Alapon

| ঈদ না ইদ: তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক |




বাংলা ভাষা ও বাংলা বানান নিয়ে বিতর্ক সব সময়ই চলছে। উৎপত্তি আর ধ্বনি চিহ্ন 'বর্ণ' নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতানৈক্য নতুন না। ব্যকরণের নিয়মকানুন নিয়েও আছে বিতর্ক। ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি যখন দুই খণ্ডের 'প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যকরণ' প্রকাশ করে, তখনো সেই বই নিয়ে হইচই কম হয়নি। নানা আঙ্গিক থেকেই এর সমালোচনা হয়েছে।

বাংলা ভাষা বহু মানুষের একটি সহস্রাব্দ-ঐতিহ্যের ভাষা হলেও এর নিয়মকানুন এখনো পরিশীলিত বা যুক্তিগ্রাহ্য সুসংগঠিত না। ফলে, এই ভাষার নিয়মকানুন অনেকটাই ব্যক্তি-দল-আদর্শ অথবা ক্ষমতা-প্রভাব-মিডিয়া নির্ভর। যখন যার হাতে ক্ষমতার লাগাম, তখন তার আদর্শ আর চৈতন্যে বাংলা ভাষার গতিপথ নির্ধারিত হয়। কেউ ক্ষমতার জোরে কারও তিন শব্দের নামকে দুই শব্দের নামে পরিণত করে। আবার একটু প্রভাবশালী লেখক হলে তিন শব্দই রাখে। কেউ আবার আকরামকে 'আক্রম' লেখে। সালমানকে লেখে সলমন। (যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা হবে)

এমতাবস্থায় ২০১৭ সালে রোজা ঈদের আগে আগে দেশের অন্তর্জালিক পৃথিবীতে তোলপাড় শুরু হয়। কারণ একটি শব্দের বানান। পুরো দুনিয়ার মুসলিমদের অন্যতম প্রধান দুই উৎসব হলো 'ঈদ'। বাংলা ভাষায় বহু বছর ধরেই এর বানান 'ঈদ' লেখা হচ্ছে। সম্ভবত শব্দটির আগমনকালীন সময় থেকেই দীর্ঘ-ঈ দিয়ে লেখা হচ্ছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা মন-মনন আর চোখ-মগজে এই বানানটি গেঁথে নিয়েছেন। বহু অক্ষরশিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে দীর্ঘ-ঈ দিয়ে 'ঈদ মোবারক'-এর টাইপোগ্রাফি আর ক্যালিগ্রাফি করেছেন। ক্যালেন্ডার, ভিউ কার্ড আর শুভেচ্ছা ব্যানারে আমরা এই বানান দেখে এবং লিখে বড় হয়েছি।
হঠাৎ করেই যখন ফেসবুক আর ব্লগে 'ইদ' বানানটির আমদানি হলো; তখন মানুষ রাগ ও ক্ষোভে নানারকমের প্রতিক্রিয়া দেখাতে লাগল। তখন পত্রিকা, পোর্টাল আর অন্তর্জাল যুক্তি ও পালটা যুক্তিতে জমে উঠল। অল্প সময়েই ভাইরাল টপিক হয়ে ওঠে 'ঈদ' না 'ইদ' বিতর্ক। কবি, লেখক, শিক্ষক, ভাষাবিদ ও সাধারণ শিক্ষিত সমাজের প্রায় সবাই কথা বলেন পক্ষে বিপক্ষে।

তর্ক:

'ইদ' লেখার পক্ষের লোকজন দাবি করেন—তাদের পক্ষে ভাষিক যুক্তি ও দলিল সব আছে। তাদের মতে—'ঈদ' লেখার পক্ষে একমাত্র 'ঐতিহ্য ও প্রচলন' ছাড়া আর কোনো যুক্তি ও প্রমাণ নেই। অপরদিকে 'ঈদ' লেখার পক্ষের লোকজন আরবি ভাষার শব্দের উচ্চারণ ও ঈদ বানানে দীর্ঘস্বর থাকার কারণে এখানে দীর্ঘ-ঈ রাখা জরুরি মনে করেন। পালটা যুক্তি আসে—বাংলা ভাষায় 'নিয়মিত' কোনো দীর্ঘস্বর নেই। এখানে 'নিয়মিত' শব্দটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। লেখার শেষের দিকে এই 'নিয়মিত দীর্ঘস্বর নেই'—কথাটা নিয়ে কিছু কথা আরজ করব।
এরপর 'ঈদ' না 'ইদ' প্রশ্নে চারটি দলে আমরা বিভক্ত হয়ে যাই। একদল, প্রমিত বাংলার বানান রীতি অনুযায়ী 'ইদ' লেখার পক্ষে। আরেকদল একাডেমিকে পির মেনে 'ইদ' লেখার পক্ষে। তৃতীয় দলটি ঐতিহ্য, প্রচল ও 'ইদ' লেখা অকারণ—এই প্রশ্নে 'ঈদ' লেখার পক্ষে। চতুর্থ দলটিতে আবার দুইটা অংশ। একাংশ মনে করেন, আরবিতে 'ঈদ'-এর বানান عيد। আইন, ইয়া, দাল। যেরের পরে ইয়া সাকিন হলে দীর্ঘ করে পড়তে হয়। না হলে অর্থ বিভ্রাটের সম্ভাবনা থাকে। ফলে, যেহেতু বাংলা বর্ণটি দীর্ঘ-কার হিসেবে আছে; তাই 'ঈদ' লেখাই অধিক যুক্তিযুক্ত। অপরাংশের কথা—কলকাতার প্রভাবে মুসলিমদের ঐতিহ্য ও সিম্বলিক পরিভাষাগুলোকে বিকৃত করার চেষ্টা হলো—'ঈদ'কে 'ইদ' কারার একটা পদক্ষেপ। ফলে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও সিম্বলিক পরিভাষাগুলো অভ্যস্ত বানানেই লেখব। সুতরাং আমাদের বানান 'ঈদ'-ই থাকবে।

বিতর্ক:

ধীরে ধীরে তর্কগুলোতে কাউন্টার আসতে থাকে। যুক্তির বিপক্ষে পালটা যুক্তি আসতে থাকে। ভার্চুয়াল বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন তৎকালীন বাংলা একাডেমির পরিচালক ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে জানান যে, 'ঈদ' ভুল নয়। তবে 'ইদ' বিকল্প বানান। তিনি লিখেন, “বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে প্রথম বানান হিসেবে ‘ঈদ’ এবং বিকল্প বানান ‘ইদ’ দেওয়া আছে। প্রথম বানানটি প্রচলিত; দ্বিতীয় বানানটি সংস্কারকৃত। কোনো মানুষ দীর্ঘকাল কোনো বানান ব্যবহার করলে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। ‘ঈদ’ বানানটি তেমনই। অতএব, দুটি বানানই ব্যবহার করা যায়।”

'ইদ' বানানটির পক্ষে যারা তারা বলেন, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরোক্ষ নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান কমিটি এ-ব্যাপারে একটি ফয়সালা করেছিল। সেটা এরকম : তৎসম শব্দের বানানে সংস্কৃত নিয়ম অনুযায়ী ‘ঈ’ লেখা হবে, কিন্তু অ-তৎসম শব্দের বানানে ‘ঈ’ চলবে না। এ নিয়ম তখন থেকে মোটের ওপর কার্যকর আছে।" এর মানে তো কলকাতার অনুসরণই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রস্তাব কোন যুক্তির ভিত্তিতে? যতদূর জানা যায়, একটা শৃঙ্খলার প্রশ্নে এই প্রস্তাব। কিন্তু এই অঞ্চলের 'ঈদ' পালন করা জনতা সেই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। বিদেশি শব্দ হিসেবে ঈদকে গণ্যই করেনি। যদি মেনেই নিত, তাহলে রবীন্দ্রনাথের কাল থেকে আজ অবধি 'ঈদ' বানান টিকে থাকত না। সেই প্রত্যাখ্যাত এবং একটা চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের দোহাই কেন এখনো চলবে?

বিদেশি শব্দের প্রসঙ্গে ভাষাবিদ মনসুর মুসা বলেন, "বিদেশি ভাষার শব্দের বানানে দীর্ঘ ঈ-কার থাকবে না বলা হয়েছে। এই মাপকাঠিটা পরিত্যাজ্য। ১৯ শতক বা ১৮ শতকে ইংরেজরা বিদেশি শব্দ বলতে বোঝাত ফারসি ও ইংরেজিকে। ইংরেজরা বলেছিল সংস্কৃত আলাদা ভাষা। আলাদা বটে, কিন্তু তা তো ইংরেজির মতো বিদেশি না।"

যদি সংস্কৃত শব্দের বানানে দীর্ঘ-ঈ ও ঈ-কার থাকতে পারে, তা হলে দীর্কাল ধরে প্রচলিত ইসলামি পরিভাষাগুলোতে কেন বিশেষ বিবেচনা, খেলাফে কেয়াস, ব্যতিক্রম অথবা প্রচলিত বানান হিসেবে 'ঈদ' থাকতে পারবে না? তা হলে কি চতুর্থ দলের দ্বিতীয়াংশের সন্দেহই ঠিক? এই দেশের মুসলমানদেরকে ভাষিক পলিটিক্সে ডিহিউমেনাইজ করার চেষ্টা! যেমন: কোনো বিশেষ সৈন্য দলের ইউনিফর্ম অথবা নাম হুট করে চেঞ্জ করে তাদের মোরালকে ডাউন করে দেওয়া হয়; তেমনই কি মুসলিমদের পরিভাষাগুলোর বানানের বদলে এক ধরণের মোরাল গেম খেলার চেষ্টার অংশ এইটা!

কুতর্ক:

বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে 'ঈদ'-এর বিকল্প বানান 'ইদ' আছে ১৯৯৪ সাল থেকে। যদিও 'ইদ'-এর সঙ্গে 'সংগততর বানান' বাক্যটি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, তেইশ বছর পরে ২০১৭ সালে কেন এই বানানকে ইস্যু বানানো হলো? কেন এই বানান বিতর্ককে সামনে আনা হলো! যখন পুরো পৃথিবী জুড়ে মানুষ ইসলাম নিয়ে নতুন করে ভাবছে। যখন এই দেশের তরুণদের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামি সাহিত্য নিয়ে নবজাগরণের শুরু হয়েছে। ঠিক সেই সেই সময়ে এই বিতর্কটা কেন ভাইরাল হলো!

এটা কি একান্তই কাকতালীয়! রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত! নাকি চেইন ইস্যু-প্রবণ প্রজন্মের জন্য শুধুই একটা ইস্যু, যে জিনিস অভিধানে আছে তেইশ বছর ধরে। অথচ তা নিয়ে তেইশটি কথাও বলা হয়নি। শুধু একটা ঈদপূর্ব বিতর্কে সেই বিষয়ে ধুন্ধুমার আলাপ! পাঠ্য বইয়ে প্রমিত বানান, সর্বত্র প্রমিত বাংলা এই শ্লোগান, দাবি ও নির্দেশ তো বহু বছর ধরেই চলমান। কিন্তু কখনোই তো 'ঈদ' না 'ইদ' এই নিয়ে কোনো আলাপ বা বিতর্ক চোখে পড়েনি! হঠাৎ করেই দুই দিক থেকে দুই দল প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গেল নিজ নিজ মতামত রক্ষার আন্দোলনে। এ সত্যিই রহস্যজনক।

নিয়মিত দীর্ঘস্বর:

বিতর্কে বলা হচ্ছে নিয়মিত দীর্ঘস্বর নাই। তা হলে অনিয়মিত দীর্ঘস্বর আছে! যদি সংস্কৃতের জন্য অনিমিত দীর্ঘস্বর থাকতে পারে। আমরা ব্যবহার করতে পারি; তাহলে এই দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মুসলিমের আবেগ, ঐতিহ্য আর পেহচানের জন্য বিশেষ পরিভাষায় কেন আমরা দীর্ঘস্বর ব্যবহার করতে পারব না!

আমরা কি নিপাতনে সিদ্ধ নিয়মটি মানছি না! ব্যবহার করছি না! বাংলা ভাষায় কি ব্যতিক্রম নিয়ম ও ব্যতিক্রম বানান নেই? ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধিতে কি নিপাতনে সিদ্ধ বানান নেই?
কেউ বলছেন, দীর্ঘস্বর দিলেও তো উচ্চারণে দীর্ঘস্বর থাকবে না। শুধু যারা আরবিটা জানে, তারাই জানবে এইটা দীর্ঘস্বর। শুধুই ভাষাবিদরা জানেন। প্রয়োগ করেন। এমন নিয়ম কি নেই বাংলায়। প্রত্যয় কতজন জানেন? ধ্বনি বিজ্ঞানের কতটা আমরা জানি। উচ্চারণ বিষয়ক জ্ঞান আলাদা করে অর্জন করতে তো হয়! সন্ধি করার পর তো দুইটি শব্দ একটি হয়েছে সেইটে জানার সোর্স আমরা রাখি। তাহলে উচ্চারণে না আসলেও দীর্ঘ-ঈ ও দীর্ঘ-ঈ-কার রাখতে সমস্যা কেনো। 'আহ্বান'-এর উচ্চারণ যদি আমরা 'আওভান' শিখতে পারি; তাহলে 'ঈদ' এর উচ্চারণ যে কখনো কখনো একটু দীর্ঘ হবে, সেইটে কেন জানতে পারব না!
ভাষার জন্যই তো নিয়ম। নিয়মের জন্য তো ভাষা না। ভাষাকে কেন্দ্র করেই নিয়ম তৈরি হয়। নিয়ম ভঙ্গ হয়। নতুন নিয়ম আসে। তা হলে মুসলিমদের মহান এই উৎসবের নামটির জন্য, 'নবী'র জন্য, রাসূল-এর জন্য ভিন্ন নিয়ম হোক।

ধরুন, 'শফিক রেহমান', 'হায়াৎ মামুদ' অথবা 'হুমায়ূন আহমেদ' যেই বানানে নিজের নাম লিখেন, আপনি কি নিয়ম আর শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে তাদের বানান বদলে দেবেন? রেহমানকে রহমান, মামুদকে মাহমুদ ও আহমেদকে আহমদ/আহমাদ করে দেবেন? এইটা কি বিধি সম্মত হবে! কেউ মেনে নেবে? তা হলে কোটি কোটি মানুষের প্রাণের উৎসবের নামের বানান বদলের চিন্তা কীভাবে আসে আপনাদের মনে?

মনসুর মুসা প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে বলেন, "ঈদ তো একটা উৎসবের নাম। নাম ও ট্রেডমার্ক ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক নয়। এটা হলো কর্তৃত্বের প্রশ্ন। আজাদ পত্রিকা ৫০ বছর চেষ্টা করেছে 'ইকবালকে' 'একবাল' ও 'ইসলামকে' 'এসলাম' লিখতে। টেকেনি। ভাষা বেশি ইডিওসিনক্রেসি বা মতাচ্ছন্নতা পছন্দ করে না।"

হতে পারে এই অঞ্চলের মুসলমানদের ধৈর্য ও মেনে নেওয়ার ক্ষমতাকে এইসব ভাষাগত ছোট ছোট বিষয় দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। বড় কোনো আঘাতের আগে ফিল্ড তৈরি করা হচ্ছে। নিয়ম আর স্মার্টনেসের ফাঁদে আটকে মুসলিমদেরই একদলকে তৈরি করা হচ্ছে সব রকমের 'ডার্টি গেম'কে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য। খেলার পুতুল বানানোর জন্য।
বাংলা এখন মুসলমানদের ভাষা। বর্তমান পৃথিবীতে যারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন তাদের সিংহভাগই মুসলমান। ফলে এই ভাষায় ভাষাভাষী সিংহভাগ মানুষের ট্রেডমার্ক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে দেওয়া নিয়মে বদলে যেতে পারে না। চৈতন্য, ব্যক্তিত্ব, উম্মাহ আর আদর্শের প্রতি দায়বোধ থাকলে আমরা খুব সহজেই নিয়মের ঘোরট্যাপে আটকে নিজস্বতাকে কুরবানি দিতে পারি না।
...
সাইফ সিরাজ
কবি ও বিশ্লেষক

পঠিত : ২৯৯ বার

মন্তব্য: ০