Alapon

|| উপজাতি-আদিবাসী ||




বাংলাদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে আর্য ও অনার্য বিতর্ক তো আছেই। বাঙালি না বাংলাদেশি সেই বিতর্ক চলে সমানতালে। এসব বিতর্কের ভেতরে বাঙালি না মুসলিম এই প্রশ্নও তুলে বসেন কেউ কেউ। যেন বিতর্ক আর কুতর্কই আমাদের কাজ। পত্রিকা অথবা টেলিভিশন, ফেসবুক অথবা ইউটিউব, চায়ের স্টল অথবা খেলার মাঠ, পাড়ার দোকান অথবা বৈঠকঘর—প্রায় সবখানেই বিতর্ক আমাদের প্রিয় বিষয়। তবে এসব বিতর্ক কতটা আমাদের নিজস্ব, কতটা চাপিয়ে দেওয়া; অথবা কতটা আমাদের মনোজগৎ দখল করে দখলদারের বিতর্ক আমাদের দিয়ে করানো সেটা নির্ধারণ করা সুকঠিন। সহজ হলো, এসব বিতর্কের পেছনে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। সম্পর্কের চেয়ে বিভাজন বেশি। শান্তির চেয়ে অশান্তি বেশি।

বিতর্কের যখন বাজার ভালো, তখন বিতর্ক কেন নয়! সেই প্রশ্নে অধুনা বিতর্ক আদিবাসী না উপজাতি! এই বিতর্কের মূল কারণ কিছু মিডিয়া আর এনজিও। বাংলাদেশের যত ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তাদেরকে আমরা আবহমান কাল থেকেই উপজাতি হিসেবে চিনে ও জেনে আসছি। আমাদের সাংবিধানিকভাবেও তারা উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত। উপজাতি হিসেবেই এই দেশে তারা তাদের নাগরিক অধিকার ও দৈশিক সুবিধাদি লাভ করে থাকেন। ১৯৯৭ সালেও পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো নিজেদের উপজাতি পরিচয়ে পরিচয় দিত।

গত প্রায় এক দশক ধরে হঠাৎ করেই সেই উপজাতি পরিচয়কে বাদ দিয়ে আদিবাসী পরিচয়ের জন্য একটা বিতর্কিত আন্দোলন শুরু হয়। সেই বিতর্ক কিছু মিডিয়া, এনজিও ও সুশীল সমাজ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এমন কি সরকারের উপর একটা চাপও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। গত ০৯ আগস্ট ২০২২ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের অনলাইনে ‘বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক’ প্রতিবেদনে লেখা হয়, “বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর অধিকার, স্বীকৃতি ও ‘দাবী’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে নৃতাত্ত্বিক ও সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী নেই। বাংলাদেশের ভূমিজ সন্তান বা আদি বাসিন্দা হলো এখানকার মূল জনগোষ্ঠী যারা নানা পরিচয়ের পরিক্রমায় বাঙালি বলে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু বিগত শতকের শেষ দশকে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় আগত, বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার থেকে ৭ শত থেকে ৩ শত বছর আগে আগত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যাযাবর, তফসিলি সম্প্রদায় বিদেশী বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার ইন্ধনে নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে ‘দাবী’ করে স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করতে শুরু করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর এই ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির ‘দাবী’ কোনো সাধারণ ও মামুলি ব্যাপার নয়। এর সাথে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, সরকারের কর্তৃত্ব ও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত। সে কারণে বিগত আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশের সরকারসমূহ এ বিষয়ে নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে।”

জাতিসংঘের আদিবাসী সংজ্ঞা অনুযায়ী এই দেশের একমাত্র আদিবাসী মূল জনগোষ্ঠী। কিন্তু বৈদেশিক নানা রকমের সুবিধা এবং তহবিল মুফতে পেতে একদল মানুষ দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী এই বিতর্ককে একটা আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। যদিও এই আদিবাসী ও উপজাতি বিতর্কের শিকড় আরও গভীরে। আমরা যতটা নিরীহ ও ভদ্রস্থ চেহারা এই আন্দোলনের দেখি, বাস্তবে তা আদৌ ততটা নিরীহ নয়। এর পেছনে দীর্ঘ এক ষড়,যন্ত্রের ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে স্বদেশ ও ইসলাম বি,রোধী শক্তি,র স্বার্থ এবং পাহাড়কে অস্থি,তিশীল করে নতুন এক ষড়,যন্ত্রমূলক বি,ভাজনের চিন্তা। নানা সময় সেসব চিন্তার কথা পত্রিকায় আমরা ‘জম্মু ল্যান্ড’ নামে পড়েছি। শুনেছি এক দীর্ঘ খৃষ্টরাজ্যের স্বপ্নের কথাও। যদিও কেউ কেউ সেসব খবর ও প্রচারণাকে কন্সপিরেসি বলে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু ঘটনার পরম্পরা ও ফলাফলে আমাদের হাইপো থিসিস শেষ পর্যন্ত কন্সপিরেসির পক্ষেই থাকে।

আদিবাসী ও উপজাতি মোটেই একটা শাব্দিক কিংবা ভাষাগত ভাবনা নয়। বরং যারা এই দুইটা পরিভাষাকে কেবল শব্দগত সমস্যা ভাবছেন, তাদের জন্য তিনটি ঘটনা প্রসঙ্গিক হিসেবে উপস্থাপন করছি।

ঘটনা : ০১
গত ১৯ মে ২০১৯ সাল। রমজান কেন্দ্রিক একটি প্রমোশনাল বিজ্ঞাপন অথবা শর্ট ফিল্ম বানায় নুহাশ হুমায়ূন। ক্লায়েন্ট ছিল টেকনো ফোন। সেই বিজ্ঞাপনের নাম ছিল ‘রানিং রাফি’। সেখানে দেখানো হয় বান্দরবানে মসজিদের আযান শোনা যায় না। ফলে রাফি নামে এক কিশোর ইফতার ও সেহরিতে দৌড়ে দৌড়ে লোকজনকে জাগিয়ে দেয়। ব্যস এটুকুই।

কিন্ত যখন এই বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়; তখন পুরো সুশীল, এক্টিভিস্ট ও পাহাড়ের মানুষেরা রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করে এই বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে। যদিও তাদের বিরোধিতার মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে পাহাড়ের প্রতিবেশকে নষ্ট করে আলোকসজ্জা দেখানো। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুজনের স্টেটাস ও লেখায় স্পষ্ট ছিল অন্য একটা কারণ। সেটা পাহাড়ে ইসলামি কালচারের উত্থানের ভয়। পাহাড়ে ইসলাম প্রচারের ভয়।

পাহাড়ে খৃষ্টধর্মের প্রচারে কোনো সমস্যা নেই। পাহাড়ে হাসপাতাল, চার্চ বানাতে কোনো সমস্যা নেই। পাহাড়ে পৃথিবীর তাবৎ খৃষ্টান মিশনারির ত,ৎপরতায় এই দেশের সুশীল সমাজের কিছুই যায় আসে না। এনজিওদের কার্যক্রমেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না। পাহাড়ের ঐতিহ্য আর গাম্ভীর্য নষ্ট হয় না। পার্বত্যাঞ্চলের প্রায় সবগুলো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এখন খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী। এতে কেউ কোনো সংকটের গন্ধ পান না।

কিন্তু যেই পাহাড়ের কেউ মুসলিম হয়ে যান। ইসলামের দাওয়াত দিতে যান। তখন তিনি আর আদিবাসী অথবা উপজাতি কোনোটাই থাকেন না। এই জটিল রাজনৈতিক সমীকরণটা সুশীল, এনজিও আর কিছু মিডিয়ার সৃষ্টি। যেখানে ইনসাফ ও নাগরিক অধিকার এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার আলাপ ছিল মুখ্য সেখানে কীভাবে দেশ ও দেশের আপামর জনতার সঙ্গে নৃগোষ্ঠীগুলোর ক্ল্যাশ বাড়ানো যায়, সেই প্রচেষ্টা কেউ কেউ করছেন নিরন্তর।

ঘটনা : ০২
১৮ জুন ২০২১। পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রোয়াংছড়ির ত্রিপুরা উপজাতির মুসলিম মোহাম্মদ ওমর ফারুককে হ,ত্যা করা হয়। রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের সামনে তাকে গু,লি করে হ,ত্যা করা হয়। তিনি খৃষ্টান থেকে মু,সলিম হয়েছিলেন। এই ঘটনায় বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের নেতা কাজী মুজিবুর রহমান ঘটনার জন্য জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “মুসলিম হওয়ার কারণেই ওমর ফারুককে হ,ত্যা করেছে, কারণ তিনি তার এলাকায় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করছিলেন।”

আমরা দেখি নানাভাবেই পার্বত্য অঞ্চলে ইসলাম, মুসলমান ও বাংলাদেশের স্বার্থের প্রশ্ন আসলেই কিছু মানুষ নানাভাবে ভিন্ন সুরে ভিন্ন স্বার্থের কথা বলেন। দীর্ঘ দিন ধরেই পাহাড়ে সমতলের মানুষকে দখলদার বলার চেষ্টা করছে একদল উপজাতীয় এক্টিভিস্ট। অথচ রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিক যে কোনো স্থানে জায়গা কিনে বসবাস করার সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ করেন। শান্তি বাহিনীর নামে খাগড়াছড়িতে বহু সমতলের মানুষকে হ,ত্যা ও গু,ম করেছে বিচ্ছি,ন্নতাবাদী লোকেরা। এদেরকে কারা মদ,দ দিয়েছে? কাদের ইন্ধনে তারা দেশের সেনাবাহিনীর উপর আ,ক্রমণ করত! সেসব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাব এই আদিবাসী আর উপজাতি বিভাজন বিতর্কের রহস্য যদি উন্মোচন করা যায়।

ঘটনা : ০৩
দুই হাজার একুশ সালের সেপ্টেম্বরের আরেকটি ঘটনা খুবই উদ্বে,গজনক। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আ,যান দিয়ে নামায আদায় করে ফেসবুকে স্টেটাস দেয় দুই যুবক। সেই কারণে তাদের গ্রে,ফতার করা হয়।

এখন প্রশ্ন হলো, পার্বত্যাঞ্চল কি বাংলাদেশে? সেই অঞ্চলের মানুষেরা কি এই দেশের নাগরিক নয়? একই দেশে দুই ধরনের অধিকার কেন থাকবে? যেখানে দুই ধরনের অধিকারে কেউ কেউ বঞ্চিত হয়!

পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতিদের আদিবাসী স্বীকার করে নিলে এই দেশে হাজার বছর ধরে বসবাস করা মানুষেরা তাহলে দেশহীন হয়ে যান। ষোলো শতকে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে আসা নৃগোষ্ঠীগুলো কোনোভাবেই এই দেশের আদিবাসী নয়। বরং সমতলের মানুষেরাই আদিবাসী। তবে এই উপজাতি ও আদিবাসী বিতর্কে না গিয়ে সবাই যদি একদেশের নাগরিক হতে পারি, তাহলে দ্বন্দ্ব বিভাজন ও বিতর্ক কমিয়ে একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারব।

সেই ঐক্য ও দেশের জন্য দেশের নাগরিক হতে হলে অবশ্যই আমাদের শত্রু-মিত্র চিনতে হবে। দেশের ভেতরে দেশের বিরোধীদের প্রতিহত করতে হবে।



সাইফ সিরাজ
কবি ও বিশ্লেষক

পঠিত : ৩২২ বার

মন্তব্য: ০