Alapon

| | ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত অবস্থা ||




প্রাচীন জাহেলী যুগে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে লোকদের ধারণা খুব পরিপক্কতা লাভ করতে পারেনি। মানুষ তখনো জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারেনি বলে বংশীয় বা গোত্রীয় ভাবধারায়ই অধিকতর নিমজ্জিত ছিল। ফলে সে যুগে জাতীয়তাবাদের নেশায় বড় বড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক পর্যন্ত অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরিস্টোটল-এর ন্যায় একজন উচ্চ শ্রেণীর চিন্তাশীল তাঁর Politics গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, অসভ্য ও বর্বর জাতিগুলো গোলামী করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে এসব মানুষকে গোলাম বানাবার জন্য যুদ্ধ করা অর্থোৎপাদনের অন্যতম উপায়। কিন্তু আমরা যখন দেখি গ্রীকরা সকল অ-গ্রীক লোকদেরকেই ‘বর্বর’ বলে মনে করতো, তখনি এরিস্টোটলের উলিখিত মতের মারাত্মকতা অনুভব করা যায়। কারণ তারা নিশ্চিতরূপে মনে করতো যে, গ্রীসের লোকদের নৈতিক চরিত্র ও মানবিক অধিকার দুনিয়ার অন্যান্য মানুষ অপেক্ষায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

জাতীয়তাবাদের এ প্রাথমিক বীজই উত্তরকালে ইউরোপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অবশ্য খৃস্টীয় মতবাদ এর অগ্রগতি দীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রতিরোধ করে রেখেছিল। একজন নবীর শিক্ষা— তা যতোই বিকৃত হোক না কেন— স্বাভাবিকভাবে গোত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিবর্তে বিশাল মানবিক দৃষ্টিভংগীই গ্রহণ করতে পারে। উপরন্তু রোমান সাম্রাজ্যবাদের সর্বাত্মক রাষ্ট্রনীতি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিকে একটি মিলিত কেন্দ্রিয় শক্তির অধীন ও অনুসারী করে দিয়েছিল বলে জাতীয় ও গোত্রীয় হিংসা-বিদ্বেষের তীব্রতা অনেকখানি হ্রাস করে দিয়েছিল। এভাবে কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত পোপের আধ্যাত্মিক এবং সম্রাটের রাজনৈতিক প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব পরস্পর মিলে খৃস্টান জগতকে নিবিড়ভাবে যুক্ত রেখেছিল। কিন্তু এ উভয় শক্তিই অত্যাচার-নিষ্পেষণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরোধীতায় পরস্পরের সাহায্য করতো। পার্থিব ক্ষমতা-ইখতিয়ার ও বৈষয়িক স্বার্থ বন্টনের ব্যাপারে এরা পরস্পরের শত্রুতায় লিপ্ত ছিল। একদিকে তাদের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব সংগ্রাম, অন্যদিকে তাদের অসৎ কার্যকলাপ ও জুলুম নিষ্পেষণ এবং তৃতীয় দিকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক নবজাগরণ ষষ্ঠ শতাব্দীতে একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। এ আন্দোলনকে ‘সংশোধনের আন্দোলন’ নামে অভিহিত করা হয়।

এ আন্দোলনের ফলে পোপ ও সম্রাটের প্রগতি ও সংশোধন বিরোধী শক্তির সমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু অন্যদিকে এ ক্ষতিও হলো যে, এর দরুন একই সূত্রে গ্রথিত বিভিন্ন জাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। সংশোধনী (Reformation) আন্দোলন বিভিন্ন খৃস্টান জাতির এ আধ্যাত্মিক সম্পর্কের মধ্যস্থিত কোনো বিকল্প পেশ করতে পারলো না। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ঐক্য এবং সংহতি চূর্ণ হওয়ার পর জাতিগুলো যখন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো, তখন তারা বিক্ষিপ্তভাবেই নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করতে লাগলো। প্রত্যেক জাতির ভাষা ও সাহিত্য স্বতন্ত্রভাবে উৎকর্ষ লাভ করতে লাগলো। প্রত্যেক জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থ অন্যান্য প্রতিবেশী জাতি থেকে বিভিন্ন হয়ে দেখতে লাগলো। এভাবে বংশীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক ভিত্তিতে নতুন জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করলো। এটা বংশীয় আভিজাত্যবোধ ও হিংসা-বিদ্বেষর স্থান অধিকার করতে লাগলো। অতঃপর বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পারিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা (Competition) মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। যুদ্ধ ও সংগ্রাম বাধতে শুরু করলো। একজাতি অন্য জাতির স্বার্থে দ্বিধাহীনচিত্তে আঘাত হানতে শুরু করলো। অত্যাচার-নিষ্পেষণের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকলো। এর ফলে জাতীয়তা সম্পর্কীয় ভাবধারার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকলো। এর ফলে জাতীয়তা সম্পর্কীয় ভাবধারার মধ্যে তিক্ততা তীব্রতর হতে লাগলো। এভাবে জাতীয়তাবোধ (sence of Nationality) ‘জাতীয়তাবাদে’ (Nationlism) পরিণত হলো।

ইউরোপে এই যে জাতীয়তাবাদের উৎকর্ষ ও বিকাশ ঘটলো, প্রতিবেশী জাতিগুলোর সাথে প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ সৃষ্টির পরই তা হয়েছিল বলে তাতে অবশ্যম্ভবীরূপে নিম্মলিখিত চারটি ভাবধারা শামিল হয়েছে :

এক :

জাতীয় আভিজাত্য গৌরব। এর দরুন একজন লোক নিজের জাতীয় ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের অন্ধ পূজারী হয়ে পড়ে। অন্যান্য জাতি অপেক্ষা নিজ জাতিকে সর্বতোভাবে উচ্চ, উন্নত ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতে শুরু করে।


দুই :

জাতীয় অহমিকা। এর দরুন মানুষকে ন্যায়-অন্যায়ের উর্ধে উঠে সকল অবস্থায় নিজ জাতিকেই সমর্থন করে যেতে হয়।

তিন :

জাতীয় সংরক্ষণের ভাবধারা। এটা জাতির প্রকৃত ও কাল্পনিক স্বার্থ সংরণের জন্য জাতিকে দেশ থেকে শুরু করে পররাজ্য আক্রমণ করা পর্যন্ত অনেক কাজ করতে বাধ্য করে। অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আমদানী রফতানী শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধি করা, অপর জাতির লোকদের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা, নিজ দেশের চতুঃসীমার মধ্যে অন্য জাতির লোকদের জন্য রুজী-রোজগার ও নাগরিক অধিকার লাভ করার পথ বন্ধ করা, দেশ গড়ারার জন্য অত্যাধিক পরিমাণ সামরিক শক্তি অর্জন করতে চেষ্টা করা এবং নিজ দেশ ও জাতির সংরণের জন্য অপর রাজ্যে গমন করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

চার :

জাতীয় অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ (National Aggrandisment) এটা প্রত্যেক উন্নতিশীল ও শক্তিসম্পন্ন জাতির মধ্যে দুনিয়ার অন্যান্য জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভের ভাবধারা জাগ্রত করে। অন্য জাতির অর্থ ব্যয় করে নিজের সমৃদ্ধি বিধানে সচেষ্ট করে। অনুন্নত জাতি-গুলোর মধ্যে সভ্যতা-সংস্কৃতি বিস্তারের কাজে নিজেকে দায়ী বলে মনে করে এবং অন্যান্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদরাজি ভোগ করার তার জন্মগত অধিকার রয়েছে মনে করে শক্তিশালী জাতি দুর্বল জাতিদের শোষণ করে।

ইউরোপের এ জাতীয়তাবাদের নেশায় মত্ত হয়েই কেউ ঘোষণা করে “জার্মানী সকলের উপর” কেউ দাবী করে “আমেরিকা খোদার নিজের দেশ।” কেউ বলে “ইটালীবাসী হওয়াই ধর্মের মূলকথা।” কারো মুখে এ ঘোষণা শ্রুত হয় যে, “শাসন করার জন্মগত অধিকার একমাত্র বৃটিশের।” এভাবে প্রত্যেক জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিই একটি ধর্মমতের ন্যায় এ মত পোষণ করে—
“আমার দেশ-ন্যায় করুক, কি অন্যায়” (My country Wrong or right)


বস্তুত জাতীয়তাবাদের এ উন্মাদনা বর্তমান দুনিয়ার মানবতাকে নির্মমভাবে অভিশপ্ত করেছে। এটা মানব-সভ্যতার পক্ষে সর্বাপেক্ষা অধিক মারাত্মক। এটা মানুষকে নিজ জাতি ছাড়া অন্যান্য লোকদের পক্ষে হিংস্র পশুতে পরিণত করছে।

শুধু নিজ জাতির প্রতি ভালবাসা পোষণ করা এবং তাকে স্বাধীন, সমৃদ্ধ এবং উন্নতশীল দেখার প্রত্যাশী হওয়াকেই জাতীয়তাবাদ বলা হয় না। কেননা এটা মূলত এক পবিত্র ভাবধারা সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে নিজ জাতিকে ভালবাসা নয়— বিজাতির প্রতি শত্রুতা, ঘৃণা, হিংসা-দ্বেষ ও প্রতিশোধ নেয়ার আক্রোশই এ জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে এবং এটাই তা লালন-পালন করে। জাতীয়তাবাদের আক্রমণে আহত মনোভাব ও নিষ্পেষিত জাতীয় উন্মাদনা মানুষের মনে এক প্রকার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, আর প্রকৃতপক্ষে এটাই হয় জাতীয়তাবাদের জীবন উৎস। এ আগুন এ বর্বর যুগের অহমবোধ জাতি প্রেমের মহান পবিত্র ভাবধারাকেও সীমাতিক্রান্ত করে এক অপবিত্র জিনিসে পর্যবসিত করে। এক একটি জাতির মধ্যে এ ভাবধারা বিজাতির প্রকৃত কিংবা কাল্পনিক কোনো অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই প্রথমে জাগ্রত হয়। কিন্তু কোনো নৈতিক বিধি-নির্দেশ আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং আল্লাহর শরীয়াত যেহেতু তার পথনির্দেশ করে না, এজন্য এটা সীমা অতিক্রম করে সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism), অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ (Economic Nationalism), বংশীয় বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। আধুনিক যুগের একজন নামকরা লেখক Francis W-Cocker লিখেছেন :

“কোনো কোনো জাতীয়তাবাদী লেখক দাবী করেন যে, স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করার অধিকার কেবল উন্নতশীল জাতিগুলোরই রয়েছে …… যাদের উন্নততর সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য বিদ্যমান। তাঁর যুক্তি এই যে, একটি উচ্চ শ্রেণীর সভ্যজাতির অধিকার ও কর্তব্য কেবল নিজ স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং নিজেদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারসমূহ অন্যের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্পন্ন করাই নয়, বরং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত জাতিগুলোর উপর নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করাও তাদের অধিকারভূক্ত এবং কর্তব্য- সে জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হলেও বাধা নেই। তাঁরা বলেন, প্রত্যেক উন্নত জাতিরই একটা বিশ্ব ব্যাপক মর্যাদা থাকে, তার অভ্যন্তরীণ যোগ্যতা প্রতিভাকে কেবলমাত্র নিজেদের দেশের মাটির মধ্যে প্রেথিত করার কিংবা স্বার্থপরতার বশীভূত হয়ে কেবল নিজের উন্নতি সাধনের জন্যই তার প্রয়োগ করার কোনোই অধিকার নেই। …..বস্তুত এরূপ মত ও যুক্তি ধারাই ঊনবিংশ শতকের শেষ অধ্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে ইউরোপ এবং আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির অধীন করা হয়েছিল ঠিক এরূপ যুক্তি প্রদর্শন করে।”


তিনি আরো লিখেছেন-
“এখনও বলা হয় যে, একটি বড় জাতির উপর যখন আক্রমণ হয়, তখন শুধু প্রতিরোধ করার অধিকারই তার হয় না, বরং তার স্বাধীন জীবনধারা ও সমৃদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর যে কোনো কাজের প্রতিরোধ করার অধিকারও তার থাকে। নিজেদের সীমান্তের সংরক্ষণ, নিজস্ব উপায়-উপাদানকে নিজেদেরই কর্তৃত্বাধীনকরণ এবং নিজেদের সম্মানের নিরাপত্তা বিধানই একটি জাতির জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়। বেঁচে থাকতে হলে তাকে আরো অনেক কিছুই করতে হবে। তাকে সামনে অগ্রসর হতে হবে, ছড়িয়ে পড়দে হবে, নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে, নিজ জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও চাকচিক্য বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় সে জাতি ধীরে ধীরে অধঃপতনের দিকে নেমে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তার অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে। নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিধি বিস্তার করতে যে জাতি যতবেশী সাফল্য লাভ করবে, সে জাতির বেঁচে থাকার অধিকার ততই বেশী হবে। যুদ্ধে জয়ী হওয়াই জাতির যোগ্যতম (Fittest) হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ডাঃ বীজহাট-এর কথায় “যুদ্ধ জাতি গঠন করে।”

তিনি অতঃপর লিখেছেন-
“ডারউইনের ক্রমবিকাশ মতাদর্শকেও এসব মতবাদের সমর্থনে সম্পূর্ণ ভুলের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। আর্নেস্ট হেকল (Ernist Haekel) জার্মানে ডারউনবাদের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপত্তিশালী ‘বাণী বাহক’ ছিলেন! তিনি তাঁর জীব বিজ্ঞান (Biological) সংক্রান্ত মতবাদ খুবই সতর্কতার সাথে দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানে (Sociology) ব্যবহার করেছেন। তিনি স্বার্থপরতা ও আত্মপূজাকে এক সার্বিক জীব বিধান মনে করেন এবং বলেন, এ আইন মানব সমাজে এক প্রকার বংশীয় মানব ধ্বংসের ব্যবস্থা হিসেবে জারী হয়ে থাকে। তাঁর মতে পৃথিবীর বুকে যতো প্রাণীই জন্মগ্রহণ করে, তাদের সকলের জন্য উপজীব্য এখানে বর্তমান নেই। ফলে দুর্বল প্রাণীর বংশ শেষ হয়ে যায়। কেবল এজন্য নয় যে, পৃথিবীর সীমাবদ্ধ উপজীব্য আহরণ করার জন্য যে প্রবল দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, তাতে এরা অন্যান্যদের সাথে সাফল্যজনক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সমর্থ হয় না, বরং এজন্যও যে, শক্তিশালী প্রাণীসমূহের বিজয়ী পদক্ষেপের প্রতিরোধ করার কোনো মতাও তাদের মধ্যে হয় না। এভাবে কার্ল পিয়ার্সন (Karl Pearson) আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রামকে ‘মানবজাতির স্বাভাবিক ইতিহাসের এক অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর দাবী এই যে, বৈজ্ঞানিক ধারণার (Scientific View of Life) দিক দিয়ে মানব সভ্যতা ও তামাদ্দুনের ক্রমবিকাশ মূলত সেই দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের কারণে ঘটে থাকে, যা শুধু ব্যক্তিদের মধ্যেই নয়-জাতিসমূহের মধ্যেও চিরন্তনভাবে বর্তমান থাকে। একটি উচ্চ শ্রেণীর জাতি যখন দুর্বল বংশধরদের ধ্বংস করার এবং কেবল শক্তিশালী বংশ সৃষ্টি করে নিজের অভ্যন্তরীণ যোগ্যতা বৃদ্ধি করে নেয়, তখন সে অন্যান্য জাতিসমূহের সাথে মুকাবেলা করে নিজের বাহ্যিক যোগ্যতাকে (Fitness) বিকশিত করতে শুরু করে। এ দ্বন্দ্বে দুর্বল (অযোগ্য) জাতিসমূহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শক্তিশালী জাতিসমূহই অবশিষ্ট থাকে। এরূপে সামগ্রিকভাবে গোটা মানবজাতিই উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। এ জাতি অন্যান্য উন্নততর জাতির সমতুল্য হওয়ার প্রমাণ ঠিক তখনি দিতে পারে, যখন তা ব্যবসায়-বাণিজ্যে, কাঁচামাল ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাদের সাথে নিরন্তর সাধনা-প্রতিযোগিতা করতে থাকে। যদি নিম্মস্তরের জাতিগুলোর সাথে মিলেমিশে থাকতে শুরু করে, তবে মনে করতে হবে যে, সে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী প্রত্যাহার করেছে। আর সেইসব জাতিকে নির্বাসিত করে নিজেই যদি সেই দেশ অধিকার করে কিংবা তাদেরকে বসবাস করার অধিকার দান করে তাকে স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করে, তবে তাতেই একটা জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। -Recent political Thought, New York, 1934, p.443-48.

জোসেফ লিটেন (Joseph Lighten) নামক অন্য একজন গ্রন্থকার লিখেছেন :

“পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে দুনিয়ার ইতিহাস অপেক্ষাকৃতভাবে জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের পারস্পারিক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিহাস। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ক্রমাগতভাবে জাতসমূহের পারস্পারিক সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিবন্ধকতার সূচনা হয়। তারপরই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমেরিকা, আফ্রিকা, সাত সমুদ্রের দ্বীপসমূহ এবং এশিয়ার বড় বড় অংশের উপর আধিপত্য বিস্তার, উপনিবেশ স্থাপন এবং এসব দেশের অর্থনৈতিক উপায়-উপাদন শোষণ (Exploitation) করা-প্রভৃতি এ লুট-তরাজ ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় মাত্র। যদিও এসব কিছুই রোমকদের পতনের পর লুট-তরাজ করতে করতে বর্বর জাতিদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার সময়ও খুব ক্ষুদ্র আকারে সংঘটিত হয়েছিল। তবে পার্থক্য এই যে, রোমক সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ থেকে ধর্মীয়, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু নতুন পৃথিবীতে তা সম্ভব হয়নি।” – Social Philosophies in Conflict, New York 1937, p.439


এ গ্রন্থকার অন্যত্র লিখেছেন :
“সাংস্কৃতিক ঐক্য সম্পন্ন একটি জাতি যখন রাজনীতির দিক দিয়ে স্বাধীন এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমস্বার্থ বিশিষ্ট হয় এবং এরূপ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জাতীয়তায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগ্রত হয়, তখন অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ অনিবার্যরূপে তীব্র হয়ে দেখা দেয়। কারণ দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পারিক যে দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের প্রচলন রয়েছে, তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে এ জাতীয়তাবাদ। আর এ জাতীয়তাবাদই অনতিবিলম্বে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্য সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা করার জন্য জাতিসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এবং বৈদেশিক বাজার এবং পশ্চাদবর্তী দেশের অর্থ-সম্পদ করায়ত্ত করার জন্য তাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়।”


“রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের সমস্যা-যার সমাধানের কোনো উপায়ই পাওয়া যায়নি-এই যে, একদিকে একটি জাতির কল্যাণ ও মঙ্গল বিধানের জন্যে একটি জাতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অপরিহার্য এবং তার কেবল অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যই নয়-তার সাংস্কৃতিক উন্নতি, তার শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প-তার প্রত্যেকটি বিষয়ের উৎকর্ষ লাভ জাতীয় রাষ্ট্রের উন্নতি ও শক্তি লাভের উপর একান্তভাবে নির্ভর করে। কিন্তু অপরদিকে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়ে পড়ে। প্রত্যেক জাতির ক্ষতি করে নিজের উন্নতি সাধনের জন্য চেষ্টা করে। এর ফলে জাতিসমূহের পরস্পরের মধ্যে প্রতিহিৎসা, সন্দেহ, ভয় ও ঘৃণার ভাবধারা প্রতিপালিত হতে থাকে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য ময়দানে সামরিক সংঘর্ষ পর্যন্ত অবাধগতি এবং এটা অত্যন্ত নিকটবর্তী পথ।” -প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪-৫.


পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী আদর্শের পার্থক্য

পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদ, তার চিন্তা-পদ্ধতি ও কর্মনীতি আমার নিজের কথায় প্রকাশ করার পরিবর্তে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের ভাষায়ই এখানে পেশ করা আমি অত্যাধিক ভাল মনে করেছি। এর ফলে স্বয়ং পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের লেখনীর সাহায্যেই পাঠকদের সামনে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত চিত্র সঠিকরূপে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইউরোপে যেসব ধারণা-কল্পনা এবং যেসব নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ স্থাপিত ও বিকশিত হয়ে হয়েছে, উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে একথা অনস্বীকার্যরূপে প্রমাণিত হয়েছে যে, তা সবই মানবতার পক্ষে নিঃসন্দেহে মারাত্মক। এসব নীতি ও ধারণা মানুষকে পাশবিকতা-চরম হিংস্রতার পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। যা আল্লাহর পৃথিবীকে জুলুম-পীড়ন ও রক্তপাতে জর্জরিত করে দেয় এবং মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ প্রতিরোধ করে। আদিকাল থেকে আল্লাহর প্রেরিত নবীগণ দুনিয়াতে যে মহান উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করেছেন, পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের এ নীতি তা সব ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আলাহর শরীয়াত যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় এসেছে, যেসব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও আদর্শ নিয়ে আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে, উপরোক্ত শয়তানী নীতি তার প্রতিরোধকারী। এটা মানুষকে সংকীর্ণমনা, সংকীর্ণ দৃষ্টি ও হিংসুক করে দেয়। এটা জাতি ও বংশসমূহকে পরস্পরের প্রাণের দুশমন বানিয়ে সত্য, ইনসাফ ও মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ করে দেয়। বৈষয়িক শক্তি ও পাশবিক বলকে এটা নৈতিক সত্যের স্থলাভিষিক্ত করে ইলাহী শরীয়তের মর্মমূলে কঠিন আঘাত হানে।

মানুষের পরস্পরের মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে বিশাল ও ব্যাপক কর্মক্ষেত্রে পরস্পরের সাহায্যকারী ও সহানুভূতিশীল বানিয়ে দেয়া ইলাহী শরীয়তের চিরন্তন উদ্দেশ্য। কিন্তু জাতীয়তাবাদ বংশীয়-গোত্রীয় ও ভৌগলিক বৈষম্যের ক্ষুরধার তরবারী দ্বারা এসব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় এবং জাতীয় হিংসা-দ্বেষ সৃষ্টি করে মানুষকে পরস্পরের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করে।

মানুষের পরস্পরের মধ্যে যথাসম্ভব স্বাধীন সম্পর্ক ও সম্বন্ধ স্থাপনের উদার অবকাশ সৃষ্টি করাই ইলাহী শরীয়তের লক্ষ্য। কারণ মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা এরই উপর নির্ভর করে। ফলে এক জাতীয়তাবাদ এ সম্পর্ক-সম্বন্ধ স্থাপনে প্রবল বাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে এক জাতির প্রভাবান্বিত এলাকার অপর জাতির পক্ষে জীবন ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

খোদায়ী শরীয়তের লক্ষ্যবস্তু হলো প্রতিটি ব্যক্তি; প্রতিটি জাতি এবং প্রতিটি প্রজন্ম তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং জন্মগত যোগ্যতা লালন করার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা লাভ করুক, যাতে সামগ্রিকভাবে মানবতার উন্নতি বিধানে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ প্রতিটি জাতি আর প্রতিটি প্রজন্মের মধ্যে এমন প্রেরণা সৃষ্টি করে, যাতে সে শক্তি অর্জন করে অন্য জাতি আর প্রজন্মকে তুচ্ছ, মূল্যহীন এবং হেয় সাব্যস্ত করতঃ তাদেরকে দাসে পরিণত করে তাদের জন্মগত যোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়ে কাজ করার সুযোগই না দেয়; বরং তাদের বেঁচে থাকার অধিকারই হরণ করে ছেড়ে দেয়।


| | ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত অবস্থা ||
~ ইমাম সাঈয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী

পঠিত : ৩৪৮ বার

মন্তব্য: ০