Alapon

শাইখ আবদুস সালাম ইয়াসিনের দৃষ্টিতে ইমাম হাসান আল বান্না...



মরক্কোর প্রখ্যাত দাঈ, মহান ইসলাহি মুরব্বি শাইখ আবদুস সালাম ইয়াসিন। তিনি মরক্কোর ‘জামাতুল আদলি ওয়াল ইহসান’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ। তিনি একজন মশহুর দাঈ ও লেখক। তারবিয়াত ও দাওয়াতের ওপর তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। সামসময়িক ইসলামি আন্দোলন নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের নিয়েও লিখেছেন তিনি।

ইমাম হাসান আল বান্না সম্পর্কে শাইখ ইয়াসিন লিখেছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত মুজাদ্দিদ ও সংস্কারকদের সান্নিধ্যের ভেতর দিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মহান নেতৃত্বের আবির্ভাব হবে না, ততক্ষণ এই সংস্কারের কোনো অর্থ ও তাৎপর্য নেই, নেই কোনো স্থান ও অবস্থান। শাইখ হাসান আল বান্না তেমনি একজন নেতা। তিনি আল্লাহওয়ালাদের সোহবত ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত নেতা। তাঁর উদাহরণ চুম্বকের মতো। তিনি অনেক লেখক-সাহিত্যিকের আলোকের কেন্দ্রবিন্দু, অনেক সাহিত্যিক তাঁর কাছ থেকে আলো গ্রহণ করেছেন। ইসলামি সাহিত্যের অনেক পাঠকের হৃদয় আলোকিত হয়েছে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রহমতের বিশাল শামিয়ানায় শাইখ বান্নাকে শামিল করে নিন।

শাইখ বান্নার চিন্তা ছিল চুম্বকশক্তি-বিশিষ্ট এবং তাঁর সময়ের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তেমনি তাঁর মধ্যে ছিল রুহানিয়াতও। তিনি এক সাহেবে দিল আল্লাহওয়ালা। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ছিলেন বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত। শাইখ হাসান আল বান্না খুব তৎপর ছিলেন প্রচলিত তাসাউফের নেতিবাচক বিষয়াদি থেকে তাঁর সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে দূরে রাখতে। কিন্তু যে হুসাফি তবররুকি তরিকতের কোলে শৈশবে তিনি প্রতিপালিত হয়েছেন এবং বেড়ে উঠেছেন, সেই তরিকার বাইয়াত-পদ্ধতিসহ বেশ কিছু নিয়মনীতি তিনি ধরে রেখেছেন। যাতে করে ধারণ করা যায় সেই জিহাদকে—যা তরিকতের শাইখদের কাছে নিছক একটি ঐতিহ্যগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাঁর সংগঠনের সাথিদের জন্য ছিল দ্বৈত বাইয়াত—সাইফ (তরবারি বা শক্তি) ও মাসহাফ (কুরআন)-এর ওপর। একদিকে ছিল সুফি তরিকার বাইয়াত, আরেকদিকে ছিল আধুনিক ব্যবস্থাপনা দুটোর সমন্বয়েই ছিল তাঁর সংগঠনে বাইয়াতের পদ্ধতি।

শাইখ হাসান আল বান্না রিসালাতুত তাআলিম পুস্তিকায় তাঁর সংগঠনের বাইয়াতের শর্তগুলো সুন্দরভাবে সুবিন্যস্ত করে লিখেছেন। এতে তাঁর চিন্তা ও কর্মের মৌলিক বিষয়গুলো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাতে ‘ফাহম’ শব্দ দ্বারা তিনি কী বোঝাতে চান—তা ব্যাখ্যা করেছেন। আর তা হলো—আকিদা, শরিয়ত ও ফিকহের সমন্বয়ে তিনি যে বিশটি মূলনীতি রচনা করেছেন, তা অনুধাবন করা, আর বিদআত ও সুন্নাতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারা।
শাইখ হাসান আল বান্না তাঁর ‘আল উসুলুল ইশরুন’ (বিশ মূলনীতি) পুস্তিকায় ইখলাস, আমল, জিহাদ, তাদহিআ, তাজাররুদ, উখুওয়াহ শব্দ ও পরিভাষাগুলো ব্যাখ্যা করেছেন এবং শেষ করেছেন ‘আস-সিকাহ’ শব্দের ব্যাখ্যার মাধ্যমে।

শাইখ হাসান আল বান্না বলেন, “ইখওয়ানের দাওয়াতের ক্ষেত্রে কর্মীদের প্রতি নেতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো—পিতার দায়িত্ব ও কর্তব্যের মতো আন্তরিক সম্পর্ক রাখা; শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মতো ইলম ও জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া; শাইখে কামেলের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মতো তারবিয়া দেওয়া, অন্তরের পরিচর্যা করা এবং নেতার দায়িত্ব ও কর্তব্যের মতো দাওয়াহর সাধারণ নীতিমালা দ্বারা শাসন করা।”

শাইখ হাসান আল বান্নার চিন্তার দিগন্ত ছিল বিশাল ও বিস্তৃত। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক কিছু তিনি নিজের ভেতরে ধারণ করতে পারতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল মহান ও উদার। তাঁর নেতৃত্ব ছিল নির্ভেজাল। তাই তিনি ফলাফলও পেয়েছেন উত্তম। তাঁর শাহাদাতের পরে ইখওয়ানুল মুসলিমিনে বাইয়াতের বিষয়টি একটি কঠিন ও ভারী উত্তরাধিকার হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। যারা ইখওয়ানুল মুসলিমিনে যোগ দিতে চায়, তাদের জন্য শাইখ হাসান আল বান্না প্রায় ৩৩টি শর্ত দিয়েছেন। তন্মধ্যে আছে—ব্যক্তিগত দায়িত্বসমূহ পালন করা। যেমন— চা-কফি পানের সময় অপব্যয় করা থেকে বেঁচে থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি যত্নবান হওয়া ইত্যাদি। তেমনি আছে ধর্মীয় বিষয়-আশয় সম্পর্কে নির্দেশনা। যেমন— নামাজ পড়ার জন্য ভালোভাবে পবিত্র হওয়া, খুশু-খুযুর সাথে নামাজ আদায় করা এবং সব ফরজ বিধান যথাযথভাবে গুরুত্ব ও মনোযোগ দিয়ে আদায় করা।

সেসব নির্দেশনা প্রণয়ন করতে গিয়ে শাইখ বান্না রহ. রুহ বা আত্মার পরিচর্যার কথা ভুলে যাননি। তেমনি সেখানে আছে আধ্যাত্মিক বিষয়। যেমন— মাসনুন দুআগুলো মুখস্থ করা, যথাসময়ে যথার্থভাবে তা পড়ার প্রতি যত্নবান হওয়া এবং কুরআনুল কারিমের আয়াত ও সূরা মুখস্থ করা। তেমনি চারিত্রিক বিষয়ও সেখানে সন্নিবেশ করেছেন তিনি। যেমন— লজ্জাশীল হওয়া, সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া করা এবং দুর্বলদের সাহায্য-সহযোগিতা করা।
সেই শর্তাবলিতে হাসান আল বান্না রহ. যুক্ত করেছেন আন্দোলন-সম্পর্কিত বিষয়ও। যেমন— সবসময় কর্মতৎপর থাকা এবং জনসাধারণের সেবা করার অনুশীলন করা। তেমনি তাতে আছে রাজনৈতিক বিষয়ও। যেমন— দেওয়ানি আদালতে ঘুস বা পারিতোষিক দেওয়া-নেওয়া থেকে বিরত থাকা এবং সরকারি চাকরির প্রতি লোভ না করা। অর্থনৈতিক বিষয়ও রয়েছে। যেমন, সুদি লেনদেন না করা, বাজারে পণ্যের সংকটকালে অধিক লাভে বিক্রির জন্য পণ্য গুদামজাত না করা ইত্যাদি।”

শাইখ আবদুস সালাম ইয়াসিন রহ. ইমাম হাসান আল বান্না প্রণীত বাইয়াতের শর্তগুলোর মধ্যে ২৬ নম্বর শর্তটির ওপর খুব বেশি জোর দিয়েছেন। সেই শর্তে শহিদ হাসান আল বান্না বলেন, “সবসময় আল্লাহর স্মরণ, আখিরাতের চিন্তার লালন, আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও তাঁকে পাওয়ার জন্য সাহস ও সংকল্প নিয়ে সুলুক ও তরিকতের পথগুলো অতিক্রম এবং নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা। নফল ইবাদতের মধ্যে আছে— তাহাজ্জুদ আদায় করা, প্রত্যেক মাসে কমপক্ষে তিন দিন রোজা রাখা, আইয়ামে বিজের রোজা রাখা, নীরবে ও সরবে বেশি বেশি জিকির করা এবং উল্লিখিত মাসনুন দুআগুলো বেশি বেশি পড়ার চেষ্টা করা।”

শাইখ আবদুস সালাম ইয়াসিন রহ. বলেন, “শাইখ হাসান আল বান্না যে বিষয়াদি বাইয়াতের শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, সেগুলো অনেক উচ্চমার্গের শর্ত। যে ব্যক্তি সেই শর্তাবলি পালন করবে, নিঃসন্দেহে সে মুত্তাকিতে পরিণত হবে। সেই শর্তাবলির মধ্যে একটি শর্ত আছে—যা গোপন করলেও কোনো লাভ নেই, আবার প্রকাশ করলেও কোনো ক্ষতি নেই। লুকিয়ে রাখলেও কোনো উপকার নেই, আবার জানিয়ে দিলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একজন মুসলিমের জীবনে এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়; বরং এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর তা হলো, ‘আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ এবং আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সুলুক ও তরিকতের পথগুলো অতিক্রম করা’। আর এটি সোহবত ও সান্নিধ্য ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। বই-পুস্তক পড়ে তা কিছুতেই অর্জিত হবে না।

আর যে ব্যক্তির সোহবত ও সান্নিধ্য অর্জন করতে যাবে, সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই জিন্দাদিল ও আল্লাহওয়ালা হতে হবে। পাশাপাশি সুলুক ও তরিকতের অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতাও তাঁর থাকা চাই। এভাবে যিনি আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করেছেন, তাকে আল্লাহ তায়ালাও ভালোবাসেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর অন্তরকে করে দিয়েছেন একটি বাতি, একটি প্রদীপ; করে দিয়েছেন একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। আর তা তো অর্জিত হবে কোনো হুসাফি শাইখদের মতো আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে থেকে ইজাযত বা খিলাফত লাভের মাধ্যমে। জাতির বড়ো কোনো ব্যক্তিত্ব বা নেতার সান্নিধ্যে থাকলে এবং নিজেকে ও নিজের সবকিছুকে তাঁর কাছে সোপর্দ করে দিলেও তা কিছুতেই অর্জিত হবে না। তবে রাসূল সা.-এর কথা ভিন্ন। কারণ, তিনি তো পৃথিবীর সব কলবের কিবলা, পৃথিবীর সব মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। তিনি তো রাহমাতুল্লিল আলামিন—করুণার আধার এবং তিনি তো মহান আল্লাহ তায়ালার মাহবুব-প্রেমাস্পদ।”

শাইখ আবদুস সালাম ইয়াসিন মনে করেন, যে সোহবত ও সান্নিধ্য মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে, মানুষের জীবনকে আমূল পালটে দেয়, তা হলো— জীবিত কোনো আল্লাহওয়ালার সোহবত; মৃত ব্যক্তিদের সোহবত নয়; যদিও মৃত ব্যক্তিগণ যত বড়ো রাব্বানি ও সাদিক হন না কেন, হন না যত বড়ো আল্লাহওয়ালা।

শাইখ আবদুস সালাম ইয়াসিনের এই কথাটি ফিকহ সম্পর্কে কথিত ওই ব্যক্তির কথার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যিনি বলেছেন— ‘মৃত ব্যক্তির তাকলিদ বা অনুসরণ করা জায়েয নেই। তাকলিদ করতে হবে এমন ফকিহর— যিনি জীবিত এবং যিনি মানুষ ও ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারেন।’ কিন্তু অন্যান্য ফকিহগণ এই কথাটির সাথে মতবিরোধ করেছেন। তাঁরা বলেন— কোনো ব্যক্তি, কোনো ফকিহ মারা যাওয়ার ফলে তাঁর চিন্তাধারা মরে যায় না, আবেদন শেষ হয়ে যায় না। সুতরাং, তা অনুসরণ করতে কোনো সমস্যা নেই। আর এটাই সহিহ ও বিশুদ্ধ মত। তবে ওই চিন্তাধারা বেঁচে থাকে তাঁর জীবিত ও কর্মতৎপর ছাত্রদের মাধ্যমে। তাদের চর্চা ও পরিচর্যার মাধ্যমে। তারা সেই চিন্তাধারা মানুষের চিন্তা-চেতনায়, মননে-হৃদয়ে নতুন করে গেঁথে দেন।

মিশর, আরব ও ইসলামের জন্য ইমাম হাসান আল বান্না হলেন আল্লাহ তায়ালার অনেক বড়ো দান, বড়ো অনুগ্রহ। খিলাফত বিলুপ্তির চার বা পাঁচ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৮-২৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শাইখ হাসান আল বান্না তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। এর যাত্রা শুরু হয় ইসমাইলিয়া শহরে। সেখানে তিনি এক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তখন। সেখানেই তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিন প্রতিষ্ঠা করেন।

পঠিত : ২৪৮ বার

মন্তব্য: ০