্ধির দীপ্তিও। তরুণকে এখানে যদিও চিন্তাকর্তা হিসেবে হাজির করা হয়েছে, তবু সরল বিন্যাসে এর মূল সংবাদটি হবে এমন—ইসলামি সংস্কৃতি ও বাঙালি সংস্কৃতি: দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের রূপরেখা।

তা ইসলামি সংস্কৃতি হোক বা বাঙালি, সমীকরণে প্রবেশ করতে হলে সংস্কৃতি জিনিসটা আদপে কী, তার সমাধান করা একান্ত দরকার। আর না হয় সামনে আগানো বলতে গেলে অসম্ভবই। এবং সে লক্ষ্য নিয়ে আমরা যখন সংস্কৃতি শব্দটির কাছে যাই, একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দেখি সেখানে আরও একটি শব্দ ওত পেতে বসে আছে—সভ্যতা। এ শব্দ দুটো পরস্পর এত বেশি ওতপ্রোত এবং এত বেশি মিলেমিশে আমাদের সামষ্টি জীবনপ্রবাহে এমনভাবে লীন হয়ে আছে, প্রায়শই আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংজ্ঞা নির্ধারণে দার্শনিকগণের মধ্যে যে বিস্তর মত পার্থক্য রয়েছে, অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি এই একাত্মতাও বোধ করি অনেকাংশে দায়ী। এ জন্য নিরেট সংজ্ঞার দিকে না গিয়ে আমরা বরং ‍খানিকটা ব্যাখ্যার আশ্রয়ে একটু সহজভাবে বুঝার চেষ্টা করি।

২.
সংস্কৃতি শব্দটার ইংরেজি রূপ হলো কালচার। আরবিতে একে বলা হয় সাকাফাহ। শাব্দিক অর্থে কালচার মানে জমিনকে সাফসুতরো করে, হালচাষ ও কর্ষণ করে চাষবাসের উপযোগী করে তোলা। তেমনি পারিভাষিক অর্থে সংস্কৃতি মানে মানুষের মনমস্তিষ্ক চিন্তা আচরণ অভ্যাস রীতিনীতি বিশ্বাস ও আচারের পরিশীলিত যৌথ রূপ। বঙ্কিমচন্দ্র এ জন্যই বলেছেন—উদ্ভিদের পক্ষে কর্ষণ যাহা, মানুষের পক্ষে স্বীয় বৃত্তিগুলির অনুশীলন তাহাই, এ জন্য ইংরেজিতে উভয়ের নাম কালচার। সংস্কৃতি বিষয়টিকে এভাবে মানুষের হৃদয় ও ভাবগত এবং সম্পূর্ণত অন্তর্লোকের বিষয়সমূহে সীমাবদ্ধ করার এ প্রচেষ্টা শুধু বঙ্কিম নয়, রবীন্দ্রনাথসহ আরও অনেকের মধ্যে ছিল। খুব সম্ভব এ থেকেই জনপরিসরে সংস্কৃতির একটি পপুলার অর্থ দাঁড়িয়েছে এই যা শুধু সাহিত্য শিল্প দর্শন সামাজিক আচার নীতি, কাব্য নৃত্য সংগীত অংকন ও কলাধর্মী বিষয়াশয়ে সীমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এমন করে ব্যাখ্যা করার সমস্যা হলো এর দ্বারা আমাদের সমাজবদ্ধ জীবনাচারের অনেক কিছু সংস্কৃতির সীমানা থেকে খারিজ হয়ে পড়ে। থেকে যায় অচিহ্নিত ও ব্যাখ্যাহীন। অথচ আমরা যখন সংস্কৃতির পক্ষে যু,দ্ধ করতে চাই, সাংস্কৃতিক আ,গ্রাসনের কথা বলি, তখন এর ভিতরে শুধু ভাবগত বিষয়গুলোই অন্তর্ভুক্ত নয়; আপাত অচিহ্নিত সে বিষয়গুলোকেও শামিল রাখি। এর সুন্দর একটি সমাধান হতে পারে এই—আমরা সংস্কৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলব।

এক হলো অন্তর্লোকের বিষয়, যা ভাবগত। একে আমরা বলতে পারি আত্মিক সংস্কৃতি। ‍দ্বিতীয়টি হলো বৈষয়িক। তবে মনে রাখতে হবে এ বৈষয়িক নিরেট ও স্থূলভাবে বস্তুগত নয়। অর্থাৎ এমন নয় যে, এখানে হৃদয় ও ভাবের কোনো সংমিশ্রণ নেই। এ বৈষয়িকও বরং ভাবেরই প্রেক্ষিতে। কারণ, আত্মা ও বস্তু একে অপরের হাত ধরে আছে ঘনিষ্ঠ হয়ে। ফলে কোনো আত্মিক সংস্কৃতি সৃষ্টি হতে পারে না বস্তু নিরপেক্ষভাবে, তেমনি বৈষয়িক কোনো কর্মও সাধিত হতে পারে না হৃদয়ের কল্পনা বাদে। ফলে, সংস্কৃতি—তা আত্মিকই হোক বা বৈষয়িক—এর মূলের মধ্যেই রয়েছে হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা।

৩.
এখান থেকে আমরা চাইব সংস্কৃতি ও সভ্যতার তুলনামূলক ব্যাখ্যার ভিতর দিয়ে সংস্কৃতির এমন একটি ব্যাখ্যা তুলে আনতে যা আমাদের সামগ্রিক জীবনপ্রবাহের সর্বদিকে প্লাবিত হয়। তার আগে শুধু এটুকু বলা যাক—সভ্যতা ও সংস্কৃতি কোনোটিই নিঃসঙ্গ এক ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন অনেক ব্যক্তির দ্বারা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এর জন্য অনেক মানুষের সংঘবদ্ধতা অনিবার্য। সভ্যতার জন্য প্রয়োজন বিপুল এক জনগোষ্ঠী, যাকে আমরা ন্যাশন বা জাতি বলতে পারি এবং সংস্কৃতির জন্য এত বিপুল মানুষের প্রয়োজন না হলেও নিদেনপক্ষে একটি পরিবারে বসবাস করা পাঁচ-দশজন মানুষ হলেও লাগে। তখন আমরা একে কোনো বৃহত্তর সামাজিক সংস্কৃতি বলতে না পারলেও অন্তত পারিবারিক সংস্কৃতি বলতে পারব। কিন্তু উভয়ের জন্য সংঘ ও সমাজবদ্ধতাটা লাগবেই।

৪.
সভ্যতা জিনিসটা কী? সূক্ষ্ম বিতর্কে না ঢুকে বিষয়টিকে আমরা যদি একটু বড় করে দেখি, তাহলে সভ্যতা মানে এই পৃথিবীতে তুলনামূলক ভালোভাবে বেঁচে থাকবার জন্য মানুষের সামগ্রিক জীবনপ্রণালি, যেগুলো মানুষ চিন্তা ও বুদ্ধি দিয়ে গড়ে তোলে এবং সামগ্রিক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে ক্রমশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে অনেক বিষয় আছে যা বিশ্বজুড়ে সকল মানুষের জীবনেই পালিত হয়। যেমন : বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ, লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড়ের ব্যবহার, ব্যবসাবাণিজ্য, কলকারখানা, চাষাবাদ, বাহন, সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস, লেনদেন, বিয়েশাদি ইত্যাদি। পৃথিবীজুড়ে পরিব্যাপ্ত এ বিষয়গুলোকে আমরা বলতে পারি বৃহত্তর মানবসভ্যতা। এর ভিতর থেকে জাতিগত সভ্যতা গড়ে ওঠে কীভাবে? গড়ে ওঠে ব্যতিক্রম, নতুন সংযুক্তি, পুরনোর উল্লেখযোগ্য সংস্কার, পরিমার্জন—সব মিলিয়ে যে ব্যতিক্রম ও অতিরিক্তটুকু, এর ভিত্তিতে।

এর কারণেই আমরা বলতে পারি ভারতীয় সভ্যতা, চীনা সভ্যতা, আমেরিকান বা ইউরোপীয়ান সভ্যতা কিংবা মুসলিম সভ্যতা। এই ব্যতিক্রমটুকু নিয়েই সভ্যতাগুলো পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। বৃহত্তর মানবসভ্যতা তো বিশ্বের পাটাতনজুড়ে আছেই, জাতিগত সভ্যতাগুলোর প্রবাহও সবসময় বহির্মুখী। সে আপন জাতির মধ্যে সীমিত না থেকে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ার প্রেরণা সত্তাগতভাবেই লালন করে। সত্তাগত এই প্রেরণাটিকে বোধ করি পৃথিবীর মানুষের অভাব, জীবনধারণে তুলনামূলক বেশি সুবিধার অন্বেষা, নতুনকে গ্রহণ করার আনন্দ ও কৌতূহল দিয়ে ব্যক্ত করা যায়। এর মধ্যে ছোট হোক বা বড় কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ছাড়া একটি সভ্যতা গড়ে ওঠা অনেকটা অসম্ভব। ফলে, সে ক্ষমতা যখন বিজয়ী হয়, তখন বিজয়ী সভ্যতাটিও প্রবল ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। এভাবে জাতিগত সভ্যতাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও লেনদেন স্থাপিত, উন্নত ও সংস্থিত হয় এবং আগ্রাসনের কালে বিজয়ী সভ্যতার সামনে দুর্বল, ভঙ্গুর ও ক্লিশে হতে শুরু করে পরাজিত সভ্যতাগুলো।

এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন। সভ্যতা বিষয়টিকে আলোচনা করবার সময় প্রায় সকলেই এর সাথে শুভ, কল্যাণময়তা ও উন্নতির আবহ যুক্ত করে দেন। এবং অকল্যাণজনক বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেন অসভ্যতা বলে। অর্থাৎ সভ্যতা মানেই উন্নতি, সুবিধা ও মঙ্গলের পানে মানুষের অগ্রযাত্রা। কিন্তু মুশকিল হলো শুভ ও কল্যাণময়তা নির্দিষ্ট করবে কে?

ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন বা সভ্যতার দ্বন্দ্বগুলোর পিনপয়েন্টটিই হলো এটি। প্রত্যেকে ন্যায্যতা ও অন্যায্যতা, শুভ ও অশুভ বিচার করে তার চিন্তা দর্শন ‍ও বিশ্বাসের ভূমিতে দাঁড়িয়ে। ফলে, এ দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান নেই। আমি যখন কোনো বিষয়কে সভ্যতা বলে অপর কোনো বিষয়কে অসভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করছি, তা কি সর্বজনমান্য? শুধু এটুকু যে, বিশ্বজুড়ে কিছু বিষয় আছে, যেগুলোতে মানুষের কমন রুচি ও বিবেক একমত। যেমন, মিথ্যা কথা বলা, কারও সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া, শিশুদেরকে হত্যা করা বা খাদ্য নষ্ট করা—এ বিষয়গুলো সবার নিকটই খারাপ ও অশুভ বলে বিবেচিত। এবং এসবের বিপরীতটা শুভ ও কল্যাণ। কিন্তু এই কমন বিষয়গুলোর বাইরে মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ও তো অনেক। এই সমস্যার সুন্দর সমাধান হতে পারে এই—সভ্যতার পরিচয় নির্ধারণে আমরা শুভ ও অশুভের বিচারে না গিয়ে একে নিরপেক্ষ একটি জায়গা থেকে বিচার করব। এরপর প্রত্যেকে যে যার জায়গা থেকে একে ভাগ করবে দুইভাবে: ভালো সভ্যতা ও খারাপ সভ্যতা। কমন বিষয়গুলোর বাইরে ভালো ও খারাপের নিক্তি যার যার। পৃথিবীর বাস্তবতাও মূলত তাই। শুভ ধরে নিয়ে সভ্যতার একচেটিয়া কোনো সংজ্ঞা যেমন হতে পারে না, তেমনি খারাপ বোঝানের জন্য অসভ্যতারও মতপার্থক্যহীন কোনো সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।

৫.
প্রশ্ন হলো—এর ভিতরে সংস্কৃতির জায়গাটি কোথায়?

সংস্কৃতিকে আমরা একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের সাথে তূলনা করতে পারি। দুজন মানুষের ব্যক্তিত্ব দুরকম হয় কী করে? সে যে কর্মগুলো সম্পাদন করে, যে গুনাবলী ধারণ করে, যেভাবে নিজেকে প্রকাশিত করে এবং জীবন ধারণে যে ভঙ্গি ও কোশল প্রয়োগ করে, মোলিকভাবে এই ব্যাপারগুলো পৃথিবীতে আরো অনেক মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। সে হিসেবে এসব তার পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্ব হতে পারে না। তাহলে ব্যক্তিত্ব হয়টা কী? হয় এ বিষয়গুলো তার মধ্যে যে পরিমাণ ও আঙ্গিকে আছে, যে ভঙ্গি ও কোশলে প্রকাশিত হয়, তার সত্তার মধ্যে যে ব্যঞ্জনা ও অভিব্যক্তি সৃষ্টি করে, এটুকু তার নিজস্ব। হুবহু এর মতো পৃথিবীতে আর কেউ নাই। এই ব্যতিক্রমটুকুই তার ব্যক্তিত্ব। তেমনি পৃথিবীতে সবগুলো সমাজ সভ্যতা ও জীবনপ্রণালীতে বসবাস করে তার জীবনপ্রবাহের মধ্যে যে নিজস্বতাটুকু লালন করে, যেগুলোর মাধ্যমে সে অন্য সকল জাতি থেকে আলাদা হয়ে উঠে, এটুকু তার সংস্কৃতি। সে হিসেবে সংস্কৃতিকে আমরা বলতে পারি সামাজিক আমিত্ব। ফলে বসবাসের জন্য ঘর নির্মান সভ্যতার অংশ হলেও এর নির্মাণশৈলী, ধরণ ও আকৃতিটুকু সংস্কৃতির বিষয়। লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড়ের ব্যবহার সভ্যতা, কিন্তু এর আঙ্গিক, পরিমাণ ও প্রকৃতিকে বলতে হবে সংস্কৃতি। অতিথিকে সমাদর করা সভ্যতার পাঠ, কিন্তু সমাদরের পদ্ধতি ও উপাদান সংস্কৃতির দান। এভাবে বিচার করলে আমরা সংস্কৃতির সুন্দর একটি কল্পনার হদিস পেয়ে যাব।

এভাবে সামাজিক আমিত্ব বলে আমরা যদি সংস্কৃতির বিষয়টিকে ‍সমাজ জীবনের সর্বদিকে প্রবাহিত করে দিই, তাহলেই তা পূর্ণতর হয়ে উঠে আমাদের সাংস্কৃতিক সকল কিছুকে ধারণ করতে সক্ষম হবে।

এ থেকে আমরা সংস্কৃতির উপাদান সম্পর্কেও মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করতে পারি। অর্থাৎ, তা নির্দিষ্ট কোন সংখ্যায় সীমিত নয়। তারপরও যে বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে একটি জাতির সংস্কৃতি সমুজ্জ্বল ও চিহ্নিত হয়ে উঠে,যেমন,ধর্ম,উপাসনা,ভাষা,সামাজিক আচার,জীবনযাপনে বিভিন্ন প্রচলন,ইশারা,প্রতীক,সাহিত্য,শিল্প,কাব্য,নৃত্য,পোষাক,সম্ভাষণরীতিনীতি,আইন ও শালিসপদ্ধতি, বিভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধ, দিবস ও উদযাপনপদ্ধতি, দর্শন ইত্যাদি। শুরুতে আমরা সংস্কৃতির যে দুটি ভাগের কথা বলেছিলাম—আত্মিক ও বৈষয়িক,এ ভাগ সৃষ্টি হয়েছে এখান থেকেই, সংস্কৃতির উপাদানের চরিত্র ও প্রবণতার দিক লক্ষ্য করে। শুধু তাই নয়, সংস্কৃতির কোন কোন উপাদান ও পরিসরকে বোল্ড করে দেখানোর জন্য আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত করে বলা হয় পলিটিকাল কালচার, ধর্মীয় সংস্কৃতি, ভাষিক সংস্কৃতি ইত্যাদি।

সভ্যতার মত সংস্কৃতি বিষয়টিকেও সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও উৎকর্ষতার সাথে মিলিয়ে কল্পনা করা হয়। এখানেও সে একই প্রশ্ন উঠে—শুভ ও কল্যাণকর নাকি অশুভ ও অকল্যাণকর তা মাপব কী দিয়ে? কমন বিবেচনাবোধ দিয়ে এবং অবশিষ্টটুকু যার যার ধর্ম, বিশ্বাস, চিন্তা ও দর্শন দিয়ে। সে জায়গায় দাঁড়িয়েই সে বুঝে নিবে কোনটা সংস্কৃতি ও কোনটা অপসংস্কৃতি। কে কালচার্ড, আর কে আনকালচার্ড।

৬.
আমরা যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালি সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ কথাটির মর্ম সহজেই হৃদয়াঙ্গম করা সহজ। বাকি থাকে আমাদের সংস্কৃতি কী কী এর একটা তালিকা উপস্থাপন করা। সঙ্গত কারণেই এ সামান্য পরিসরে তা সম্ভবও নয়। আমি যাচ্ছিও না সেদিকে। বরং বলি অন্য একটি দিক: বাংলাদেশে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে জাতীয় কোন সংস্কৃতির অস্তিত্ব নেই। কারণ, জাতিয় সংস্কৃতি মানে যা সমাজের সর্বত্র প্রচারিত। কিন্তু এ দেশের সমাজ হিন্দু ও মুসলিম দুইটি আলাদা সমাজে নিজস্ব সংস্কৃতির ভিতর বসবাস করছে শত শত বছর যাবত। এখানে কমন বিষয় আছে সত্য এবং মুসলিম প্রধান অঞ্চল হওয়ার কারণে হিন্দু সমাজ ভাষা ও অন্যান্য অনেক দিক দিয়ে মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তবু একচেটিয়াভাবে বাঙালি সংস্কৃতি বলে যে অখণ্ড সংস্কৃতির দাবি করা হয়, তা সত্য নয়। একচেটিয়া অখণ্ড সংস্কৃতি না থাকলেও সামগ্রিকভাবে প্রবল একটি সংস্কৃতি আছে। আর তা হলো মুসলিম সংস্কৃতি। কী ভাষায়, কী আচার ও সমাজ পরিসরে। কিন্তু দুঃখজনক হলো রাষ্ট্রিয় মান ভাষার ক্ষেত্রে যেমন প্রমিতকে গ্রহণ করে এ সমাজের ভাষিক সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা হয়েছে, তেমনি অন্যান্য দিক দিয়েও ক্ষমতা ও মিডিয়ার জোরে জোরপূর্বক হিন্দু সংস্কৃতিকে পুরো জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, আশার কথা এই—যতই দিন যাচ্ছে, মানুষের চোখ খুলছে এবং গণপরিসরে ব্যাপকভাবে এই অপচেষ্টাটি ভীষণ প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। গত পহেলা বৈশাখের উদযাপন অনুষ্ঠানটির দিকে দৃষ্টি দিলে তা একদম চোখের সামনে ভেসে উঠবে।

৭.
তাহলে ইসলামি সংস্কৃতি কী?

কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন ধর্ম মূলত একটি সমাজের সংস্কৃতির ভিতর থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। সংস্কৃতিকে যদি ধরা হয় একটি গাছ, ধর্ম হলো তার পরিশীলিত সুস্বাদু ফল। ইসলাম তথা নবীগণের ধর্মের ক্ষেত্রে এই ধারণা সত্য নয়; পরিপূর্ণ মিথ্যা। ইসলাম বিশেষ কোন সংস্কৃতির ভিতর থেকে উৎপন্ন হয়নি। এটা আসমান থেকে আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেন এবং পৃথিবীর বুকে একটু একটু করে গড়ে তুলে একে পূর্ণতা দিয়েছেন। কোন সমাজ ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে ধারণ করার পর সে সমাজের যে আমিত্বটুকু তৈরী হয়, যা দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম, দর্শন, বিশ্বাস, দল, গোষ্ঠি, জাতি থেকে আলাদা হয়ে উঠে তাই ইসলামি সংস্কৃতি। পুরো ইসলামকে ভাগ করা হয় মোট পাঁচটি ভাগে: আকীদা—বিশ্বাসের বিষয়সমূহ, ইবাদাতসমূহ, মুআমাআলাত—লেনদেন ও বিনিময়, মুআশারাত—সমাজের একে অপরের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক এবং আখলাক বা ক্যারেক্টার। বস্তুত এই পাঁচের ভিতরেই আমাদের জীবনের সকল দিক পূর্ণরূপে প্রবিষ্ট। এই পাঁচো বিষয়ে ইসলাম নিজস্ব বৈশিষ্ট ধারণ করে।

কথাটি আরেকটু সহজভাবে বললে—ইসলাম একটা পাওয়ার ও অথরিটি। সে নিজে সংস্কৃতি গড়ে তুলে। এই কাজটি করে দুইভাবে: এক হলো জীবনের সকল বিষয়ে নিজে থেকে সংস্কৃতির উপাদান প্রদান করে এবং অপরদিকে স্থানীয় সংস্কৃতিকে বিচার করে সেখান থেকে নিজস্ব দর্শন ও আইনের আলোকে অসাংঘর্ষিক বিষয়গুলো গ্রহণ করার অনুমতি দেয়, সমস্যাযুক্ত হলে সমস্যাটুকু দূর করতে বলে এবং সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো বর্জন ও প্রতিহত করে। ইসলামের সর্বশেষ শরীয়ত শরীয়তে মুহাম্মদি যখন আরবের বুকে গঠিত হচ্ছিল,সে সময়কার ইতিহাসটির দিকে তাকালে তা সুস্পষ্টভাবে ধরা যায়। যেমন, কাউকে ভুলক্রমে হত্যা করলে রক্তপণ হিসেবে একশোটি উট দিতে হবে। এটা জাহেলীযুগে প্রচলিত ছিল,ইসলাম একে আইন প্রণয়ন করে বহাল রেখেছে। কিন্তু কন্যাসন্তানকে জীবিত পুঁতে ফেলা, ইহরাম বেঁধে ফেললে ঘরের সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করা ইত্যাদি অনেক বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছে সুস্পষ্টভাবে। একজন মুসলিম তরুণ হিসেবে বাঙালি সংস্কৃতিকে এভাবেই বিচার করতে আমি আগ্রহী।

ফলে, কোন সংস্কৃতি তা কি হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, না কি দুদিন আগে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি, অথবা নাকি মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি—এসবের কোন কিছু নিয়েই আমার মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু কুরআন ও হাদীসের আলোকে যাচাই করব তা ইসলাম নির্দেশিত বা ইসলাম সম্মত কি না। এটাই হলো ফাইটের জায়গা। এ ফাইট শুধু আমি না, আমার বিপরীত মেরুতে যারা, তারাও করছে। ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন, ক্ল্যাশ অব রিলিজিয়ানস এবং কালচারাল ওয়ার এগুলো পৃথিবীর প্রাচীনতম সত। পৃথিবী যতদিন আছে, এসব থাকবেই।

এখানে সূক্ষ্ম একটা বিষয় পরিস্কার করে ফেলা দরকার মনে করছি: ইসলামি সংস্কৃতি আর নির্দিষ্ট কোন মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি—এই ধারণা দুটো এক নয়। কারন, এক সংস্কৃতি দ্বারা অপর সংস্কৃতি আক্রান্ত হয় এটা সত্য। ফলে, স্থানীয় সংস্কৃতি দ্বারাও ইসলামি সংস্কৃতি বিকৃত হতে পারে। একে পরিশুদ্ধ করে ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতিকে আপন রূপ ও অভিব্যক্তিতে ফিরিয়ে আনার জন্যই প্রতি শতকে তাজদীদ বা সংস্কারের আয়োজন রাখা হয়েছে।

এ জায়গাটায় কেউ কেউ ভুল করেন। তারা বাংলাদেশে চাপিয়ে দেওয়া রাম-সংস্কৃতি ও বিকৃত পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ইসলামি সংস্কৃতির কথা বলেন না। বলেন বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির কথা। বাঙালি মুসলিম সমাজে একটা বিষয় ইসলামি নির্দেশনার বাইরে গিয়ে বিকৃতভাবে গড়ে উঠতেই পারে,এবং সমাজে দীর্ঘদিন যাবত চর্চিত হওয়ার কারণে একে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি বলা যেতেই পারে, তাই বলে কখনোই তা অবলম্বনের বিষয় হতে পারে না। আমাদের নজরটা সবসময় রাখতে হবে যার দিকে, তা হলো ইসলাম।


সাবের চৌধুরী
আলেম, সাহিত্যিক

পঠিত : ২৭২ বার

মন্তব্য: ০