Alapon

কাতার বিশ্বকাপ: ধূসর বৈশ্বিক সংকট

ক্ষণ গণনার দীর্ঘ পথও শেষে আজ বেজে উঠবে বিশ্বকাপের বাঁশি। একটি জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাঠে বল গড়াবে আজ। এবারের বিশ্বকাপে জমকালো আয়োজনের কারণে বলা হচ্ছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। বিশ্বকাপ নিঃসন্দেহে মানুষের নির্মল আনন্দ উপভোগের অন্যতম মাধ্যম। তার চেয়েও বড় বিষয়, বিশ্বের যে কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে ফুটবলই পারে শান্তি ফেরাতে। কিন্তু সেই শান্তি ফেরাতে কত অর্থ ব্যয় করতে হয়?

করোনা মহামারির থাবায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে আর্থিক মন্দাভাব দেখা দেয়। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য, জ্বালানি, খাদ্য ও ভূ-রাজনৈতিক সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের টিকে থাকার লড়াইয়ে হুমকিতে রয়েছে। অনুন্নত দেশগুলোর কথা বাদ-ই দিলাম।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ৪৯টি দেশে মোট ৪৯ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। প্রতি রাতে প্রায় ৮২৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। গত বছরের মে মাসের তুলনায় এ বছর মে মাসে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিশ্বে খাদ্যের দাম ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ৫৩টি দেশে ১৯৩ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য নিরাপদ ঝুঁকিতে রয়েছে। তন্মধ্যে ২৪টি দেশ উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে।

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ নিঃশেষ, চিকিৎসা দ্রব্য সরবরাহে ঘাটতি এবং মৌলিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধিতে ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়। দেশটির ২ কোটি ১০ লাখ (কম-বেশি হতে পারে) জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এদিকে আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ উচ্চ মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ৩৪ হাজারের বেশি শিশু গুরুতর অপুষ্টি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ, যা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএফপিআরআই) পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে যে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি ১৩ লাখ মানুষ ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকবে। সারা বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫২ কোটি ৮০ লাখে।

এ বছর বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’। কিন্তু এই প্রতিপাদ্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাতার জমকালো বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অভিবাসী শ্রমিক শোষণের দেশ কাতার বিশ্বকাপের আয়োজন করতে গিয়ে জলবায়ু দূষণের বড় অংশীদার হয়েছে। জলবায়ু সুরক্ষার পরিবর্তে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেডিয়াম নির্মাণ কতটা যৌক্তিক- সেটা প্রশ্নবিদ্ধ।

স্টেডিয়াম ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণে মানবেতর পরিবেশে প্রায় ১৫ হাজার অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন। বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণের ৪ লাখ শ্রমিকদের মধ্যে শুধু স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণ করতেই ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের এশিয়ার পাঁচটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ৫ হাজার ৯২৭ জন শ্রমিক মারা গেছেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাতারে ১৫ হাজার ৭৯৯ শ্রমিক মারা গেছেন। তারা কাতার সরকারের অভিবাসী মৃত্যুর রেকর্ড থেকে এই সংখ্যার কথা জানিয়েছে। শুধু বিশ্বদরবারে নিজেদের পরিচিতির খায়েশ মেটাতেই হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন বিপন্ন করেছে কাতার।

ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে বিপুল খরচ করেছে কাতার সরকার। রাশিয়া বিশ্বকাপের থেকে গড়ে ৪০ শতাংশ বেশি। শুধু স্টেডিয়ামগুলোর জন্যই খরচ করা হয়েছে ২২০ বিলিয়ন ডলার। যদিও এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে- অনেকের ধারণা এর থেকেও বেশি অর্থ খরচ করেছে দেশটি। আট স্টেডিয়ামে মোট ৩ মিলিয়ন টিকিট বিক্রি হয়েছে, প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্বের ৫০টিরও বেশি উন্নয়নশীল দেশ ঋণ খেলাপির ঝুঁকিতে অথচ উন্নত দেশগুলো মনোরঞ্জনের জন্য আমোদ-প্রমোদে মগ্ন। দু’দেশ পার হলেই ইথিওপিয়ায় চলমান দুর্ভিক্ষে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে সেখানকার শিশুরা। সোমালিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বাই শহরে দুই দিনের ব্যবধানে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ১১০ জন মারা গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বহু দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে অথচ কথিত ধর্মানুরাগীরা আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠছে।

বিশ্ব যখন সংকটের বিপদজ্জনক পর্যায়ে তখন উন্নত দেশগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ অপচয়ের নগ্ন খেলায় মত্ত। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্লান্ত, পিপাসার্ত অথচ উন্নত দেশগুলো তাদের সাহায্য করার পরিবর্তে ঋণ দেওয়ার নামে শোষণের পায়তারা করছে। একদিকে জীর্ণ, শীর্ণ, কঙ্কালদেহী শিশুগুলোর দিকে তাদের নজর নেই- তাদের চোখ আকাশচুম্বী অট্টালিকা গড়ায়, দুর্বল দেশে আধিপত্য বিস্তারে।

কাতার বিশ্বকাপের আমেজে ৮২৮ মিলিয়ন মানুষের ক্ষুধার্ত চাহনী ম্লান। ১৫ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের পরিবারের স্বজন হারানোর আহাজারি ধূসর, তপ্ত বালুর ঝড়ে সুজন মিয়ার স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ। ধিক!

পঠিত : ২৫২ বার

মন্তব্য: ০