Alapon

আনসলভড মিস্ট্রি....(!)

১। তখন কলকাতা শহরে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। পানির কল বসে নি। কলসী করে মাঘ ফাগুনের গঙ্গার জল তুলে আনতে হত। সন্ধায় ঘরে ঘরে জ্বলত কেরাসিনের আলো। মাষ্টারমশায় মিটমিট আলোয় কীসব পড়াতেন; কানে না ঢুকিয়ে ছেলেটা কাঁধের উপর তম্বুরা ঝুলিয়ে গানের চর্চা করত। হারমোনিয়াম ছিল না তখন; বৈশাখ মাসের বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত- কখন ফেরিওয়ালা ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে সাগর পাড়ি দিয়ে বরফের দেশ থেকে আইসক্রিম নিয়ে আসবে।

বসন্তকালে মালীদের ঝুড়িতে থাকত - বেল ফুল। তখন মেয়েদের খোঁপা থেকে বেল ফুলের সুবাস বইত। বাড়ির ভেতরে পাঁচিল ঘেরা ছাদ। এক একটা দিন বিকেল বেলায় মাদুর পেতে বসে থাকা, এক একটা দিন সন্ধায় ভূত প্রেতের গল্প জমে যেত; তখন কলকাতা শহরের প্রত্যেকটা বাড়ির ছাদে কিংবা উঠানের গাছ ঘেষে ভূতের আনাগোনা ছিল। কোথাও কোন গাছে কেউ একবার প্রথম ভূত দেখতে পাওয়া মাত্রই একে একে করে সব্বাই দেখতে শুরু করত।

সন্ধায় বাড়িতে সাহিত্যের আসর বসত, ছোটরা দরজার হাতল ধরে দূর থেকে দাড়িয়ে থাকত- যদি কোন ফরমায়েশের ডাক আসে, কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ হয়ত বসে থাকা যাবে। তখন বয়স কত হবে ? সাত কী আট। একদিন বিকেলে নীল রঙের কাগজ যোগাড় করে কবিতার মত কিছু একটা লিখে ফেলল। বাড়িতে নামকরা পত্রিকার এডিটর নবগোপাল বাবু এলে ছাপাবার বায়নায় তাকে পাঠ করে শোনানোর পর তিনি হো হো করে হেসে উড়িয়ে দিলেন।

বিহারীবাবু নামে এক কবির যাতায়াত ছিল বাড়িতে। দুপুর বেলায় তিনি ছোট ঘরের পঙ্খের কাজ করা মেঝেতে উপুড় হয়ে বসে বসে কবিতে লিখতেন; বালকের ইচ্ছে ছিল তার মত করে কবিতা লেখবার। কিন্তু তিনি প্রশংসা করতেন না, তম্বুরা কাঁধে তুলে গান গাইলে অন্যদের উদাহারণ দেখিয়ে বলতেন - তারা কত সুন্দর করে গায় !!

কে জানত;সেদিনের সেই ছোকরাই একদিন হয়ে উঠবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

২।

রবীন্দ্রনাথ'কে নিয়ে লেখার জন্য যে জ্ঞানটুকু থাকা চাই তার ছিটেফোটাও আমার ভেতরে নেই। তবু যে লিখছি সেটা পুরোটাই আবেগ থেকে। আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথ এসেছিল তেরো কী চৌদ্দ বছর বয়সে। রাস্তা হারিয়ে ফেলার পর কিশোরের মনে পুরনো পথ হারানোর আতংক এবং নতুন পথ খুঁজে পাবার আনন্দ দুটো অনুভূতি যেরকম একসাথে কাজ করে - আমার ক্ষেত্রে ঠিক সেরকমটাই হয়েছিল একদিন নিঃশব্দ দুপুরে- বইটির নাম ছিল ' গোরা ' !!

আমাদের বাড়িটায় তখন নেটের জানালা ছিল, জানালা দিয়ে কাঁঠাল গাছের পাতার ছায়া পড়ত। সেখানটায় আসন পেতে এক একটা কথা দুবার কী তিনবার করে পড়ে একটু একটু করে এগোতে এগোতে যখন উপন্যাসের মাঝ নদীতে গিয়ে থামি তখন হঠাৎই মনে হল যেখানে আমি ছিলাম সেখান থেকে অনেক দূরে কোথাও বিস্তিন্ন এক জলভূমিতে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে।

গোঁয়ার্তুমি স্বভাবের গোরা প্রচলিত সমাজের ধ্যানধারণা নিয়েই থাকত। একটু এগোলেই জানা যায় সেসময়ের ব্রাহ্মণদের দেয়া মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণাকে সে ভারতের সংস্কৃতি মনে করত। ঠিক হোক - বেঠিক হক মান্ধাতা আমলের নিয়ম গুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করাটাই ছিল তার কাছে দেশ প্রেম। উপন্যাসের শেষে সে জানতে পারে সে আসলে ভারতীয় কেউইই না। তার বাবা ছিলেন একজন আইরিশ নাগরিক। যিনি তার জন্মের সময় মারা গেছেন।

৩।

রবীন্দ্রনাথের ভেতরে সব সময়ই ইনফিনিটি'র একটা ব্যাপার খুঁজে পেয়েছিলাম। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ কষ্টকে গ্রহ নক্ষত্রের কাছে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিতেন, যত বিষাদই থাকুক মনে- তখন সেটাকে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম মনে হবে।

' হারিয়ে যাওয়া' কবিতার কথা মনে আছে ? ছোট একটা মেয়ের হারিয়ে যাবার দুঃখকে অসীম আকাশের সাথে মিলিয়ে দেখানো। তার ছোট মেয়েটি অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে প্রদীপ হাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে সে তখন ছাদের উপরে বসে ছিল। হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে উঠে গিয়ে দেখল - মেয়ের হাতের প্রদীপটা নিভে গেছে। কী হয়েছে জানতে চাইলে মেয়েটি জবাব দিল - ' হারিয়ে গেছি আমি' !!

আবার ছাদে ফিরে গিয়ে সে আকাশের দিকে তাকাল ! আকাশটাকে মনে হল ঠিক তার মেয়ের মতই নীল আঁচল জড়িয়ে প্রদীপের দীপশিখা বাঁচিয়ে একা ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াচ্ছে ! তার মনে সংশয় হয়- যদি এই প্রদীপে আলো নিভে যায় তাহলে কী আকাশও তার মেয়ের মত করে কেঁদে বলবে - “হারিয়ে গেছি আমি।” !! আকাশও তবে হারায় !!

এই ইনফিনিটির মেকানিজমই সেদিনের সেই ছোকরাকে রবীন্দ্রনাথ করে তোলে !!

৪।

রবীন্দ্রনাথ কল্পনার দরজা খুলে দিতেন। যেটা আমরা একভাবে জেনে এসেছি, একভাবে দেখে এসেছি সেই একই জিনিসই তিনি ম্যাজিশিয়ানের মত অন্যভাবে দেখাতেন।

'' পাওয়া কাকে বলে যে মানুষ জানে না , সে ছোঁয়াকেই পাওয়া মনে করে '' বাক্যটা এমন যে আপনাকে ভাবাবে এবং ভাবনার সাথে কল্পনা মেলাতে গিয়ে আপনাকে দ্বিতীয়বার আবার পড়তে হবে। 
রবীন্দ্রনাথের কল্পনা দেখা যেত, গা থেকে ঘ্রাণ বের হত, বুকের পাশ দিয়ে যাবার সময় হৃদপিণ্ড থেকে শব্দ আসত - সেই সব শব্দে তাল - লয় - ছন্দ থাকত। তার এই কল্পনার মেকানিজম প্রেমের ভেতরেও পাই। এই যেমন...

মোর কিছু ধন আছে সংসারে / বাকি সব ধন স্বপনে; নিভৃতস্বপনে / ওগো কোথা মোর আশার অতীত, ওগো কোথা তুমি পরশচকিত / কোথা গো স্বপনবিহারী / রাজপথ দিয়ে আসিয়ো না তুমি, পথ ভরিয়াছে আলোকে প্রখর আলোকে / সবার অজানা, হে মোর বিদেশী / তোমারে না যেন দেখে প্রতিবেশী, হে মোর স্বপনবিহারী।

শেষের কবিতার অমিতের কথা মনে আছে ? যে ভালোবাসত লাবণ্যকে কিন্তু বিয়ে করেছে অন্য কাউকে। তার বন্ধু যখন এর মানে জিজ্ঞাসা করল তখন অমিত সোজাসাপ্টা জবাব দিল ''ভালোবাসা কথাটা বিবাহ কথার চেয়ে আরও বেশি জ্যান্ত''!

রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতায় স্বপনবিহারীর সেই অধরা প্রেমটাকেই ব্যাখ্যা করেছিলেন - ''যে ভালোবাসা ব্যাপ্ত ভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ। যে ভালোবাসা বিশেষ ভাবে প্রতিদিনের সব কিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে , সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।''

ঘরে বাইরে'র সেই নিখিলেশের কথা গুলো আমার ভাবনার জগতটাকেই বদলে দিয়েছে।
যে তার স্ত্রী বিমলা'কে তার চাইতে অধিক জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন সুদর্শন পুরুষ সন্দীপ বাবুর সাথে মেলামেশা করার সুযোগ করে দেয় এই যুক্তিতে যে- সে তার স্বামী শুধু মাত্র এই আইনে তাকে পেতে চায়নি।

নিখিলেশ তার আত্মকথায় লিখেছিল - ''আমি লোভী নই, আমি প্রেমিক। সেজন্যই আমি তালা দেয়া লোহার সিন্দুকের জিনিস চাইনি। আমি তাকেই চেয়েছিলাম আপনি ধরা না দিলে যাকে ধরা যায় না। ''

৫।

আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ যতটা কাল্পনিক ততটাই দৃশ্যমান। একই সাথে খুব বেশি কল্পনা প্রবণ এবং বাস্তবিক ধ্যানধারণা সম্পন্ন! যিনি কল্পনায় একটা পাথরকে দু টুকরো করে ফেলার পর আবার দৃশ্যমান দুটা টুকরো আপনার হাতে দিয়ে যাবে।

যখন জ্বর গ্রস্ত কপালে একটা পরশ মাখা হাতের ছোঁয়া আপনি পাবেন না, যখন হোঁচট খাবার পর কেউ আপনার ব্যাথার খবর জানতে চাইবে না তখন অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে আপনি খুঁজে পাবেন।

''যে টুকু আমার ভাগে এসে পড়েছে সেইটুকু আমার, এ কথা অক্ষমেরা বলে আর দুর্বলেরা শোনে। যা আমি কেড়ে নিতে পারি সেইটাই যথার্থ আমার।'' লিখেছিলেন তার একটি চরিত্র সন্দীপ বাবু'র আত্মকথায়।

যখন ছেলেবেলায় তার প্রিয় কবি বিহারীবাবুর কাছ থেকে তার গান এবং কবিতার প্রশংসা পেতেন না, তখনো ছেলেটা জানত সে একদিন এই পৃথিবীটাকে নাড়িয়ে দেবে। ' জীবন স্মৃতি ' গ্রন্থে সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন '' আমার ভেতরে ভারি একটা দুরন্ত তাগিদ ছিল, তাহাকে থামাইয়া রাখা কাহারো সাদ্ধায়ত্ত ছিল না''

প্রদীপে আগুন থাকা চাই। ত্যাজটাই হল আগুন আর ধোঁয়াটা আবেগ। এই মানুষটা আমাকে যতবার জীবন চেনাতে চেয়েছেন ততবারই আগুন নিয়ে হাজির হয়েছেন 
'' শিমুল কাঠ হোক আর বকুল কাঠ হোক আগুনের চেহারাটা একই।''

৬। কানায় কানায় পূর্ণ জীবন কখনো জীবনটাকে পরিপূর্ণ করে না। দু হাজার গানের কারিগর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনেও আক্ষেপ ছিল এবং অপরিপূর্ণতা ছিল।

আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের জীবনের সব চাইতে বড় ট্র্যাজেডি যেটা মনে হয়েছে সেটা হল - যে মানুষটা সারা পৃথিবীর মানুষকে ভালোবাসা শিখিয়েছেন সে মানুষটা কিন্তু তার নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো রাখতে পারে নি।

সেই কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট - '' প্রিয় রবি, আমি মরে যাবার পর আমার এই পত্র তুমি আমার চিতার আগুনে পুড়িয়ে দিও।''

বিষণ্ণ সেই মৃণালিনীর মুখের রহস্য আমরা কোনদিন ভেদ করতে চাই না। যতদিন পৃথিবীটা থাকবে ততদিন সেটা আনসলভড মিস্ট্রি হয়েই থাকুক।

পঠিত : ৭৬২ বার

মন্তব্য: ০