Alapon

আলিমে রাব্বানি সাইয়িদ আবুল হাসান আলী হাসানি নদভির চোখে ইমাম বান্না..



প্রখ্যাত আলিমে রাব্বানি সাইয়িদ আবুল হাসান আলী হাসানি নদভি ইমাম হাসান আল বান্নার মুযাককিরাতুদ দাওয়াহ ওয়াদ-দায়িআহ গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর সম্পর্কে লেখেন, শাইখ হাসান আল বান্না এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই মুসলিম-বিশ্ব বিশেষত আরব রাষ্ট্র্রগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। এখানকার সবকিছুই বিশদভাবে জানার চেষ্টা করতেন। মুসলিম-বিশ্বের এই সংবেদনশীল অংশের সার্বিক অবস্থা এবং এখানে যে অবক্ষয় শুরু হয়েছে, সেসব বিষয়ে জানার চেষ্টা করতেন। তাদের আকিদা ও বিশ্বাসে, অনুভব ও অনুভূতিতে, স্বভাব ও চরিত্রে, পরিবার ও সমাজে, ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞায় যে পচন ধরেছে, সে সম্পর্কে চিন্তা করতেন। তিনি জানতেন, তাদের হৃদয় ও শরীরে যে অধঃপতন শুরু হয়েছে তার প্রেক্ষাপট।

শাইখ হাসান আল বান্না জানতেন, মামলুক, তুর্কি ও খেদিভ পরিবারের শাসনের রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ সম্বন্ধেও। এদের পরে বিদেশি ইংরেজ শাসন, তাদের বস্তুবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা এখানে যা কিছু নিয়ে এসেছে, যে সংকট সৃষ্টি করেছে, সেসব সম্পর্কেও তাঁর জানাশোনা ছিল। ইংরেজদের ধর্মহীন আধুনিক শিক্ষা এ দেশের মুসলিম যুবসমাজকে যে অতল গভীর খাদে ফেলে দিয়েছে এবং দিচ্ছে, তা তাঁকে প্রতিনিয়ত আহত করত। এ দেশের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর হাত ধরে যেসব সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেসব সম্পর্কেও তিনি ভালোভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন।

শাইখ হাসান আল বান্না স্বচক্ষে দেখতে পান, এই দেশে আলিম-উলামার প্রভাব কমে যাচ্ছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে তাদের কথার শক্তি ও জোর। তারা বস্তুবাদী শক্তির আনুগত্য করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের অনেকে ইমামতির দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে। নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে মানুষকে হিদায়াত ও দিক-নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব থেকে। অব্যাহতি নিচ্ছে জাতিকে সদুপদেশ দেওয়ার পদ থেকে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে জিহাদ ও সংগ্রামের পথ থেকে। ‘বাস্তবতা’র কাছে সবাই আত্মসমর্পণ করছে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বাধাদানের যে উঁচু নিনাদ ছিল, তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। সবখানে বৃদ্ধি পাচ্ছে নষ্ট-ভ্রষ্টদের দৌরাত্ম্য। সবকিছু চলে যাচ্ছে লম্পট ও উন্মাদদের করায়ত্তে। নাস্তিক ও মুরতাদরা সর্বত্র তাদের বিষধর নখর বসাচ্ছে।

অধিকাংশ পত্রিকা, ম্যাগাজিন, সাময়িকী হয়ে গেল ইসলামবিরোধী শক্তির চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম; এমনকি শক্তিশালী হাতিয়ার। তারা এগুলোর মাধ্যমে সবখানে নিজেদের ভ্রষ্ট চিন্তা-চেতনা বিস্তার করছে। দেশ ও সমাজবিধ্বংসী বিভিন্ন আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। দুর্বল করে দিচ্ছে, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ। ধ্বংস করছে মানুষের চরিত্র ও আখলাকের মূল ভিত্তিকেও। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে লাগল গণমানুষের মাঝে। পরিবর্তন হতে লাগল সমাজ ও সমাজের চালচিত্র।

আরবের সবখানে এই প্রভাব পরিলক্ষিত হতে লাগল; বিশেষত মিশরে। এর ফলে বিংশ শতাব্দীর শুরুর তিন-চার দশকের চিত্র ছিল উদারতার খোলসে নগ্নতা। নিম্নগামী হলো মানুষের নৈতিক জীবনমান। নৈতিক অবস্থান হতে লাগল দুর্বল থেকে দুর্বলতর। চারিত্রিক অধঃপতন খাদের কিনারে পৌঁছাল। দেশ ও সমাজে দেখা দিলো বিশৃঙ্খলা। প্রচণ্ড চারিত্রিক-আধ্যাত্মিক অবক্ষয় হলো।

শাইখ হাসান আল বান্না এ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বিশেষ করে আল আহরাম, আল মুকতি, আল হিলাল, আল মুসাওয়ার প্রভৃতি পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যার পাতায় পাতায় সচিত্রে দেখতে লাগলেন। যুবসমাজে তুমুল জনপ্রিয় কবি-সাহিত্যিকদের রচনার ভাঁজে ভাঁজে তিনি খুঁজে ফিরলেন সমাজের অবয়ব।

মিশরের ঈদ উদ্যাপন, নববর্ষ উৎসব, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও নৈশ পার্টিতে জনসমাজের অবস্থা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া যুবকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমিতিতে তাদের আলোচনা ও কথাবার্তা শুনতে লাগলেন।

দেশ ও সমাজের অবস্থা দেখার জন্য শাইখ হাসান আল বান্না সফর করতে লাগলেন আলেকজান্দ্রিয়া, নীলনদের তীরবর্তী অঞ্চলসমূহ এবং গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের স্থানগুলোতে। যুবকদের অবস্থা খুব কাছ থেকে দেখার জন্য তিনি থেকেছেন স্কাউটদল ও খেলোয়াড়দের সঙ্গে, ঢুকেছেন সিনেমাহলগুলোতেও। পর্যবেক্ষণ করেছেন স্থানীয় ও বিদেশি ফিল্মগুলোর অবস্থা। মাঝে মাঝে মিশরের গল্প-উপন্যাসাদি সম্পর্কেও খোঁজখবর নিয়েছেন। বুঝতে চেষ্টা করেছেন, তরুণরা কেন এসব দেদারসে গিলছে!

সমাজঘনিষ্ঠ হয়ে জীবনযাপন করেছেন শাইখ হাসান আল বান্না। সমাজের প্রতিটি ধাপ ও ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সমাজের সবকিছুর সাথে, জনসাধারণের সাথে মিশেছিলেন তিনি। প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনায়, জাতীয় সমস্যা-সংকটে জনগণের পাশে ও সাথে ছিলেন। কোনো সুউচ্চ অট্টালিকায় তিনি বসবাস করেননি। সুসজ্জিত কক্ষে বসে সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেননি। কোনো অলীক স্বপ্ন ও কল্পনার জগতে বাস করেননি। শাইখ হাসান আল বান্না খুব গভীরভাবে বুঝেছেন ইসলাম ও মুসলিমদের বিপদ-বিপর্যয়ের কারণ, এর উৎস ও উৎপত্তি। এই অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কাজ করতে গেলে কী কী সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হতে হবে, সে সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হয়েছেন তিনি। ইসলামের দাওয়াতের ক্ষেত্রে পুরো মুসলিম-বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া যে দেশের দায়িত্ব ছিল, সে দেশের অবস্থা কেন এমন করুণ, তা নিয়ে তিনি ভেবেছেন।

শাইখ বান্না বেশ কয়েক যুগ ইসলামের সুশীতল শামিয়ানা হয়ে মানুষকে ছায়া দিয়েছেন। তিনি ছিলেন ইলম ও জ্ঞানের আঁকর। আরববিশ্বকে পুনরায় দ্বীনের পথে চলতে সাহায্য করেছেন। শুধু তা-ই নয়; তিনি বরং ইসলামের ইতিহাসের এক কঠিন ও সংকটময় সময়ে আরববিশ্বকে পতনের খাদ থেকে উদ্ধার করেছেন। আজহার শরিফ সবসময় তাকে আশ্রয় ও ছায়া দান করেছে। আর এই আজহার শরিফই তো ইসলামি সংস্কৃতি সংরক্ষণের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন কেন্দ্র।

শাইখ হাসান আল বান্নাকে যারা বইয়ের পাতা থেকে নয়; বরং খুব কাছ থেকে দেখেছেন, খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন, যারা তাঁর সঙ্গে জীবনসফরে পথ চলেছেন, তাঁর সাথে দিনাতিপাত করেছেন, তারা এই ব্যক্তিত্বের দয়ার্দ্রতা ও স্নেহপরায়ণতায় বিমোহিত হয়েছেন, যা খুব দ্রুত মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। দাওয়াত, তারবিয়াত, জিহাদ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এই মহান ব্যক্তির যে প্রভাব আছে, তা কল্পনাতীত দ্রুততায় মিশরে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর তা প্লাবিত করে আরববিশ্বকে। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো মুসলিম-জাহানে।

আল্লাহ তায়ালা শাইখ হাসান আল বান্নাকে দান করেছেন অনন্য প্রতিভা; আর দিয়েছেন এমন অসামান্য শক্তি, যা মনোবিজ্ঞানী ও নীতিবিজ্ঞানীদের কাছে, ইতিহাসবিদ ও সমালোচকদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বৈপরীত্যমূলক; কিন্তু বাস্তবে তা নয়। তাঁর ছিল চমৎকার মেধা আর প্রদীপ্ত বোধ ও বুদ্ধি। তাঁর মধ্যে ছিল উচ্ছ্বসিত, উদ্দীপ্ত ও দৃঢ়তর অনুভূতি। ছিল উচ্ছল, উদার ও পবিত্র হৃদয়। তিনি ছিলেন তারুণ্যময় সজীব প্রাণবন্ত।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দান করেছেন বাগ্মিতাপূর্ণ আলঙ্কারিক ও হৃদয়গ্রাহী ভাষিক শক্তি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল দুনিয়াবিমুখ ও স্বল্পে তুষ্ট। দাওয়াতে দ্বীনে তাঁর ছিল উচ্চাশা ও উচ্চাকাক্সক্ষা, দ্বীনের প্রচারে ক্লান্তি যেন তাঁকে স্পর্শ করত না। এ ক্ষেত্রে তাঁর মন ও হৃদয় ছিল প্রেমময় ও উচ্চাকাক্সক্ষী। তাঁর সব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা ছিল দ্বীনের জন্য নিবেদিত। তাঁর ছিল তীক্ষ্ম দূরদৃষ্টি। দাওয়াতের ক্ষেত্রে শাইখ বান্নার যেমন ছিল আবেগ, তেমনি ছিল আত্মসম্মানবোধ। আত্মসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে তাঁর মধ্যে এমন বিনয় ও নম্রতা দেখা যেত, যার প্রমাণ সর্বজনবিদিত। এমনকি তাঁকে মনে হয় যেন এক আলোকরশ্মি যার কোনো ভর নেই, ছায়া নেই, নেই কোনো অস্পষ্টতা; যারা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের অনেকেই এমন অনুভূতির কথা আমাকে বলেছেন।

শাইখ হাসান আল বান্নার এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বদানের দক্ষতা গঠনে সহযোগিতা করেছে। শাইখ হাসান আল বান্নার শাহাদাতের পর দীর্ঘদিন আরববিশ্ব তাঁর মতো শক্তিশালী, গভীর প্রভাব বিস্তারকারী ও এমন কর্মনিষ্ঠ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর দেখেনি। ইসলামি আন্দোলনের বিনির্মাণ, তা সমাজের অভ্যন্তরে প্রোথিতকরণ এবং গণমানুষের অন্তরে গভীরতর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর মতো অধিক তৎপর ও কর্মবাস্তবায়নকারী ব্যক্তিত্ব সত্যিই বিরল; বিশেষত আরবে। তিনি ইসলামি আন্দোলনকে নিয়ে যান বিস্তৃত পরিধিতে।

শাইখ হাসান আল বান্নার প্রতিভার প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচিত্রভাবে। তবে এমন বিশেষ দুটি ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটেছে, যা অন্যান্য দাঈ, দায়িত্বশীল, নেতা ও সংস্কারকদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। তা হলো,

প্রথম : দাওয়াতের প্রতি শাইখ হাসান আল বান্নার নিমগ্নতা ছিল খুবই গভীর। দাওয়াতি কাজে তিনি থাকতেন সার্বক্ষণিক তৎপর। এর মধ্যেই ছিল তাঁর জীবনের তৃপ্তি ও পরিতুষ্টি। দাওয়াতের জন্যই তিনি জীবনপাত করেছেন। তাঁর জীবনের সব শক্তি, প্রতিভা ও যোগ্যতা যেন নিবেদিত ছিল দাওয়াহর জন্যই। তাঁর জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল দাওয়াত, যার মধ্যে আল্লাহ তায়ালা প্রভূত কল্যাণের ফল্গুধারা প্রবাহিত করে তাঁকে দাঈ ও নেতারূপে বাছাই করেন, এটাই তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য ও আলামত।

দ্বিতীয় : সঙ্গীসাথি ও বন্ধুবান্ধবদের ওপর শাইখ হাসান আল বান্নার প্রভাব ছিল খুবই গভীর। তারবিয়াত ও দাওয়াতের মানসিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি বিনির্মাণ করেছেন একটি বিশাল প্রজন্ম। তিনি ছিলেন একটি জাতির মুরব্বি ও রাহবার। শাইখ হাসান আল বান্না শুধু একজন ব্যক্তিই ছিলেন না, ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নতুন জ্ঞান, নতুন চিন্তা ও উত্তম চরিত্রের প্রতিষ্ঠান। ছাত্র হোক বা কর্মচারী যে-ই শাইখ বান্নার কাছে এসেছে, তাঁর সাথে মিশেছে, তিনি তাকে আকৃষ্ট করেছেন, তার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি প্রভাব বিস্তার করেছেন তাদের রুচি-অভিরুচি, চিন্তার বিন্যাস-বিনির্মাণে, এমনকি তাদের কথা বলার ধরন ও ভঙ্গিতে, তাদের ভাষায় ও বক্তৃতায়।

আর এই প্রভাব দীর্ঘকাল মানুষের মাঝে বিদ্যমান। এমনকি যারা শাইখ হাসান আল বান্নার সান্নিধ্য পেয়েছে, তাদের মধ্যে ছিল এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও আলামত- যা দ্বারা তাদের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়ে আলাদাভাবে চেনা যেত; স্থান ও সময়ের পরিবর্তনে তাদের এই বৈশিষ্ট্য ম্লান হয়ে যায়নি।

পঠিত : ২৬৪ বার

মন্তব্য: ০