Alapon

ইসলামি আন্দোলন ও ইকামাতে দ্বীন মানে কী? ইকামাতে দ্বীনের কর্মীর কাজ কী?



ইসলামি আন্দোলনের সংজ্ঞায় ইসলামি আন্দোলনের রাহবারগণ বলে থাকেন যে, ইসলামি আন্দোলন হচ্ছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।

আর ইকামাতে দ্বীনের শাব্দিক অর্থ “দ্বীন প্রতিষ্ঠা।” স্বাভাবিকভাবে আমরা ইকামাতে দ্বীন মানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকেই বুঝি।

সুতরাং ইকামাতে দ্বীন বলি বা ইসলামি আন্দোলন বলি, সেটার প্রায়োগিক বা পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে,

“প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে সমূলে অপসারণ করে সেখানে আল্লাহ প্রদত্ত রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বা আন্দোলন।”


এই সেন্সকে, এই চিন্তাকে সামনে রেখে বলা যায় যে, আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চাই, দল না। দ্বীনের স্বার্থেই দল করি। দলের স্বার্থে দ্বীন নয় । আমরা যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে চাই এক্ষেত্রে আমরা একটা বড়োসড়ো ভুল করি, সেটা হচ্ছে আমরা আমাদের দলের কোনো ব্যক্তি, কোনো আলিম ভুল করলে সেটাকে ভুল মনে করতে রাজি না। মনে মনে ভুল মনে করলেও কিন্তু সেটাকে জায়েজ করার চেষ্টা করি। এটা সব ঘরানার ক্ষেত্রেই শতভাগ সত্য। তবে ইসলামি আন্দোলনের ভাইদের মন-মানসিকতার মধ্যে অন্যদের তুলনায় কিছুটা উদারতা আছে বৈকি !

যাহোক, আমাদের মনে রাখা উচিৎ —আমার দল, আমার আন্দোলন, আমাদের সংগঠন মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। এইটুকু অনেকেই স্বীকার করে। কিন্তু যখনই কোনো শরীয়ত সম্মত বিষয়-আশয় নিয়ে আমাদের দলের বা আন্দোলনের কেউ ভুল করেন, কোনো ভুল মতামত প্রদান করেন, তখন আমরা আর সেটাকে আর ভুল বলে মেনে নিতে পারিনা। আমরা তখন ওনার ভুলটার যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য সমালোচনা যে বা যারা করে, তাদের বিরুদ্ধে তেড়ে আসি। নাখোশ হই। অথচ আমরা ভুলে যাই যে, উনি মানুষ। মানুষ বলেই মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নন তিনি। যেহেতু ভুল হয়েছে, সেহেতু ভুলের ব্যাপারে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে সেই ভুলের ব্যাপারে সতর্কতা ও সচেতনতা সৃষ্টি করে শুদ্ধটা জানানো উচিৎ অন্যদের। তবে এটা ঠিক, অনেকে সমালোচনার আদবকেতা রক্ষা করতে পারেনা। কেউ কেউ তো বিদ্বেষমূলক সমালোচনা করেন। কিন্তু কেউ যদি সমালোচনার আদবকেতা রক্ষা করে সমালোচনা করেন, তাহলে তো তার প্রতি তেড়ে আসার কারণ নেই। বরঞ্চ এখানে কোনো পরম হিতাকাঙ্ক্ষীসূলভ সমালোচকদের প্রতি তেড়ে আসা, বা মন্দ আচরণ করাটা বড়োসড়ো একটা জুলম। এই জুলম নিজের প্রতি। প্রিয় ব্যক্তি বা দলের প্রতিও। এতে করে আমি যে দ্বীনের পূজারি না হয়ে ব্যক্তির ও দলের পূজারি হচ্ছি, সেটাই ফুটে ওঠে।

ইসলামি আন্দোলনকৃত সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব যেহেতু মানুষই দেয়, সেহেতু এখানে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। আমরা যদি সত্যিই দ্বীনই প্রতিষ্ঠা চাই, তবে আমাদের উচিৎ হচ্ছে মানুষ হিসেবে এই আন্দোলনের দায়িত্বশীল এবং আন্দোলনের ভুলগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া। ভুলগুলোকে ভুল বলে স্বীকার করা। ভুলগুলো যেনো প্রসারিত না হয়, মানুষ যেনো ভুলের গর্তে পা না ফেলে — সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।

অনেকেই ইসলামি আন্দোলন, বা ইকামাতে দ্বীনের কাজ বলতে ভুল ম্যাসেজ গ্রহণ করে থাকেন। সেজন্য আমরা ভুলকে সচেতনতার সাথে ফেলে দেওয়ার জন্যে যেটা সঠিক, সেটা বলিনা। ভুলকে একপাশে রেখে সঠিকটা সামনে আনি না। এটা নিয়ে আলোচনা করিনা। কারণ, এতে দলের ক্ষতি হবে; এটা ভাবি। কিন্তু নিজের প্রিয় ব্যক্তি, প্রিয় দল ভুলের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়াটা তো আর বড়ো রকমরই ক্ষতি দল এবং দলের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের জন্য।

ভুলের আবর্ত থেকে নিজের প্রিয় মানুষকে, প্রিয় সংগঠনকে দূরে রাখাটাও তো ইকামাতে দ্বীনেরই একটা কাজ। দ্বীনের মধ্যে ভুল না ঢুকুক, দ্বীন অবিকৃত থাকুক, এটা কি ইকামাতে দ্বীনের কাজের মধ্যে পড়েনা?

যেমন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলনগুলো তাদের কর্মীদের ফ্রি-মিক্সিং, মিউজিক বাজানো, নিকাব না করা, আল্লাহর আইনের পরিবর্তে সেক্যুলার আইনের কল্যাণ রাষ্ট্রের কন্সেপ্ট; ইত্যাদিকে স্বীকার করেন না। এসব থেকে এখন অবধি অফিসিয়ালি মুক্ত এসব আন্দোলন। কিন্তু কখনো যদি অফিসিয়ালি, সাংগঠনিকভাবে এসব ভুল অবস্থান গ্রহণ করা হয়, তখন আপনি যদি মনে করেন যে, দলের স্বার্থে এসব নিয়ে কথা বলা যাবে না। এসব মেনে নিন। অথবা স্রেফ এই বলে এড়িয়ে যান যে— এসব মতবিরোধপূর্ণ বিষয়, আমরা আমাদের মূল কাজে মনোযোগ দিই; তাহলেও আপনি ইসলামি আন্দোলন, ইকামাতে দ্বীন বুঝেননি। আর যদি আপনি এই অবস্থানটা গ্রহণ করেনও, সেটা কি সঠিক হবে? চুপচাপ বসে একটু নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করে নিবেন।

আপনি যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা বলতে শুধুই দলে টিকে থাকা, দল বড়ো হওয়া, দলের ক্ষমতায় যাওয়া ইত্যাদিই বুঝেন— তাহলে আপনার এই বুঝ যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। আপনার ইসলাম প্রতিষ্ঠা, ইসলামি আন্দোলন কিংবা ইকামাতে দ্বীনের কনসেপ্ট ক্লিয়ার নয়। আপনি ভুল কনসেপ্টে আছেন।

ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইকামাতে দ্বীন মানে তো মুস্তাহাব-নফল থেকে শুরু করে ফরজ পর্যন্ত যা আছে, সবকিছুরই প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ। ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র; একেবারে সবকিছুই ইকামাতে দ্বীন নামক পরিভাষার অধীন। আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, ফরজটা যেভাবে দ্বীনের অংশ, তদ্রূপ ওয়াজিব-সুন্নাহ এবং নফলটাও দ্বীনেরই অংশ। ব্যক্তিগত আমল-আখলাক যেমন দ্বীনের অংশ, তেমনিভাবে সমাজ-রাষ্ট্রও দ্বীনেরই অংশ।

আপনি ইকামাতে দ্বীনের কর্মী হিসেবে এসবের যেখানে-যেটায় ঘাটতি পরিলক্ষিত করবেন, সেখানে সেটার সেই ঘাটতি পূরণের জন্য আপনি কাজ করে যাবেন। এটাই ইকামাতে দ্বীনের দাবি। ঈমানেরও দাবি। তবে আগে যেটাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার সেটাকে দিতে হবে। কারো ফরজের ঘাটতি আছে মানে তাকে ফরজমুখি করবো আগে। কারো ওয়াজিবে ঘাটতি থাকলে সেটা পূর্ণ করার জন্য কাজ করবো। কেউ দ্বীনের টুকটাক মানছে, কিন্তু ব্যাপক শিথিলতা প্রদর্শন করছে; এবার তাকে তাকওয়াপূর্ণ আমল— যেটার মাধ্যমে আল্লাহর আরো নিকটবর্তী হওয়া যাবে, সেটার দিকে আহ্বান করুন। গতানুগতিক মুসলিমদেরকে ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিম বানান। ইকামাতে দ্বীনের একজন কর্মীর কাজ কিন্তু এগুলোও।

ইসলামি আন্দোলনের কর্মী হিসেবে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে, যে কাজগুলো ইখলাসের পারদে ফাটল ধরাবে, যে কাজগুলো তাকওয়ার তাবুটা ভেঙে দেবে, সেগুলো দূর করার চেষ্টা করবেন। শুধু এটাই ইসলামি আন্দোলন নয়, তবে এগুলোও ইসলামি আন্দোলনেরই অংশ। এগুলোও ইকামাতে দ্বীনের অন্যতম একটা কাজ। যদি ইকামাতে দ্বীন বলতে পরিপূর্ণ দ্বীনটাকেই বুঝেন আরকি।

সোজা কথায় ইসলামি আন্দোলন বা ইকামাতে দ্বীনের কর্মী হিসেবে আন্দোলনকে ভুলভ্রান্তি হতে হেফাজতের জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা করাটাও একজন সত্যিকারের ইকামাতে দ্বীনের কর্মীর অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ।


~ রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৪৮৭ বার

মন্তব্য: ০